জেসমিন চৌধুরী

প্রবাসী, সমাজকর্মী

ধূমপান- স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, না নারীর জন্য?

এক বন্ধুর অনুরোধে আজ একটা কুরুচিপূর্ণ ভিডিও দেখে মনে হলো শুধু ঢেঁকি নয়, কে যেন একটা পুরা রাইস মিল আমার মুখে ঠেসে দিয়েছে এবং অনুরোধের মুখে সেটা আমাকে গিলতেও হচ্ছে।  

এই ভিডিওটা কারা বানিয়েছে জানি না, কিন্তু কেনো বানিয়েছে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। ভিডিওতে উপস্থিত সব নারীর পরনে হিজাব, শুধু একজন বাদে এবং সেই একজন হিজাববিহীন নারী প্রকাশ্য দিবালোকে পাবলিক প্লেসে বসে নির্বিকারভাবে সিগারেট ফুঁকছে। আশেপাশের লোকজন নিন্দার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে, তাকে মন্দ বলছে। এর মধ্যে একজন যুবক উঠে গিয়ে মেয়েটিক চ্যালেঞ্জও করে বসলো, ‘আপনি সিগারেট খান এতে আমার কোনো সমস্যা নেই, প্রকাশ্যে কেনো খাবেন?’

 

উত্তরে মেয়েটা বললো, ‘আপনিও তো খাচ্ছেন’।  

ছেলেটা বললো, ‘আমি চাইলে এখানে আমার শার্ট খুলে ফেলতে পারবো, আপনি পারবেন?’

সেইসাথে ‘লেডিস ফার্স্ট, বাসে নারীদের জন্য আলাদা সিট থাকা’ সহ আরো অনেকগুলো ইস্যুকে মেয়েদের প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়ার বিরুদ্ধে যুক্তি হিসেবে এতো দুর্বলভাবে টেনে আনা হলো যে আমার মনে হলো রাইসমিলটা গলা অতিক্রম করে আমার মগজে ঢুকে মগজকে ভর্তা বানিয়ে দিচ্ছে। ইচ্ছে হলো ভিডিওটা বন্ধ করে দেই।   

ভিডিওর যুবকটির সমবয়েসী হবে আমার বড় ছেলে। সে পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিলো,

‘কেনো এসব আবর্জনা দেখে তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট করছো মা?’

‘এক বন্ধু অনুরোধ করেছেন এটা দেখে একটা প্রতিবাদ লিখতে হবে’। 

‘প্লিজ মা এসব নিয়ে লিখো না। এতো নিম্নমানের একটা ভিডিও নিয়ে লেখা মানেই একে গুরুত্ব দেয়া। এর কোনো মানে হয় না’।

কিন্তু বন্ধু নাছোড়বান্দা, আমাকে লিখতেই হবে। বন্ধুটির ব্যাকুলতার কারণ আমি বুঝি। এই নিম্নমানের ভিডিওটি দেখবে অনেকেই, তাদের মনে কিছুটা হলেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে এই ভিডিও, মেয়েদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠবে আরো সংকীর্ণ। কাজেই এর প্রতিবাদে কিছু বলা প্রয়োজন।

কিন্তু এই বিষয়ে কিছু লিখতে গিয়ে নিজের ভাষাকে অপ্রতুল মনে হচ্ছে আমার কাছে। ভাবনাগুলোই গোছাতে পারছি না। পাগলের সাথে তর্ক করা কি সহজ?  

প্রথমত, আমার কাছে মনে হয়েছে এই ভিডিওর মূল মেসেজ হচ্ছে- হিজাব পরুন, ভালো মেয়ে হোন। এখানে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে হিজাববিহীন মেয়ে মানেই খারাপ কারণ ভিডিওর একমাত্র হিজাববিহীন মেয়েটি সিগারেট ফুঁকছে যা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। আমার ধারণা ভিডিওটা মৌলবাদীদের দ্বারা প্রসূত এবং এর মূল উদ্দেশ্য হিজাবের প্রমোশন। হিজাব পরলেই মেয়ে ভদ্র, না পরলেই অসভ্য। ব্যক্তিগতভাব হিজাব পরা বা না পরা কোনোটার প্রতিই আমার কোনো এলার্জি নেই, কিন্তু যারা হিজাব পরে না তাদেরকে খারাপ মেয়ে হিসেবে উপস্থাপন করাকে আমার কাছে ভীষণ অসভ্যতা বলে মনে হয়।    

দ্বিতীয় মেসেজটি হচ্ছে সিগারেট খেলে লুকিয়ে খাবেন। এই ভিডিওটি আমাদের সমাজে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি ধারণার প্রতিধ্বণি মাত্র- সিগারেট খাওয়াটা চরিত্রের পরিমাপক শুধুমাত্র নারীদের জন্য। এখানে বলা হচ্ছে সিগারেট খাওয়া যতটা খারাপ, মেয়েরা সিগারেট খাওয়া তার চেয়েও খারাপ। মেয়েরা  গোপনে সিগারেট খাওয়া যতটা খারাপ, প্রকাশ্যে খাওয়া আরো খারাপ।  

ধূমপান নিঃসন্দেহে একটা মারাত্মক ক্ষতিকর অভ্যাস। ধূমপান জনিত রোগের কারণে প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটে, কাজেই নারী-পুরুষ সকলেরই উচিত ধূমপান থেকে বিরত থাকা। আর এই গবেট কী না বলছে, ‘আপনি সিগারেট খান তাতে আমার সমস্যা নেই, প্রকাশ্যে কেনো খাবেন?’ তার অর্থ হলো মেয়েরা ঘরের ভেতরে আড়ালে আবডালে সিগারেট খেয়ে অসুখ হয়ে মরলে ক্ষতি নেই, কিন্তু প্রকাশ্যে খেয়ে ছাগুমার্কা পুরুষগুলোর ইগোতে আঘাত না দিলেই হলো। মেয়েরা গোপনে সিগারেট ফুঁকুক, পুরুষরা গোপনে তাদের কাপড় খুলুক- সব ঠিক আছে, শুধু প্রকাশ্যে মেয়েদেরকে হিজাবমোড়া পুতুপুতু ভালো মানুষটি হয়ে থাকতে হবে। হিপোক্রেট আর কাকে বলে?

ভিডিওর শেষের দিকে দেখা যাচ্ছে মেয়েটার বন্ধুদের সাথে বসে সিগারেট খাওয়ার একটা মুহুর্তের ভিডিও বানিয়ে অনলাইন ছেড়ে দিয়েছে ছেলেটা এবং সেটা ভাইরাল হয়ে গেছে। তার মানে এই ভিডিওর নির্মাতারা বিনা অনুমতিতে একটা মেয়ের ভিডিও বানিয়ে অনলাইন শেয়ার করতে উৎসাহ দিচ্ছেন যুবকদেরকে। এতে যে অন্যের প্রাইভেসির প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো হয় এতোটুকু জ্ঞানও যাদের নেই তারাই আবার সমাজ-সংস্কারকের ভূমিকায় নেমেছে। শতাব্দীর সেরা কৌতুক।

এই ভিডিওটি নিঃসন্দেহে আমার দেখা সবচেয়ে জাজমেন্টাল এবং হিপোক্রেটিক প্রোডাকশনগুলোর একটি। এতে উপস্থাপিত সবগুলো মেসেজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমি বলব –বাসে আলাদা নারী-সিট থাকা বা ‘লেডিস ফার্স্ট’ জাতীয় সৌজন্যের প্রদর্শন সমাজে নারী-পুরুষ সমতার পরিচায়ক নয়, বরং তার উলটোটাই প্রমাণ করে।   

-চাইলে হিজাব পরুন, সেই স্বাধীনতা সবারই রয়েছে কিন্তু হিজাব কখনোই কারেকটার সার্টিফিকেট হতে পারে না।

-সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, নারীর জন্য নয়।

-সিগারেট শরীরকে পচায়, সমাজকে নয়।

-সিগারেট গোপনে খেলে শরীরের যতটুকু ক্ষতি হয়, প্রকাশ্যে খেলেও ঠিক ততটুকুই হয়।

-খারাপ অভ্যাসের চর্চা লুকিয়ে না করাই ভালো, এতে করে চর্চার মাত্রা বাড়বে, ক্ষতির মাত্রাও বাড়বে।

-এই ভিডিওর নির্মাতারা নিরেট গাধা কিন্তু তাদেরকে গাধা বললে গাধাদেরও অপমান হয়।

শেষ কথাঃ আপনি নারী হোন অথবা পুরুষ, ধূমপান হতে বিরত থাকুন। প্রকাশ্যে অথবা গোপনে, কোনোভাবেই ধূমপান করে নিজের জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে আনবেন না। ধূমপায়ীদের আয়ূ অধূমপায়ীদের চেয়ে গড়ে দশ বছর কম হয়।  

3869 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।