সৌম্যজিৎ দত্ত

লেখক, ব্লগার, আইএসআই তে লেকচারার এবং গবেষণারত ছাত্র।

ধর্ষণ তোমার লজ্জা নয়, ধর্ষণ ধর্ষকের লজ্জা

যদি তুমি ভাবোতুমি ধর্ষণের শিকারতুমি দুর্বলতবে দুর্বল হয়ে যাবে তোমারই মতো সহস্র লীলাগীতামহিমা। যদি তুমি মনে করো তুমি ধর্ষণের শিকারকিন্তু তুমি ন্যায়ের পথে হাঁটবেতখনই তুমি ন্যায় করতে পারবে সেই লীলাগীতামহিমাদের সাথে। নজির তুলে ধরবে, “ধর্ষণের শিকার মানে মানসিকভাবে ধর্ষিত নয়ধর্ষণের শিকার মানে তুমি পঙ্গু নওধর্ষণের শিকার মানে তুমি হেরে যাওয়াশেষ হয়ে যাওয়াএকেবারে ফুরিয়ে যাওয়া কোনো বস্তু নও। ধর্ষণ একটা অপরাধ, আর সেই অপরাধ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তোমাকে চলতে হবে। তবেই সাহসের উজ্বল আলোকে ন্যায় পাবে ওরাযারা ধর্ষণের শিকার হয়েও নিজের সম্মানের জন্য লুকিয়ে থাকতে নয়বরং প্রকাশ্যে এসে লড়াই লড়তে চায়।

জিনিয়ার জীবনটা ভীষণ সহজ সরল ছিলো। সে স্বপ্ন দেখতো সুন্দরেরসুন্দর জীবনেরপ্রেমের। বাচ্চামিপাগলামি নিয়েই সে থাকতো প্রতিটা মুহূর্তে। হঠাৎ বদলে গেলো যেন জীবনটা। হাসি নয়জিনিয়াকে ভয় গ্রাস করেছে। চোখেমুখে যেন নিজেকে অপরাধী মনে করার ছাপ। জিনিয়া কারোর সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে নাযেটুকু বলছেগলা কেঁপে কেঁপে উঠছে। জিনিয়া যে কখনো পুরুষ নারী আলাদা করে দেখে নিসবার সাথে অবাধে মিশেছেখেলেছেগেয়েছেহঠাৎ করেই যেন পুরুষ দেখলেই, সে দূরে সরে যাচ্ছে। বাড়ির সবার মধ্যে থেকেও যেন সবার থেকে আলাদা একটা জগতেরযেন মনের ভিতরে সবকিছু তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। জিনিয়া ভয় পাচ্ছে।

কি এমন হয়েছে জিনিয়ার সাথেযে সে ভয়ে কোকিয়ে উঠছেকারোর সাথেই স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে নামিশতে পারছে না! কি এমন হলো যে জিনিয়া কারোর সাথে স্বাভাবিকভাবে হাসতে পারছে নাকি এমন হলো যে সে ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে চাইছেআড়ালে থাকতে চাইছেযেন সবার সাথে মিশতে গেলেই পর্বত ভেঙে পড়বে তার ওপর!

আমিলেখক সৌম্যজিৎ দত্ত আজ সেই মানুষটির সব থেকে কাছের বন্ধুএবং এতটাই বিশ্বস্ত হতে পেরেছি যে মানুষটি আমাকে নিজের সেইসব অন্ধকারের কথা জানাতে পেরেছে নির্দ্বিধায়।

সাল ২০১৪ এর ডিসেম্বর মাস। জিনিয়া দিল্লীতে কাকুর বাড়িতে বেড়াতে গেছিলো। তখন জিনিয়ার বয়স বাইশ বছর। উৎসবের সময় তখন গোটা পৃথিবীতেই। দিল্লীও নতুন সাজে সেজে উঠছে। জিনিয়া আধুনিক মেয়েপার্টিতে যায়নাচেগান করে। মাঝে মধ্যে নেশাও করে। বাড়িতে কড়া পরিবেশের ভয় থাকলেও জিনিয়া বাইরের পরিবেশে বেশ সাবলীল। হঠাৎই সেদিন জিনিয়ার কাকাতো দাদা জিনিয়াকে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দেয়।

আধুনিক মানসিকতার হলেওসকলের সাথে বন্ধুর মতো মিশলেও জিনিয়া এমন প্রস্তাবে হকচকিয়ে ওঠে। কে'ই বা এমন একটা পরিস্থিতির মুখে স্থির থাকতে পারে! জিনিয়া ভীষণ রেগে যায়। সটান থাপ্পড় চাপিয়ে দেয় সেই দাদাকে। পরিস্থিতি সামলাতে জিনিয়ার দাদা বলে, "সে মজা করছিলো।" এরপর জিনিয়াও ভাবে যে সে ভুল করেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলোতার দাদা মজাই করছিলো। এভাবে কোনো দাদা কি কখনো নিজেরই কাকাতো বোনকে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দিতে পারে! জিনিয়া ব্যাপারটা ভুলে যায়।

সেদিন ছিলো ৩১শে ডিসেম্বরের রাত। জিনিয়া ও তার দাদা এক নাইট ক্লাবে ঘুরতে যায়। সেই রাতে জিনিয়ার জন্য যে ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছেতা জিনিয়া কখনোই বুঝতে পারে নি। নাইট ক্লাবে গিয়ে জিনিয়া দেখে সেখানে তার দাদার বন্ধুরাও এসেছে। সবাই মিলে গানের সাথে নেচেছে। মদও খেয়েছে। হঠাৎই জিনিয়া দেখে সবদিক কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে! জিনিয়া অসুস্থ বোধ করতে থাকে সেই পার্টিতে এবং চেতনা হারায়। পরদিন যখন ঘুম ভাঙেতখন জিনিয়া নিজেকে আবিষ্কার করে এক হোটেলরুমে একাবিবর্ণবিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে। তার শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা। বিছানার চাদরে রক্ত লেগে। জিনিয়া বুঝতে পারেতার সাথে কি হয়েছে। কিন্তু সে ভয় পায়। জিনিয়া ভয় পেয়ে যায় বাড়ির মানুষগুলোর জন্য। সে কাউকে কিছু জানাতে পারে না। সবার মাঝে থেকেও সবার থেকে সে আলাদা হয়ে যায়। ভেঙে পড়তে থাকে। মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাতে থাকে।

একজন বাইশ বছরের আধুনিক মেয়েযার পরিবেশ সম্পর্কিত সমস্ত চেতনা আছেকিন্তু বাড়ির পরিবেশকে সে এতোটাই ভয় পায় যে সে তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে বাড়িতে প্রকাশ করতে পারে না। সে বলতে পারে না যে সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তারই দাদার কাছে। সে বলতে পারে না যে তার ন্যায় চাই। পরিবর্তে সে নিজেই অপরাধবোধে ভুগতে থাকে।

আর কতোদিন মেয়েরা নিজেদের সাথে হওয়া অন্যায়গুলোঅত্যাচারগুলো মুখ বন্ধ করে মেনে নেবে! আর কতদিন মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হলে নিজেদেরই অপরাধী ভাববে! আর কতদিন জিনিয়ার মতো মেয়েরা ধর্ষণকে মুখ বুজে সহ্য করবে! আর কতদিন সেইসব ধর্ষকেরা ধর্ষণ করে বেকুসুর খালাস পেয়ে যাবে?

আমি জিনিয়ার পাশে আছি। আমি জিনিয়ার পাশে থাকবো। আমি জিনিয়ার ভরসা হবো। ন্যায় দেবো জিনিয়াকে। আমি জিনিয়ার সমস্ত ভয়কে কাটিয়ে দেবো। ওকে বোঝাবোঅন্যায় ওর সাথে হয়েছেও কোনো অন্যায় করে নি।

তোমরা তোমাদের প্রতি হওয়া অন্যায়কে প্রকাশ করো। মুখ বন্ধ করে যতোদিন সহ্য করবেঅন্যায়কারীরাধর্ষকরা সমাজে ততো শক্তিশালী হয়ে উঠবেততো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তোমরা যদি ধর্ষণের শিকার হওপ্রকাশ্যে প্রতিবাদ করে নিজের এবং সমস্ত নারীর সম্মানকে অক্ষুণ্ণ রাখার উদাহরণ তুলে ধরো।

বুঝিয়ে দাও তুমি ধর্ষণের শিকার হলেসেই লজ্জা তোমার নয়সেই লজ্জা ধর্ষকের।

2617 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।