যদি তুমি ভাবো, তুমি ধর্ষণের শিকার, তুমি দুর্বল, তবে দুর্বল হয়ে যাবে তোমারই মতো সহস্র লীলা, গীতা, মহিমা। যদি তুমি মনে করো তুমি ধর্ষণের শিকার, কিন্তু তুমি ন্যায়ের পথে হাঁটবে, তখনই তুমি ন্যায় করতে পারবে সেই লীলা, গীতা, মহিমাদের সাথে। নজির তুলে ধরবে, “ধর্ষণের শিকার মানে মানসিকভাবে ধর্ষিত নয়, ধর্ষণের শিকার মানে তুমি পঙ্গু নও, ধর্ষণের শিকার মানে তুমি হেরে যাওয়া, শেষ হয়ে যাওয়া, একেবারে ফুরিয়ে যাওয়া কোনো বস্তু নও। ধর্ষণ একটা অপরাধ, আর সেই অপরাধ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তোমাকে চলতে হবে।” তবেই সাহসের উজ্বল আলোকে ন্যায় পাবে ওরা, যারা ধর্ষণের শিকার হয়েও নিজের সম্মানের জন্য লুকিয়ে থাকতে নয়, বরং প্রকাশ্যে এসে লড়াই লড়তে চায়।
জিনিয়ার জীবনটা ভীষণ সহজ সরল ছিলো। সে স্বপ্ন দেখতো সুন্দরের, সুন্দর জীবনের, প্রেমের। বাচ্চামি, পাগলামি নিয়েই সে থাকতো প্রতিটা মুহূর্তে। হঠাৎ বদলে গেলো যেন জীবনটা। হাসি নয়, জিনিয়াকে ভয় গ্রাস করেছে। চোখে, মুখে যেন নিজেকে অপরাধী মনে করার ছাপ। জিনিয়া কারোর সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে না, যেটুকু বলছে, গলা কেঁপে কেঁপে উঠছে। জিনিয়া যে কখনো পুরুষ - নারী আলাদা করে দেখে নি, সবার সাথে অবাধে মিশেছে, খেলেছে, গেয়েছে, হঠাৎ করেই যেন পুরুষ দেখলেই, সে দূরে সরে যাচ্ছে। বাড়ির সবার মধ্যে থেকেও যেন সবার থেকে আলাদা একটা জগতের, যেন মনের ভিতরে সবকিছু তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। জিনিয়া ভয় পাচ্ছে।
কি এমন হয়েছে জিনিয়ার সাথে, যে সে ভয়ে কোকিয়ে উঠছে, কারোর সাথেই স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে না, মিশতে পারছে না! কি এমন হলো যে জিনিয়া কারোর সাথে স্বাভাবিকভাবে হাসতে পারছে না! কি এমন হলো যে সে ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে চাইছে, আড়ালে থাকতে চাইছে, যেন সবার সাথে মিশতে গেলেই পর্বত ভেঙে পড়বে তার ওপর!
আমি, লেখক সৌম্যজিৎ দত্ত আজ সেই মানুষটির সব থেকে কাছের বন্ধু, এবং এতটাই বিশ্বস্ত হতে পেরেছি যে মানুষটি আমাকে নিজের সেইসব অন্ধকারের কথা জানাতে পেরেছে নির্দ্বিধায়।
সাল ২০১৪ এর ডিসেম্বর মাস। জিনিয়া দিল্লীতে কাকুর বাড়িতে বেড়াতে গেছিলো। তখন জিনিয়ার বয়স বাইশ বছর। উৎসবের সময় তখন গোটা পৃথিবীতেই। দিল্লীও নতুন সাজে সেজে উঠছে। জিনিয়া আধুনিক মেয়ে, পার্টিতে যায়, নাচে, গান করে। মাঝে মধ্যে নেশাও করে। বাড়িতে কড়া পরিবেশের ভয় থাকলেও জিনিয়া বাইরের পরিবেশে বেশ সাবলীল। হঠাৎই সেদিন জিনিয়ার কাকাতো দাদা জিনিয়াকে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দেয়।
আধুনিক মানসিকতার হলেও, সকলের সাথে বন্ধুর মতো মিশলেও জিনিয়া এমন প্রস্তাবে হকচকিয়ে ওঠে। কে'ই বা এমন একটা পরিস্থিতির মুখে স্থির থাকতে পারে! জিনিয়া ভীষণ রেগে যায়। সটান থাপ্পড় চাপিয়ে দেয় সেই দাদাকে। পরিস্থিতি সামলাতে জিনিয়ার দাদা বলে, "সে মজা করছিলো।" এরপর জিনিয়াও ভাবে যে সে ভুল করেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো, তার দাদা মজাই করছিলো। এভাবে কোনো দাদা কি কখনো নিজেরই কাকাতো বোনকে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দিতে পারে! জিনিয়া ব্যাপারটা ভুলে যায়।
সেদিন ছিলো ৩১শে ডিসেম্বরের রাত। জিনিয়া ও তার দাদা এক নাইট ক্লাবে ঘুরতে যায়। সেই রাতে জিনিয়ার জন্য যে ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে, তা জিনিয়া কখনোই বুঝতে পারে নি। নাইট ক্লাবে গিয়ে জিনিয়া দেখে সেখানে তার দাদার বন্ধুরাও এসেছে। সবাই মিলে গানের সাথে নেচেছে। মদও খেয়েছে। হঠাৎই জিনিয়া দেখে সবদিক কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে! জিনিয়া অসুস্থ বোধ করতে থাকে সেই পার্টিতে এবং চেতনা হারায়। পরদিন যখন ঘুম ভাঙে, তখন জিনিয়া নিজেকে আবিষ্কার করে এক হোটেলরুমে একা, বিবর্ণ, বিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে। তার শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা। বিছানার চাদরে রক্ত লেগে। জিনিয়া বুঝতে পারে, তার সাথে কি হয়েছে। কিন্তু সে ভয় পায়। জিনিয়া ভয় পেয়ে যায় বাড়ির মানুষগুলোর জন্য। সে কাউকে কিছু জানাতে পারে না। সবার মাঝে থেকেও সবার থেকে সে আলাদা হয়ে যায়। ভেঙে পড়তে থাকে। মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাতে থাকে।
একজন বাইশ বছরের আধুনিক মেয়ে, যার পরিবেশ সম্পর্কিত সমস্ত চেতনা আছে, কিন্তু বাড়ির পরিবেশকে সে এতোটাই ভয় পায় যে সে তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাড়িতে প্রকাশ করতে পারে না। সে বলতে পারে না যে সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তারই দাদার কাছে। সে বলতে পারে না যে তার ন্যায় চাই। পরিবর্তে সে নিজেই অপরাধবোধে ভুগতে থাকে।
আর কতোদিন মেয়েরা নিজেদের সাথে হওয়া অন্যায়গুলো, অত্যাচারগুলো মুখ বন্ধ করে মেনে নেবে! আর কতদিন মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হলে নিজেদেরই অপরাধী ভাববে! আর কতদিন জিনিয়ার মতো মেয়েরা ধর্ষণকে মুখ বুজে সহ্য করবে! আর কতদিন সেইসব ধর্ষকেরা ধর্ষণ করে বেকুসুর খালাস পেয়ে যাবে?
আমি জিনিয়ার পাশে আছি। আমি জিনিয়ার পাশে থাকবো। আমি জিনিয়ার ভরসা হবো। ন্যায় দেবো জিনিয়াকে। আমি জিনিয়ার সমস্ত ভয়কে কাটিয়ে দেবো। ওকে বোঝাবো, অন্যায় ওর সাথে হয়েছে, ও কোনো অন্যায় করে নি।
তোমরা তোমাদের প্রতি হওয়া অন্যায়কে প্রকাশ করো। মুখ বন্ধ করে যতোদিন সহ্য করবে, অন্যায়কারীরা, ধর্ষকরা সমাজে ততো শক্তিশালী হয়ে উঠবে, ততো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তোমরা যদি ধর্ষণের শিকার হও, প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করে নিজের এবং সমস্ত নারীর সম্মানকে অক্ষুণ্ণ রাখার উদাহরণ তুলে ধরো।
বুঝিয়ে দাও “তুমি ধর্ষণের শিকার হলে, সেই লজ্জা তোমার নয়, সেই লজ্জা ধর্ষকের।”