একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম গতকাল সারারাত ধরে। আচ্ছা! নাট্যব্যক্তিত্ব মাসুম রেজা যখন আহ্বান করেছেন- #metoo এর মতন সকল নিপীড়ক যেন #ক্ষমাচাই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। শুনতে তো ভালোই লাগছিলো। দেখলাম, ক্ষমা চাই প্রক্রিয়াতে ইতিমধ্যেই অনেকে অংশগ্রহণ করেছেন। এটাকে সাধুবাদ জানাই।
কিন্তু যে মেয়েটার স্বপ্ন ছিলো কেবল সাংবাদিকই হবে, একা একা দু'টো সন্তানকে নিয়ে এখন সে আমেরিকার রাস্তায় ট্যাক্সি চালায়! যে মেয়েটার স্বপ্ন ছিলো ভবিষ্যতের নাট্যব্যক্তিত্ব হওয়ার, সে এখন একজন উন্নয়নকর্মী! যে মেয়েটার স্বপ্ন ছিলো আরও আরও অনেক কিছু হওয়ার, সে বা তারা এমন অনেক কিছুই হতে পারে নি যে বা যাদের কারণে তাদের কি এত সহজেই ক্ষমা পাওয়ার কথা?
সুনির্দিষ্টভাবে ওই এক বা দু'টি ঘটনার জন্য একটা মানুষের জীবন, তার কতগুলো রাত বা মুহুর্ত অবর্ণনীয় কষ্টের মাঝ দিয়ে গেছে তা কী আমরা বুঝতে পারবো কখনো?
প্রশ্ন হচ্ছে: তারপরেও কেনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারীকে ক্ষমা করে দেয়া? এই ক্ষমাপ্রার্থনাকারীগণ আজকের এই পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষমা চাওয়ার মানসিকতায় ছিলেন কিনা?
উত্তর হলো:
কোনো অভিযোগকারী ক্ষমাপ্রার্থনাকারীকে তার দুর্বিষহ জীবনের পরিক্রমার যে কারিগর, তাকে আদতে ক্ষমা করতে পারে না। কেউ তা করেওনি।
যা হয়েছে তাকে যদি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়: একজন খুন করে খুন স্বীকার করলেও কি তাকে আদালত মুক্তি দেয়? দেয় না। বাদী চাইলেও তা আর সম্ভব নয়। কিন্তু যখন শাস্তি হবে জেনেও কোনো খুনী তার দায় স্বীকার করে শাস্তি মাথা পেতে নেয়, তবে সেই খুনীকে আদালত চাইলে কিছুটা কম শাস্তির বিধান করতে পারে; ক্ষমা করে দেয় না।
তাই যে বা যারা এই মুভমেন্টে নিপীড়কদের এমন সহজেই পার পেয়ে যাওয়ার বিষয়টির জন্য অভিযোগকারীদের ক্ষমা করে দেয়াকে দুষছেন, দুয়ো দিচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি:
১. একজন এনাম আহমেদ শর্তহীন ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন বলেই কেবল তাকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে।
অথচ আমি যতদূর জানি -এইরকম আরও আরও একজন থেকে অনেকে আছেন; যারা ক্রমাগত প্রচেষ্টায় নিজেদের অন্যায়কে প্রথমে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন!
২. অভিযোগকে বানোয়াট-মিথ্যা বলে প্রচার করেছেন।
৩. অভিযোগকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকি-ধামকি দেয়া থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন।
এগুলোর মাঝে একজন এনাম আহমেদ দায় স্বীকার করেছেন, হোক সে পরিস্থিতির চাপে কী স্বতঃপ্রণোদিতভাবে; তাই তাকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে।
তার এই দায় স্বীকার এটা অন্তত প্রমাণ করে অভিযোগকারীদের অভিযোগগুলো ভীষণভাবে সত্য এবং তা শাস্তিযোগ্য।
আইন দিয়ে এই শাস্তির বিধান হয়, কিন্তু আইনী শাস্তি কি সবসময়ই অপরাধীর বোধদয় ঘটাতে পারে? পারে সামাজিক আদালত। সমাজ কী বিবেচনায় কী ধরনের শাস্তির বিধান করবে এসব নিপীড়কদের, তার উপর নির্ভর করে সত্যিকার অর্থে একটি সমাজের বাস্তবিক মনস্তত্ত্ব।
মী টু আন্দোলন ব্যক্তিক আন্দোলন থেকে সামাজিক। ব্যক্তি এখানে চিহ্নিত করে দিচ্ছে হাজারো রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে একজন নিপীড়ককে, এরপর সমাজের দায়িত্ব তারা এমন নিপীড়ককে নিয়ে কী করবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই পর্যন্ত কোনো অভিযোগকারী বদ্ধরুমে ক্ষমা প্রার্থনাকে গ্রহণ করে নি বলেই আমি জানি এবং এই পাবলিকলি ক্ষমা প্রার্থনার বিনিময়ে কেউ তার অভিযোগ তুলে নেয়ার ব্যাপারেও সম্মত হয় নি। সুতরাং অভিযোগকারীগণ কেউই তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেন নি।
যেহেতু এই আন্দোলন মূলত: মুখোশ উন্মোচনের আন্দোলন, তাই কোনো অভিযোগকারী নিপীড়কের আইনী শাস্তি না দাবি করলেও; সমাজ তো জেনেছে, তারা সমাজকেতো সাহস করে জানিয়েছে।
এবার দায়িত্ব তো আর অভিযোগকারীর থাকে না, এবার দায়িত্ব আপনাদের হে সমাজ।
আপনারা ভাবুন, আপনারা কী করবেন? সব দায়িত্ব অভিযোগকারীদের দিলে হবে কি?
এবার আপনারা (সমাজ, বিবেক, সচেতনতা, দৃষ্টিভঙ্গি) আপনাদের দায়িত্বটুকু পালন করে দেখান।