জেসমিন চৌধুরী

প্রবাসী, সমাজকর্মী

দেশে দেশে বঞ্চনার দুষ্ট চক্র

জীবনের প্রথম জেলখানার উঠোনে পা রেখেছি। না, আসামী নয়, দোভাষী হিসেবে। ক্লায়েন্ট গুরুতর অপরাধের আসামী। আমার বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে। যদিও জেলখানার ভেতরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় তবুও বলা যায় না।

রিসেপশনের পাশেই বিশাল ভিজিটর'স ওয়েটিং রুমে গিজগিজ করছে নানা বয়সের আর বর্ণের লোক। এর মধ্যে বেশিরভাগই নারী এবং শিশু। ধরেই নিচ্ছিলাম এরা নিজেদের স্বামী, সঙ্গী বা বাবার সাথে দেখা করতে এসেছে।

এদেরকে আমি ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও সামাজিকভাবে ঠিকই চিনি, আগে দেখেছি বহুবার- কাউন্সিল এস্টেটগুলোর আশেপাশের পার্কে, শপিং মলে, কমিউনিটির বিভিন্ন সার্ভিস সেন্টারে।

মেয়েগুলোর চুল উঁচু করে বাঁধা, প্যাডেড ব্রা পরা উদ্ধত বুক, সস্তা পুরু মেক-আপে ঢাকা মুখমন্ডল, নকল জেল-নখে সজ্জিত অস্বাভাবিক রকমের লম্বা আংগুলের প্রায় সবগুলোতেই বিশাল আকারের আংটি, পায়ে চিকন উঁচু হিলের জুতো। বাচ্চাগুলোর চুল এলোমেলো, কাপড়চোপড় কিছুটা ময়লা, হাতে কোক, পটেটো ক্রিস্পস অথবা চকলেট বার। পুশচেয়ারে বসা বাচ্চাগুলোর মুখে ডামি, হাতে ময়লা চিটচিটে কাপড়ের পুতুল।

আমাদের বাসা থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে অবস্থিত ইউদিনশো আবাসিক এলাকায় যারা একবারও গেছেন আমার এই বর্ণনা শুনেই তারা এইসব নারী এবং শিশুদেরকে চিনে নিতে পারবেন। এক সময় অপরাধের জন্য কুখ্যাত এই ইউদিনশোর অবস্থা ইদানিং কিছুটা উন্নতির দিকে গেলেও আশেপাশের উন্নততর এলাকাগুলোর তুলনায় এখানের মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা এখনো অনেক বেশি।। ইদানিং সরকার এর উন্নয়নে অনেক মনোযোগ দিয়েছে। বিশাল কমিউনিটি হল আছে একটা যেখানে পারিবারিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন রকম ব্যবস্থা রয়েছে। বিশাল অত্যাধুনিক বাস স্ট্যান্ড হয়েছে। ট্রামলাইন চালু হওয়াতে বিভিন্ন পেশার লোক এখানে বসবাস শুরু করাতে বাসাবাড়ির দাম বেড়েছে।

কিন্তু এখনো রাস্তার মোড়ে মোড়ে জুয়াখানা, পানশালা, বন্ধকি-দোকান আর সুইট শপ দেখেই বোঝা যায় এখানের মানুষের জীবনের মান কেমন। এদেশের সবচেয়ে বড় সুপারস্টোর টেসকোর সিস্টার কনসার্ন ওয়ান-স্টপ-শপের শাখা দেখা যায় এসব সুবিধাবঞ্চিত এলাকায়, যেখানে টেসকোর স্বাস্থ্যকর খাবারগুলো অনুপস্থিত, আবার তাদের নিজেদের ব্র্যান্ডের সস্তা অথচ উন্নতমানের সামগ্রীগুলোও এখানে পাওয়া যায় না। শুধু চকলেট, বিস্কিট, কেক, মদ, আর ফিজি ড্রিংকস যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথচ দাম আকাশ-ছোঁয়া। শিক্ষিত মানুষরা বাস করেন যেসব এলাকায় সেখানে এসব দোকান ব্যবসাই করতে পারবে না।

উইদিনশো'র মতো অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত এলাকা এদেশে অনেক রয়েছে। এসব এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে একটা সামাজিক বিপর্যয়ের কুটিল চাকা ঘুরছে কিন্তু এই চাকার ঘুর্নন অগ্রগতি আনে না বরং একই জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে গর্ত সৃষ্টি করে ফেলে যেখান থেকে আর উঠে আসা যায় না। এখানের মানুষদের বেশিরভাগই সরকারী ভাতার উপর নির্ভরশীল স্বল্প আয়ের লোক যাদের অনেকেই বিষন্নতা রোগে ভোগে এবং এ থেকে মুক্তির জন্য নিজের অখন্ড অবসর কাটায় পানশালায় অথবা জুয়াখানায়। এসব দরিদ্র এলাকাগুলোর রাস্তা ধরে মাঝে মধ্যে হাঁটি আর ভাবি পুঁজিবাদী সমাজের অসহায় শিকার এই লোকগুলো। সরকার এদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য কমিউনিটি সার্ভিসের ব্যবস্থা করছে ঠিকই কিন্তু তাদের জীবন ধ্বংসকারী পুঁজিবাদী এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করছে না।

এসব এলাকার মেয়েগুলো পড়াশুনা শেষ হবার আগেই অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়ে, বাচ্চার জন্ম দিয়ে মহানন্দে চাইল্ড বেনিফিটসহ অন্যান্য ভাতা পেয়ে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা কাটিয়ে দেয় বাচ্চার পুশ চেয়ার ঠেলে এবং নতুন নতুন বয়ফ্রেন্ড ধরার প্রচেষ্টায় সস্তা মেকাপের চর্চায়। তাদের বাচ্চারা বড় হয় একটা অনিশ্চিত পরিবেশে যেখানে মায়ের জীবনসঙ্গী বারবার বদলায়, মা হয়তো জড়িয়ে পড়ে কোনো অপরাধীর সাথে। জন্ম হয় আরো একটি শিশুর যাকে মায়ের সাথে বারবার কারাগারে যেতে হয় বাবাকে দেখতে।

এই আলোচনাকে আপাত দৃষ্টিতে কষ্টকল্পিত মনে হতে পারে, কিন্তু আমার এদেশে বসবাসের এবং কাজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমি মানুষের সামাজিক দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে পুঁজিবাদী সমাজের ফুলে ফেঁপে ওঠা আর গর্তে-পড়া মানুষগুলোর জীবনের চির-আবর্তিত সংঘাতের সংযোগ স্পষ্টভাবে দেখতে পাই।

সেদিন কারাগারের ওয়েটিং রুমে ময়লা কাপড় পরা হাতে চকলেট অথবা মুখে ডামি ধরা বাচ্চাগুলোকে দেখে ভাবছিলাম, যার শৈশব কাটে বাবাকে জেলে ভিজিট করে, যার মধ্য-সকালের স্ন্যাক চকলেট, যার সাথে অপেক্ষারত মা তার নাকের সর্দি পরিষ্কারের চেয়ে নিজের নখ ফাইলিং নিয়েই বেশি ব্যস্ত এই কারাগারই যদি হয় সেই শিশুর ভবিষ্যত ঠিকানা আমি ব্যথিত হবো কিন্তু অবাক হবো না।

 

 

5360 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।