বিশ্ব চাকমা

বিশ্ব চাকমা মানবাধিকারের প্রথম শর্ত হিসেবে মনে করেন, জাত, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে মানুষের প্রথম পরিচয় মানুষ।

এই দেশে ধর্ষণ কামের সীমানা পেরিয়ে রাজনৈতিক পীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে

“ধর্ষণ” নিয়ে একটি লেখা লিখবো লিখবো করে লিখতে পারছিলাম না, বিশেষ করে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনাটি নিয়ে। আজ একটু সময় নিয়ে লিখতে বসলাম। এই ধর্ষণের ঘটনায় ভিক্টিম দুই মারমা তরুণী, আপন দুই বোন। একজনকে ধর্ষণ করা হয়েছে, আরেকজনকে যৌননিপীড়ন করা হয়েছে। ধর্ষকরা হলেন রাষ্ট্র সরকারের পোষ্য গুণ্ডাবাহিনী জলপাই রঙের হায়েনারা। লেখাটি শুরু করি হুমায়ুন আজাদের “১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ” উপন্যাস থেকে একটি কথা দিয়ে- “বাংলাদেশ এখন হয়ে উঠেছে এক উপদ্রুত ভূখণ্ড; হয়ে উঠেছে ধর্ষণের এক বিশাল রঙ্গমঞ্চ, ৫৬,০০০ বর্গমাইলব্যাপী পীড়নের এক শোচনীয় প্রেক্ষাগার। ধর্ষিত হচ্ছে মাটি মেঘ নদী রৌদ্র জ্যোৎস্না দেশ, এবং নারীরা।”

রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়িতে ধর্ষণের ঘটনাটি নিয়ে রাস্ট্রযন্ত্র এবং জলপাই রঙের হায়েনারা মিলে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ধর্ষণের ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য। আইনের শক্তি; মিডিয়ার শক্তি রাষ্ট্রের যাবতীয় সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে সেনাবাহিনীদের ধুয়ো তুলশী পাতা বানানোর চেষ্টায় অব্যয়ত রয়েছে রাষ্ট্র সরকার, অপরদিকে মারমা তরুণীর ধর্ষণের ঘটনাটি সাজানো এবং বানোয়াট বলে উড়িয়ে দেবার অপপ্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে- “আর্মি ও আনসারের সমন্বয়ে যৌথ অভিযানের সময় একজন আনসার সদস্য গিয়াস নামে মেয়েটির হাত চেপে ধরে, এরপর মেয়েটির চিৎকার শুনে আর্মি সদস্যরা সে আনসার সদস্যকে ধরে ফেলে ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। কাজেই, এটি কোনো ভাবেই ধর্ষণের ঘটনা নয়।” 

গত ২৩ জানুয়ারি মানবকণ্ঠ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে- "হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক মারুফ বলেন, মঙ্গলবার দুপুরে দু’জন মারমা কিশোরীকে বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের ওরাছড়ি গ্রাম থেকে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়। তারা দুজনই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। মহিলা চিকিৎসক আসলে আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষা করবে। ভুক্তভোগীরা যে ঘটনার কথা বলেছে তা ইতিমধ্যে ২৪ ঘন্টা পার হয়েছে।...........

কর্তব্যরত একজন সেবিকা বলেন, দুজনের মধ্যে একজনের অবস্থা ভালো নয়। তার এখনও ব্লাডিং হচ্ছে। ঔষুধ দেয়া হচ্ছে। ওই কিশোরীর ব্যবস্থাপত্রে ৫টি ঔষধের মধ্যে দিনে তিনটি করে Tracid (500mg) ট্যাবলেট দেয়া হয়েছে।

রাঙামাটি মা ও শিশু কেন্দ্রের গায়িনী চিকিৎসক লেলিন তালুকদার বলেন, কারোর রক্ত ক্ষরণ হতে থাকলে তা বন্ধ করতে রোগীকে Tracid (500mg) ট্যাবলেট দেয়া হয়।"

এর থেকে বোঝা যায় মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে, নাকি হয় নাই! জলপাই রঙের হায়েনারা যদি নির্দোষী হয়ে থাকে, তাহলে এতো কেনো তালবাহানা চলছে দুই বোনের চিকিৎসা নিয়ে। হাসপাতালে কাউকে ঢুকতে না দেওয়া, সেনা-পুলিশের তৎপরটা রাঙামাটি হাসপাতালের আশপাশে। পাহাড়ের দালাল রাসেল মারমাকে দিয়ে সংবাদ সম্মোলন করানো, ভিক্টিমের মা-বাবাকে সেনা হেফাজতে রাখা। দুই বোনকে মানসিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, অতন্দ্র পুলিশের পাহারায় রাখা হয়েছে, অথচ যতদূর শুনেছি এখনও কারোর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় নি, তবুও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীদের হয়রানি থেকে মুক্তি মিলছে না ভিক্টিমের পরিবারদের। ভলন্টিয়ারদের কেনো হাসপাতালে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। আর কতো ঢং দেখবো রাষ্ট্রের পোষ্য গুণ্ডাদের, কতো কেচ্ছা কাহিনী সাজাবে মিডিয়ার সামনে, আর কতো অগনতান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার করবে একটি ধর্ষণের ঘটনাকে মাটি চাঁপা দিতে।

আমি জানি এই দেশে বিচার চাওয়া মানে, নিজেই হয়রানি হওয়া। রাজনীতি এবং মৌলবাদ এদেশটাকে এমন স্তরে নিয়ে গেছে মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থাকেও হার মানাবে। দেশটা এখন পুরোপুরি বিচার সংস্কৃতিহীনতায় পরিপূর্ণ। জানি, আমাদের এই দুই বোনও সঠিক বিচার পাবে না। আমার সমতলের বোন সোহাগী জাহান তনুকেও ধর্ষণ এবং হত্যা করে পার পেয়ে গেছে এই সেনাবাহিনীরা। যার বিচার এখনও পায় নি, উল্টো তনুর বিরুদ্ধে কেচ্ছা কাহিনী সাজিয়েছে এই নূপুংশক সেনাবাহিনীরা। আমার পাহাড়ের দুই বোনকে ধর্ষণ ও যৌননিপীড়ন করেও পার পেয়ে যাবে এই নুপুংসকরা ।

সমতলের কিছু হারামি আছে এই বলে প্রচার করে যে- পাহাড়িরা সেনাবাহিনীদের ভিলেন বানিয়েছে, আদতে সেনাবাহিনীরা এতো খারাপ না। পাহাড়ে সন্ত্রাসী আছে, তাই সেখানে সেনাবাহিনী থাকা উচিত ওদেরকে দমন করার জন্য। থামেন একটু, কাদের সন্ত্রাসী বলছেন, কাদের জঙ্গি বলছেন! অস্ত্র হাতে তুলে নিলে সন্ত্রাসী হওয়া নয়, পৃথিবীতে অনেক জাতি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য, বিশেষ করে সে অধিকার যদি হয় জাতির অস্ত্বিত্ব ঠিকিয়ে রাখার সংগ্রামের, তাই বলে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া যায় না এদেরকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বাইরে নয়, তাই পাহাড়িরা কখনো বলে নি যে পাহাড়ে সেনাবাহিনী থাকতে পারবে না। অবশ্যই থাকবে, কিন্তু সেটা হবে বাংলাদেশের অন্য আট/দশটা জেলার মতন সীমিত। কিন্তু সন্ত্রাসীর সুতো দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিদের অগণিত ক্যান্টনমেন্ট, ছাউনি রাখবেন সেটা তো মানা যায় না। এটা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক।

সেনাবাহিনী দ্বারা পাহাড়ি নারী ধর্ষণ হওয়া এই প্রথম নয়, অতীতে অনেক পাহাড়ি নারীকে ধর্ষণ করেছে এই সেনাবাহিনীরা। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ধর্ষণ করেছে রাষ্ট্রের পোষ্য ধর্ষকরা। কথা হলো, এ সমস্ত খবরগুলো সেসময় মিডিয়ায় আসে নাই। রাষ্ট্রের হলুদ সাংবাদিকেরা হলুদ দিয়ে এখবরগুলো মাটি চাঁপা দিয়ে আসছে।

ধর্ষণ এখন শুধুমাত্র কামের, মনোবিকারগ্রস্থের মধ্যে সীমিত নয়। ধর্ষণ এখন কামের সীমানা পেরিয়ে রাজনীতিক পীড়ন হয়ে উঠেছে। এই যে পাহাড়িদের নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে এটা শুধু ধর্ষণ না, এ-ধর্ষণের রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে। রাজনৈতিক লক্ষ্য আছেই বিধায়- সেনাবাহিনীরা বিভিন্ন উপায়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে পাহাড়ের ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে যাচ্ছে ধর্ষকদের বিচার না করে। ১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমাকে অপহরণকারী সেনা সদস্য নজরদারিতে নেই, কিন্তু দুই দশক ধরে নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামে নজরবন্দি হয়ে আছে কল্পনার ভাই। ২০১৫ সালে সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণকারী সেনাসদস্য নজরদারিতে নেই, কিন্তু দুই বছর ধর ধরে কুমিল্লায় নজরবন্দী আছে তনুর পরিবার। ২০১৮ সালে মারমা বোনদের ধর্ষণকারী সেনাসদস্য নজরদারিতে নেই, কিন্তু রাঙামাটিতে নজরবন্দী আছে ধর্ষণের শিকার দুই মারমা বোন। রাষ্ট্রের এমন আচরণে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না যে- পাহাড়িদের সম্পুর্নরূপে ভীত সন্ত্রস্ত করা হচ্ছে এবং বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে তোমাদের কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করা চলবে না। তোমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যাবে, নইলে বশীভূত দাসের মতো অধিকারহীন জীবনযাপন করবে। ধর্ষণ, ভুমি দখল, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, অত্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতন, সেনাবাহিনী দ্বারা হয়রানি, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া এসবগুলো করা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশে।

কে যেন বলেছে বাংলাদেশের বিপন্ন প্রাণীর নাম রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়, বিপন্ন প্রাণীটি হচ্ছে-হিন্দু সম্প্রদায়। কথাটি ভুল বলেন নি। এদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী এখন অত্যন্ত বিপন্ন। তারা অত্যন্ত অসহায় এবং ধর্ষণের আতঙ্কের মধ্য বাস করে পাহাড়িদের মতন। তাদের মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়, সম্পত্তি দখল করা হয়; কিন্তু এর কোনো রকম প্রতিবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাধীনতার পর থেকে হিন্দুরা কমিয়ে আসতে আসতে আগামী কয়েক দশক পরে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে খুঁজতে হবে। নিরপত্তাহীনতার অভাবে হিন্দুরা নীরবে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে এদেশ থেকে, পাড়ি দিচ্ছে পাশের দেশ ভারতে, কারণ হিন্দুরা অস্ত্র ধরতে পারেন নি, প্রতিবাদ করতে পারেন নি। কিন্তু পাহাড়িরা হিন্দুদের মতন নীরবে সব রকমের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, প্রতিবাদ করতে শিখেছে, তাই এখন পাহাড়িরা সমতলের চোখ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, বিচ্ছিন্নবাদী। এদেশটাকে টুকরো টুকরো করতে চাই। জুম্মল্যান্ড নামক আরেকটি রাষ্ট্র গঠন করতে চাই স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে পৃথক হয়ে। আর কতো কি শুনতে হচ্ছে! আরো কতো মিথ্যা অপপ্রচার চালাবে হে রাষ্ট্র সরকার!

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীদের “মোটো” বা নীতিবাক্য হচ্ছে- সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে। 

এই নীতিবাক্য নতুন করে যোগ করে হওয়া উচিত -সমরে আমরা, ধর্ষণে আমরা, শান্তিতে আমরা, অশান্তিতেও আমরা, সাম্প্রদায়িকতায় আমরা, সন্ত্রাসেও আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে।

3677 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।