এখন যা লিখবো তার জন্য বিস্তর মন্দ কথা শুনতে হবে জানি- তবু লিখতে মন চাইছে। গত তিন/চার দিনে দুই বাংলায় দু’টো ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা ঘটলো যা নিয়ে দুই বাংলার ফেসবুক তোলপাড়। এই দুই ঘটনার কি কোথাও কোনো যোগসূত্র আছে?
একটি তো হলো সেই ওপারে মেট্রো রেলে এক তরুণ যুগলের আলিঙ্গনে বিরক্ত কিছু প্রৌঢ় ও বৃদ্ধের তাদেরকে প্রহার করা ও তার পক্ষ-বিপক্ষে নানা মতামত।
আর একটি ঘটনা ঘটলো বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। নবম শ্রেণির এক ছাত্রী ফেসবুকে মাত্র এক মাসের পরিচয়ে পাশাপাশি বয়সের এক কিশোরের সাথে প্রথমে এক রেস্তোরাঁয় খেতে যায়। সেখান থেকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যায়। রাত ন’টাতেও বাসায় মা যখন খুঁজে পায় না, তখন সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। পরের দিন পতেঙ্গা সি বিচে মেয়েটির ধর্ষিত লাশ পাওয়া যায়।
মেয়েটির ছবি এবং মেয়েটির থেকেও অপরাধী ছেলেটির ছবি দেখে আমি বেশি হতভম্ব হয়ে গেছি। মেয়েটি রোগা- খুব রোগা। ঠিকঠাক বয়সে পড়লে নবম শ্রেণির ছাত্রীর বয়স বছর ১৩-র বেশি হবার কথা নয়। আর যদি এক/দু’বছর বেশি বয়স করে পড়ে, তবে ধরলাম সর্বোচ্চ ১৫-র বেশি বয়স নয়। খুবই রোগা আর চোখে পুরু চশমা মেয়েটির। ছেলেটির বয়সও খুবই কম। মুখে এখনো ভাল করে গোঁফ ওঠে নি। ছেলেটির বয়সও ১৬-১৭-এর বেশি মনে হচ্ছে না।
কথা হচ্ছে- কি এমন হলো গত কয়েক দশকে যে ১৩-১৭-এর ছেলে-মেয়েদের ফেসবুকে এক মাসের পরিচয়ে ডেট করতে হবে? ডেট তো ডেট যেতে হবে সন্ধ্যার পর পতেঙ্গা সি বিচে এবং তারপর ধর্ষিত হতে হবে? খুন হতে হবে? আমি মর্যালিটি বা নীতি পুলিশ কি ভ্যালু জাজমেন্টে যাচ্ছি না। কিন্ত আমার খুব অসহায় লাগছে। কেনো? একটি ১৩-১৭ বছরের ছেলে বা মেয়ে স্কুলে ভলিবল কি ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হবার স্বপ্ন দেখবে, গল্পের বই পড়বে, ছবি আঁকবে, সায়েন্স ফিকশনের চরিত্রদের নিয়ে ভেবে ভেবে সারা হবে- দু’চোখে দেখবে কত কি করার স্বপ্ন!
আমরা, কিছু শিক্ষা ও রুচিহীন সহসা বিত্তের মালিক বাবা-মায়েরা (ক্ষমা করবেন ভাষার জন্য) ঘরে ঘরে ছেলে-মেয়েদের হাতে স্মার্ট ফোন-ট্যাব-হাত খরচের অঢেল টাকা আর কয়েকজন টিউশনি মাস্টার বা কোচিং সেন্টারের ফি দিয়ে কি তৈরি করছি? পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের প্রশ্ন ব্যাংকে রাইট/ক্রস চিহ্ন দেবে আর মুখস্থ বমি ওগড়াবে আর মাথায় থাকবে শুধু সেক্স? এ কোন্ দুনিয়া?
অসংখ্য স্যাটেলাইট চ্যানেলে ইংরেজি মিউজিক চ্যানেল আর বলিউডের উত্তেজক যত আইটেম গান, হিন্দি-তামিলসহ দুনিয়ার নানা পর্ণ ও সেমি-পর্ণ ছবি...শিশুদের ফেসবুকে ঢোকার নির্দিষ্ট বয়স নেই... লাগামছাড়া একটা দুনিয়া যেখানে পারলে জন্মের পর থেকেই সেক্স করতে শুরু করো সবাই! ক্ষমা করবেন- পতেঙ্গার ঘটনার পর থেকে মাথার ঠিক নাই আমার! আমার নিজের নবম শ্রেণি পড়া মফস্বল জেলা শহরের জীবনটা ভাবি। ‘খেলাঘরে’ আমার বিতর্ক দলের কয়েকজন বন্ধু ছিলো। জয়, সৌমিত্র, লিটু ভাই আর বাদল ভাই। চারজন আমরা এক/দু’বছরের সব ছোট-বড়। বিতর্ক করছি, রুশ বই পড়ছি অনুবাদে, কারপভ দাবায় ভালো না কাসপারভের জেতা উচিত...এসব নিয়ে তর্ক করছি! রঞ্জিতা জারি গান গাইছে, লিটু ভাইয়ের ছোট বোন লাকি ছবি আঁকছে। ডেটিং, সেক্স, সি বিচ? কল্পনার বাইরে ছিলো!
এখন আমাকে বলতে পারেন আমি মধ্যবয়সী- আমি নীতি পুলিশ- ঠিক আছে, আমি নীতি পুলিশ- ১৩-১৭-এর কপোত/কপোতী সি বিচে গেছে- ধরে পিটান দেয়া দরকার! কি হবে? মেয়েটির জীবন তো শেষ হয়ে গেলো।
এবার আসি কলকাতার মেট্রো রেল। হ্যাঁ- জানি যুক্তিগুলো। রাস্তায় ছেলেরা ইউরিনেট করলে চুমু খাওয়া যাবে না কেনো? আলিঙ্গন করা যাবে না কেনো? এসব নিয়ে ট্যাবু থাকলেই বরং শিশু ধর্ষণ হবে! রাস্তায় ইউরিনেট আমাদের মতো দেশগুলোয় হয় পথে-ঘাটের সার্বিক ভৌত অবকাঠামো শোচনীয় বলে। অনেক ভালো মানের পাবলিক টয়লেট থাকলে এটা হতো না। এছাড়া শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে মেয়েরা কিছুটা এগিয়ে এলেও পরিবহন থেকে রাস্তা-ঘাট বা বাজার...সবকিছু নির্মাণের সময় নীতি নির্ধারকদের মাথায় ‘নারী’ বলে বস্তটিরও যে কিছু দৃশ্যমানতা আছে, তা’ ভাবা হয় না আমাদের মত দেশগুলোয়। এখন আমেরিকায় ছেলে-মেয়েরা ট্রামে-বাসে জড়িয়ে ধরে বা চুমু খায় বলে (আমি জানি না সেটা করে কিনা- আমার দুই দিদি বৃটেন থেকে ফিরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলেছিলো ওদেশে কাপল নারী-পুরুষ না হলে অচেনা নারীর পাশের সিটে বসার থেকে একজন পুরুষ বরং দূরের একটা সিটে বসে, না, সেটা আমার দুই দিদি ব্রাউন বা বাদামি নারী বলে পাশে বসেনি তা’ নয়- সাদা নারীও অচেনা হলে সাদা পুরুষ একদম গা ঘেঁষে বসে না, দূরে অন্য সিট থাকলে সেখানে গিয়ে বসে)। একদিকে শিশু ধর্ষণ আর একদিকে শুরু হলো ‘হোক আলিঙ্গন আর হোক চুম্বন”- ওদিকে পতেঙ্গার সি বিচে কিশোরীর লাশ।
ভালো লাগছে না। সুন্দরবন হোক আর দন্ডকারণ্য কি আমাজনের জঙ্গল হোক- কোথাও পালিয়ে যাবো ভাবছি। উঁহু- বাঙ্গাল তো- প্রমিত বাংলায় মনের ভাব প্রকাশ হলো না। ঝেড়ে কাশি। আমার মাথা ভালো লাগতেছে না। ভাবতেছি সুন্দরবন হোক, দন্ডকারণ্য কি আমাজনের জঙ্গল- কোথাও না কোথাও পালায় যাবো। পালায় আমি যাবোই!