মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার

মুক্তচিন্তক ব্লগার গোলাম সারওয়ার নিজেকে আড়ালে রাখতেই বেশি পছন্দ করেন।

ধর্ষণের প্রতিকার বিষয়ে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর জরুরি

বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বলতে আমরা বুঝি যে সকল ঘটনা পত্রিকায় আসে। সেই হিসাবে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বছরে ঘটে ১৫০০ - ১৮০০ টির মতো (যদিও বিভিন্ন উৎস বিভিন্ন সংখ্যা দিয়ে থাকে)।

পৃথিবীর সবচাইতে নারীবান্ধব দেশগুলোর একটি হচ্ছে সুইডেন সেখানে ২০১৬ সালের ধর্ষণের ঘটনা হচ্ছে প্রায় ৭২০০ টি (যদিও সুইডেনের ধর্ষণের সংজ্ঞা অনেক বিস্তৃত। এখানে ধর্ষণ মানে শুধু যৌন সঙ্গমকেই বোঝায় না, নারীর অনুমতি ব্যতিরেকে নারীকে যেকোনো ধরণের শারীরিক যৌনতায় অংশ নিতে বাধ্য করাই এখানে ধর্ষণ। এখানে প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনা কে একটি রেইপ ইন্সিডেন্স বা একটি আলাদা অপরাধ হিসাবে ধরা হয়, সেই হিসাবে এমনও হয়েছে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেছে যেখানে হয়তো নব্বুই বার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেই নব্বুই বারের ঘটনা টিকে আলাদা আলাদা ধর্ষণ হিসাবে নথিবদ্ধ করা হয়, গ্যাং রেইপ বা দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা গুলোতে ভিক্টিম একজন হলেও মামলা হয় প্রতিটি ধর্ষকের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা ভাবে অর্থাৎ বাংলাদেশে যেখানে একটি গণধর্ষণের ঘটনায় একটি মামলা হয়, সুইডেনে সেখানে হয়তো ছয়টি মামলা হয়... ইত্যাদি )।

আমাদের রাজনীতিবিদেরা নিশ্চয়ই এই পরিসংখ্যান লুফে নেবেন। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে সারা পৃথিবীতেই ধর্ষণের সংখ্যাটি আসলে একটা বিরাট "রিপোরটিং বায়াস" এর উদাহরণ। অর্থাৎ ধর্ষণের ঘটনার যে সংখ্যাটি আমরা জানি তার চাইতে কয়েকগুন বেশী হচ্ছে প্রকৃত ঘটনার সংখ্যা। প্রকৃত ঘটনার সংখ্যার চাইতে প্রকাশিত ঘটনার সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশে এটা ভয়াবহ রকমের কম।

বাংলাদেশে প্রকাশিত ধর্ষণের ঘটনা হচ্ছে গড়ে বছরে ১৬০০ কিন্তু প্রকৃত ধর্ষণের ঘটনা নিশ্চিত ভাবেই কয়েক লক্ষের কাছাকাছি হবে। আমরা যারা অনলাইনে ধর্ষণের বিরোধিতা করছি তাদের মাঝে বোঝাপড়া ও মতামতের পার্থক্য আছে। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান ওয়ালা মানুষেরা জানেন, সারা দুনিয়াতেই এবং বাংলাদেশেও বেশীর ভাগ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চেনা মানুষের দ্বারাই। বন্ধু, প্রেমিক, স্বামী, কাজিন, মামা, চাচা, খালু, দুলাভাই, এমন কি বাবা'র দ্বারাও ঘটেছে এই সকল ঘটনা গুলো।

ধর্ষণ নিয়ে যারা সিরিয়াস চিন্তা করতে চান, কাজ করতে চান, বদলাতে চান পরিস্থিতি, তাদেরকে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। তাঁর কয়েকটি এখানে দিচ্ছি। কারো কাছে কি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আছে?

১। ধর্ষণ এর মতো আচরণের চালক শক্তিটা কি? প্রবৃত্তি? নাকি সুযোগ? নাকি সাংস্কৃতিক শিক্ষা? রাজনৈতিক ক্ষমতা? নাকি পুরো বিষয়টা কেবলই পুরুষের দন্ড?

২। কেনো বেশীরভাগ ধর্ষণের ঘটনা এই কাছের মানুষদের দ্বারাই ঘটে?

৩। সাম্প্রতিক কালের যে কয়েকটি বীভৎস ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে তা্র অনেক গুলোর সাথে পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করেছে, উল্টো ভিক্টিমকেই ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, এটা কেনো ঘটে?

৪। ধর্ষিতা ও তাঁর মায়ের চুল কেটে রাস্তায় ঘোরানো হয়েছে, বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতা- কর্মীরা তা নিয়ে উৎসব করেছে। আমাদের সমাজ এই উৎসব দাঁড়িয়ে দেখেছে। কেনো আমাদের সমাজ এই ধরণের উৎসব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে?

৫। প্রতিবছর যে কয়েক লক্ষ ধর্ষণের ঘটনা কখনই কোনো পত্রিকায় আসে না সেই সকল ঘটনার অপরাধীকে কিভাবে শাস্তির দ্বারস্থ করবেন? কোনও ব্যাখ্যা বা প্ল্যান আছে আমাদের?

৬। কেনো বাংলাদেশের শিশু, কিশোরী, তরুনী এবং পরিনত বয়স্ক নারীরা তাদের কাছের মানুষের কাছ থেকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ করেন না?

৭। কিভাবে বাংলাদেশের নারীদের তাদের উপরে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের ঘটনা রিপোর্ট করার হার বৃদ্ধি করা যাবে?

৮। কিভাবে বাংলাদেশের নারীদের তাদের উপরে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের ঘটনা রিপোর্ট করার হার বৃদ্ধি করা যাবে?

৯। আমাদের বিচার ব্যবস্থা ও আদালতের যে সেক্সিস্ট বা নারীর প্রতি বর্ণবাদী আচরণ আমরা প্রায়ই দেখি, বিশেষত ধর্ষণের মামলা বিষয়ে, তাঁর প্রতিকারের কোনো উপায় আছে? ধর্ষণ মামলা কি চুরি - ডাকাতির মামলার মতো? ধর্ষণ মামলা'র শুনানি যেভাবে হয়, তাঁর কি পরিবর্তন প্রয়োজন?

১০। ধর্ষণ ভিক্টিমের মেডিক্যাল পরীক্ষা যেভাবে হয় সেটা কতটুকু মর্যাদাকর নারীর জন্যে? এই তথাকথিত মেডিক্যাল রিপোর্ট নিইয়ে যে দুর্নীতি তার কারণগুলো কি? কারা এর সাথে জড়িত? কিভাবে এর পরিবর্তন সম্ভব?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা না থাকলে, আপনাদের সকল আন্দোলন আসলে পত্রিকায় প্রকাশিত খুব সামান্য সংখ্যক ধর্ষণ ভিক্টিমদের জন্যেই থাকবে (সেটাও দারুন জরুরি কাজ) কিন্তু দেশের লক্ষ লক্ষ কিম্বা তারও অধিক ধর্ষণ ভিক্টিমদের জন্যে নয়।

ফলে, আগামীতে পত্রিকায় বহুল আলোচিত ৪ - ৫ টি ধর্ষণ ঘটনার আসামীকে ক্রস ফায়ার করে মাঠ পর্যায়ের আওয়ামী কর্মীরা আমাদের কে বোঝাবেন... দেখেছেন আমরা ধর্ষণ কে কি পরিমান "জিরো টলারেন্স" করি? আমরাও সুখী চিত্তে আমাদের আন্দোলনের সাফল্য উপভোগ করবো। কিন্তু লক্ষ লক্ষ অপ্রকাশিত ধর্ষণের ঘটনা চলতে থাকবে আগের মতোই।

অবশ্য কিছু না করার চাইতে, আংশিক কিছু একটা করাও ভালো। সেই আংশিক আসলে কতটা ক্ষুদ্র ও অকার্যকর একটু ভেবে দেখুন।

1789 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।