জেসমিন চৌধুরী

প্রবাসী, সমাজকর্মী

আমার একটি দীর্ঘ মি-টু

আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমাদের ক্লাসরুম ছিলো স্কুলের পেছন দিকের একটা বিল্ডিং এর দোতলায়, পেছনের জানালা দিয়ে তাকালে কচুরিপানায় ঢাকা একটা দিঘী দেখা যেত। রাশি রাশি বেগুনী ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ঐ জানালার পাশে বসে টিফিন খাওয়া ছিলো আমাদের প্রতিদিনের একটা বিশেষ আনন্দের কাজ।

কিন্তু এক শরতের দুপুরে আমাদের ঐ বেগুনী স্বর্গ কলুষিত করলো এক ঘৃণ্য দানব। বান্ধবীদের চেঁচামেচি শুনে জানালার কাছে ছুটে গিয়ে দেখি একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে জানালার ঠিক নীচে দিঘির পাড়টায়। তার একহাতে লুংগির একটা কোণা উঁচু করে ধরা, এবং অন্য হাতে সে পাগলের মতো খিঁচে চলেছে তার দাঁড়িয়ে যাওয়া পুরুষাঙ্গ। মুখে কুৎসিত হাসি।

আমি এতোটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম যে কয়েক মুহুর্তের জন্য চোখ ফেরাতে বা নড়তেও পারিনি। একটা মানুষ আমাদেরকে বাধ্য করলো তার সবচেয়ে গোপন অঙ্গের দিকে তাকিয়ে থাকতে, অথচ এতোগুলা মেয়ের মধ্যে কেউ সাহস পেলাম না কাউকে ডেকে আনতে, কারণ আমাদেরকে শেখানো হয়নি কীভাবে এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়।

অনেকে ভাবতে পারেন শুধুতো দেখিয়েছে, আর তো কিছু করেনি। অন্যদের কথা ঠিক জানি না, কিন্তু আমি সেদিন চরম অপমান বোধ করেছিলাম, নির্যাতিত বোধ করেছিলাম। তারপর বাকিটা সময় ক্লাসে মন দিতে পারিনি, বাসায় ফিরে নামাজ পড়িনি, বিকেলে বন্ধুদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতে যাইনি। আমার উদ্বিগ্ন মায়ের প্রশ্নের কোনো উত্তরও দিইনি, কারণ তার আগেই এসব বিষয় বুঝতে বা শারিরীক ও আবেগিক শ্লীলতাহানী থেকে আমাকে বাঁচাতে আমার মায়ের অক্ষমতার কথা আমি জেনে গিয়েছিলাম।

সে রাতে ঘুম না আসা পর্যন্ত আমি ভীষণ কেঁদেছিলাম, নিজেকে খুব একা ও নিঃস্ব মনে হয়েছিলো। এই বিশাল পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যাকে নিজের এই অপমানের কথা বলতে পারি, যে বুঝবে। আমি যে সমাজে বেড়ে উঠছি সেই সমাজ আমাকে এই নির্ভরতা, এই নিশ্চয়তার অনুভূতি দেয় নি। কার উপর জানি না কিন্তু প্রচন্ড রাগে ফুঁসছিলাম আমি। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো আমি এবং আমার ক্লাসের মেয়েরা একজন নোংরা মনের পুরুষের দ্বারা দৃষ্টি-ধর্ষনের শিকার হয়েছি।  

যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম নয়। আরো ছোটবেলায় এর চেয়েও অনেক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, এবং অন্য মেয়েদেরকেও এর মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছি। তার সবগুলো এখানে আলোচনা করে বিকৃতমনাদের সুড়সুড়ি পেতে সাহায্য করতে চাই না, শুধু একটার কথাই বলবো।

প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস ওয়ানে  আমাদের একজন অংকের শিক্ষক ছিলেন যিনি মেয়েদেরকে পালাক্রমে কোলে বসিয়ে তাদের শরীরের নানান জায়গায় হাত বুলাতেন। ফর্সা কিউট চেহারার মেয়েগুলোর প্রতি তার আগ্রহ ছিলো বেশি। তিনি যখন একটা মেয়েকে ডেকে কোলে বসাতেন, আমরা বাকিরা জানতাম মেয়েটার সাথে কী ঘটছে এবং দুরুদুরু বুকে নিজের পালা আসার অপেক্ষা এবং না আসার প্রার্থনা করতাম, যদিও জানতাম আজ না হোক কাল আমাদের প্রত্যেককেই তার কোলে গিয়ে বসতে হবে।  

আমি স্কুলে যেতে চাইতাম না। আব্বা-মা জোর করে, এমনকি অনেক সময় মারধোর করেও আমাকে স্কুলে পাঠাতেন কিন্তু আমার না যেতে চাওয়ার কারণ সচরাচর জানতে চাইতেন না। একদিন আমি ভয়ানক জেদ ধরলাম আমি আর কখনোই স্কুলে যাব না, নিজেকে বাঁচানোর আর কোনো পথ আমার জানা ছিলো না। মা কারণ জানতে চাইলে আমি বললাম আমার অংকের শিক্ষক খুব খারাপ মানুষ। মা জিজ্ঞেস করলেন তিনি এমন কী খারাপ কাজ করেছেন যে তুমি স্কুলে যাওয়াই ছেড়ে দেবে?

আমার খুব ইচ্ছে হলো মাকে সব খুলে বলি, আমাদের প্রতিদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলে মাকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদি কিন্তু এরকম বিশ্রী একটা অভিজ্ঞতার কথা কীভাবে বলতে হয় আমি জানতাম না, আমার জিহ্বা জড়িয়ে গেলো। মা জোরে একটা ধমক দিলে আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘উনি আমার স্লেটে পেশাব করে দেয়’। এমন আজব একটা কথা আমার মুখে কেনো এলো জানি না, কিন্তু মা আমাকে কষে একটা থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘শিক্ষকদের সম্মান করতে হয়, তাদের কথা মিথ্যা বলতে হয় না’। 

আমাকে আবারও জোর করে স্কুলে পাঠানো হলো। আমার বন্ধুদের আর আমার জীবনে শিক্ষকের আদরের অত্যাচারও নির্বিঘ্নে চলতে থাকল আমরা ক্লাস টুতে উঠা পর্যন্ত। তখন আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।   

কিন্তু এই আতঙ্ক আমার জীবনে আবার ফিরে এলো কয়েক বছর পর যখন আমি প্রাইমারী বৃত্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। একদিন আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, আমাকে সাহায্য করার জন্য একজন প্রাইভেট শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন, তিনি ছিলেন আমার ক্লাস ওয়ানের সেই অংকের শিক্ষক। আমার শরীরের প্রতি রক্তবিন্ধু হিমায়িত করে দিয়ে কালো দাঁড়ি আর জিন্নাহ ক্যাপ পরা মহান পুরুষ টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে বললেন, ‘তোমার মনে আছে ক্লাস ওয়ানে থাকতে তোমাদেরকে আমি কত আদর করতাম? মনে আছে কত মজা করতাম আমরা?’ বলে অসভ্য একটা হাসিতে ফেটে পড়লেন তিনি।

তারপর তিনি আরো কী কী বলে যেতে লাগলেন যার অনেকটাই আমার কানে ঢুকলো না কারণ ঐ মুহুর্তে আমার মনের চোখে ভিউমাস্টারের মতো ভেসে যাচ্ছিলো। সেই ক্লাস ওয়ানের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর গত কয়েক বছরে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া আরো অজস্র ‘মজা’ করার ঘটনা যার ঘটক ছিলেন বিভিন্ন আপন এবং পর পুরুষ। কাজের ছেলে, দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই, বাবার সাথে দেখা করতে আসা কোনো মুরব্বি পুরুষ, ইউরিন ইনফেকশনের জন্য পরামর্শদাতা মেডিসিনের শ্মশ্রুমণ্ডিত ডাক্তার- তালিকা অনেক লম্বা।

আমার মনে হলো আমি শ্বাস নিতে পারছি না, একটা প্রচণ্ড রাগ এবং অপমান বোধ আমার হৃদপিন্ডের কম্পনও থামিয়ে দিচ্ছিলো। এমন সময় আসরের আজান হলো, জিন্নাহ ক্যাপ অজু করতে উঠে গেলে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো আমার। এবং ঐ মুহুর্তে জীবনের সবচেয়ে সাহসী এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিলাম আমি। আব্বার সাথে কথা বলতে গিয়ে হাত পা কাঁপছিল আমার, তবু সাহস করে বললাম, ‘আমার প্রাইভেট টিচার লাগবে না, আমি একাই পড়তে পারব’।

আব্বা অজু করা ফেলে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন, কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কিন্তু আসরের নামাজের পর জিন্নাহ ক্যাপকে সফেদা গাছের হলদে হয়ে যাওয়া পাতার ছায়ায় মাথা নীচু করে আমাদের টিলা বাড়ির পথ ধরে নিচে নেমে যেতে দেখলাম। 

তার সাথে তিনি নিয়ে গেলেন সেই ছোট ভীতু মেয়েটিকে যে জানতো না কী করতে হবে, কী বলতে হবে। আমার বয়স তখন দশ, কিন্তু এই প্রথম আমি আমার প্রতি যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালাম, যদিও আমাকে কিছুই বলতে হয়নি। সম্ভবত আমার কম্পিত হাত পা এবং কন্ঠস্বরে কিছু একটা ছিলো যা থেকে আব্বা ঘটনাটা বুঝে গিয়েছিলেন।  

শুরু হলো আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। আমি ঠিক করলাম আর কখনো কোনো অন্যায় মেনে নেব না, নীরবে বা যুদ্ধ ছাড়া তো নয়ই। আমার প্রতি যৌন নির্যাতনের জন্য লজ্জিত বোধ করবো না আমি। এ অপরাধ আমার নয়, এসব গোপন রাখার দায়িত্বও আমার নয়। গোপন রাখবে যে নির্যাতন করে সে, আমি কেনো? নিজেকে তো বটেই, নিজের আশেপাশের অন্যদেরকেও রক্ষা করব বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম। সেই সাথে শুরু হলো আমার যুদ্ধময় পরবর্তী জীবন।  

ঈদের বাজারের ভীড়ে গায়ে হাত দেবার জন্য পাঁচ কেজি ডানোর টিন দিয়ে ভদ্র কাপড় পরা একজনের মাথায় বাড়ি মেরেছিলাম একবার। আমার এবং তার দু’জনেরই ভাগ্য ভালো সে মরে যায়নি। মাটিতে পড়ে গিয়ে আবার উঠে পালিয়েছিলো। বৃষ্টির দিনে পলিথিন দেবার ছলে বুকে হাত দেবার জন্য রিক্সাওয়ালাকে পিটিয়েছি একবার। এই দুই ঘটনাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন অনেকে, কেউ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন নি কী হয়েছে? আমি যখন রাগে অন্ধ হয়ে রিক্সাওয়ালাকে পিটাচ্ছিলাম তখন ভীড়ের মধ্য থেকে একজন পুরুষ এগিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘আর বাদ দিন, অনেক তো মারলেন’।  

আমার ধারণা এসব কাউকে বলতে হয় না। একটা মেয়ে একটা পুরুষকে খোলা বাজারে পিটাচ্ছে দেখলে মানুষ ঠিকই বুঝে যায় কী ঘটেছে। যে দেশে পকেট মারকে পিটিয়ে মেরে ফেলে মানুষ, সেই দেশে প্রকাশ্যে নারীকে নির্যাতন করার জন্য একজন পুরুষকে কেউ কিছু বলে না কারণ স্বগোত্রীয়র জন্য সমবেদনা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।  

এর আগে এবং পরে পথে ঘাটে ঘরে বাইরে আরো অনেক ছোটখাটো যুদ্ধ লড়েছি এবং জিতেছি। আমি জানি সারা পৃথিবী জুড়ে নারী, শিশু এবং দুর্বলের উপরে প্রতিনয়ত ঘটতে থাকা ভয়াবহ সব নির্যাতনের কাছে আমার এসব অভিজ্ঞতা কিছুই নয়।

এই পৃথিবী বড় অনিরাপদ একটা জায়গা। এখানে নিজের কাজে কর্মে বেরিয়ে মেয়েরা ধর্ষনের শিকার হয়, এমনকি প্রাণও হারায়, গণ ধর্ষণের শিকার হয় পাঁচ বছরের শিশু, ছোট ছোট বাচ্চারা ধারে কাছের পুরুষের হাতে নির্যাতিত হয় কিন্তু কাউকে বলার ভাষা খুঁজে পায় না।

আমি নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখছি যৌন নির্যাতন নিয়ে আমাদের সমাজের নীরবতা আর গোপনীয়তার প্রতিবাদে। আমি সেই মায়েদের ধিক্কার জানাই যারা জেনেশুনেও সামাজিক কলংকের ভয়ে নিজের সন্তানের নির্যাতনকারীর পরিচয় গোপন রাখেন। আপনারা যে যাই বলুন, শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন গোপন রাখার জন্য কোনো কৈফিয়তই উপযুক্ত নয়।

বিকৃত যৌনতা একটা রোগ, একটা প্রবৃত্তি যা থেকে মানুষ কখনোই পুরোপুরি মুক্ত হবে না, যৌন নির্যাতন ঘটবেই কোথাও না কোথাও। কিন্তু আমি চাই সমাজে সেই দিন আসবে যখন নির্যাতন নিয়ে কথা বলা লজ্জার বিষয় থাকবে না, যখন শিশুদেরকে স্বর্গবাসী করার জন্য আয়াত আর শ্লোক মুখস্ত করানোর পাশাপাশি যৌন নির্যাতন থেকে বেঁচে থাকার উপায়ও শেখানো হবে, এরকম কিছু ঘটলে মাবাবাকে বা বড় কাউকে বলার আস্থা শিশুর মধ্যে গড়ে তোলা হবে। সেইদিন হয়তো আমি দেখব না। ‘কুমীর আর কচ্ছপ দেখবে, তারা অনেক দিন বাঁচে’।

 

পূর্বে অন্য শিরোনামে এবং বর্ধিত পরিসরে লেখকের ‘নিষিদ্ধ দিনলিপি’ বইতে সংকলিত।

 

39319 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।