শেখ তাসলিমা মুন

শেখ তাসলিমা মুন বর্তমানে সুইডেন প্রবাসী। সুইডিশ রাজনীতিতে সোসাল ডেমক্রেট হিসেবে সক্রিয়ভাবেই যুক্ত আছেন। সুইডেনের ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে জুরিমেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাসলিমা সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এক্টিভিজম ছাড়াও নারী অধিকার এবং ধর্মীয় গোড়ামীর বিরুদ্ধে এই লেখক সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করেন।

বাঙালি নারীর টিপ একটি নৃতাত্বিক অরিজিন, ধর্মের নয়।

বাঙালি মেয়ের টিপ পরা কবে শুরু হয়েছিলো সে তার হাজার বছরের সংস্কৃতির ইতিহাসেরই একটি অংশ। কবে এক প্রেমিক পুরুষ একটি ফুল তুলে তার প্রেমিকার কানে গুঁজে দিয়ে সৌন্দর্যয়ের মুগ্ধতায় তাকিয়েছিলো সে সৌন্দর্য অনুভবের উৎসের ইতিহাস। মানুষের সৌন্দর্য জ্ঞানের উৎপত্তি একটি ক্রমবিকাশের ইতিহাস। প্রকৃতির সাথে যা সম্পর্কিত।

মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক যতো প্রাচীন, এর ইতিহাস তত প্রাচীন। প্রকৃতিতে উপাদানগুলো মানুষের নাগালের ভেতর ছিলো বলেই সেই উপাদানের উপরই একটি জাতির অভ্যাসগুলো গড়ে ওঠে। বাঙালির খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, বিনোদন, সঙ্গীত, ক্রীড়া, তার প্রকৃতির উপকরণের উপর গড়ে উঠেছে। বাঙালির খাদ্যাভাসে যেমন চালের প্রাধান্য দেখা যায়। ধনী দরিদ্রের খাবার ছিলো ভাত। গরম ভাতে ঘি দিয়ে খেয়ে তৃপ্তি ফেলত বাঙালি। তার সাথে যুক্ত হয়েছে মাছ। তরকারির ভেতর বেগুন কুমড়োর মতো তরকারি শাকের ভেতর নালিতা। অনুষ্ঠানে চালের সাথে দুধ মিশিয়ে মিষ্টান্ন। পানসুপারি। এরপর আসে চাল থেকে মুড়ি খই চিড়ে পিঠা।

আজও চালের প্রাধান্য আমাদের খাদ্যভাসে। চালের গুড়ো দিয়ে কেবল খাদ্য নয় আলপনা আঁকা সহ শৈল্পিক কাজগুলোও দেখতে পাই। নান্দনিক বিষয়গুলোর ভেতর ফুল কিভাবে জায়গা করে নিয়েছে বাঙালি সংস্কৃতিতে। নারীর সাজ সেই নান্দনিক সৌন্দর্যের একটি অংশ। ফুল এবং নারীর সাজ আজও একটি অভিন্ন বিষয়। 

পোশাকের কথায় আসা যাক। বাঙালি নারী এবং পুরুষ উভয়ের পোশাক ছিলো সেলাইবিহীন। দরিদ্ররা কার্পাস তুলো দিয়ে তৈরি সুতোর কাপড়। ধনীরা রেশমি সুতোর। মেয়েরাও বিশেষ করে যে নারীরা উচ্চবিত্ত মেয়ে ছিলো না তারা দু’খন্ডের পোশাক পরতেন। নীচের একটি খন্ড, উপরে আরেক খন্ড। পুরুষেরা ধুতির মতো সেলাইবিহীন এক খন্ড পোশাক পরতো। উপরের অংশে উত্তরীয়র মতো এক খন্ড বস্ত্র। পরে ফতুয়ার মতো একটা বিষয় যোগ হয়। উচ্চবিত্ত নারীরা একখন্ড বস্ত্র সেলাইবিহীন বস্ত্র পেচিয়ে পরতো। ব্লাউজ ফতুয়া বা পেটিকোট কিছু ছিলনা। মেয়েদের ব্লাউজ বা ‘জ্যাকেট’ পড়ার প্রচলন শুরু করেন মূলত ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা। মেয়েদের সামনে কুঁচি দিয়ে নীচে পেটিকোট বা সায়া ব্যবহার করার প্রবর্তনও ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা করেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের বড় বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বিলেত থেকে ঘুরে আসার পর বাঙালি মেয়েদের শাড়ি পরায় বেশ কিছু অনুষঙ্গ যুক্ত করেন। তার আগে বাঙালি নারী এক খন্ড বস্ত্র একটি বিশেষ কায়দায় পড়তো। তাঁরা গলায় ঘন ফুলের মালা পড়তো। সহসা বুকের কাপড় সরে গেলে ফুলের মালা বুকের পর্দা হিসেবে কাজ করতো। বিত্তবান সমাজের নারীর ছিলো জড়োয়া ধরনের গহনা। গলা থেকে অনেকটা নেমে আসতো সে গহনাগুলো। হাত ভরা চুড়ি, বাহুতে বাজু, কানে দুল, কোমরে বিছা আসে। কিন্তু এর আগে মেয়েরা পরতো ফুলের কানের দুল। ফুলের মালা। এগুলো তাদের পোশাকের অংশ হিসেবে কাজ করতো। নারীর চুল ছিলো লম্বা। ঘাড়ের কাছে খোঁপা বা কাঁধের পাশ দিয়ে সামনের দিকে ছেড়ে দিয়ে রাখা হতো। তার লম্বা চুল খানিকটা তার পোশাকের কাজ করতো। 

এবার আসা যাক তার সাজের বিষয়। সাজের অংশ হিসেবে সৌখিন নারীরা লাক্ষারসে যা লাল এক ধরনের রঙের ঠোঁট রাঙাতো। এ দেশে পারফিউম আসার আগে ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা ধুপ দিয়ে চুলে সুগন্ধ তৈরি করতো। গোলাপের পাপড়ি বগলে চেপে সুগন্ধ তৈরি করতো। বাঙালি মেয়েদের কাজল ব্যবহার অনেক প্রাচীন। রান্নার কালো রং থেকে কপালে টিপ হিসেবে জায়গা করে। এরপর তাঁরা কাজল তৈরি করে টিপ হিসেবে ব্যবহার করে। শিশুদের কপালে ব্যবহার শুরু হয়। মেয়েরা চোখে কাজল আঁকে। মেয়েরা আগে সিঁদুর ঠোঁটে দিয়ে ঠোঁট রাঙাতো। লাক্ষারসে ঠোঁট রাঙানোর পাশাপাশি তাঁরা কপালে লাল রঙ দেওয়া শুরু করে। এভাবে লাল আলতা রঙ মেয়েদের কপালে ঠোঁটে এবং পায়ে জায়গা করে নেয়। পান খেয়ে ঠোঁট রাঙানো প্রসাধনের বিষয় হয়ে ওঠে।

মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের সাথে সৌন্দর্য ভাবনার শুরু। কেবল নারী নয় পুরুষেরাও প্রসাধন এবং সাজে যত্নশীল ছিলো। এ অঞ্চলের পুরুষেরা লম্বা চুল রাখতো। কোঁকড়ানো চুলে সুগন্ধি তেল মাখাতো। তাঁরা আকর্ষণীয় পুরুষ ছিলো। আমরা জানি না পুরুষেরা নখ রাঙাতো। 

এ সময় সৌন্দর্য সেবার উপকরণ তাঁরা প্রকৃতি থেকে আহরণ করেছে। কখনও ফুল, কখনও পান, কখনও লাক্ষারস, কখনও হলুদের রঙ তারা প্রসাধনে ব্যবহার করেছে। আবির সিঁদুর এসেছে। সে প্রাচীন কাল থেকে নারীর কপালে, ঠোঁটে আঁখিতে সিঁথিতে রঙের সমাবেশ দেখা গেছে। এগুলো সংগ্রহ হয়েছে আমাদের প্রকৃতির থেকে উপাদান থেকে। ধর্মীও বিধান আরও অনেক অনেক পরে এসেছে। মানুষের সৌন্দর্য বৃত্তির বিকাশের সাথে এর সম্পর্ক। ধর্মের সাথে নয়। এটি একটি জনগোষ্ঠীর জীবনাভ্যাসের সাথে গড়ে উঠেছে। বাঙালির এ অভ্যাস তার হাজার বছরের সংস্কৃতির সাথে জড়িত। 

ধর্মীও ভাবসঙ্গীত বাংলায় সঙ্গীতের প্রধান উৎস ছিলো। ভুলে গেলে চলবে না, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রাধান্য সে সময় অনেকের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবু আজও বাঙালির সঙ্গীত পিপাসু হৃদয় রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া ভাবতে পারে না। নারীর কপালে এ টিপ চিহ্ন তাদের হাজার বছরের একটি প্রসাধন রূপচর্চার সাথে মিশে আছে। তাকে ধর্মের ট্যাগ দেওয়ার অধিকার কোনো আরব বেদুঈন সংস্কৃতির প্রতিভূর নেই।

6645 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।