যারা কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করেন না কিন্তু মানুষসহ জীবজগত, এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করা একজন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন তাদের এই ‘অধর্মীয় ঈশ্বর’ বিশ্বাসের ‘লজিক’ কি? একদম গুহা মানবদের কথা থেকে শুরু করলে, তারা আকাশ থেকে বিদ্যুৎ আছড়ে গাছের মাথায় আগুন ধরতে দেখলে তাকে মহাশক্তিধর বলে মনে করত। বজ্রপাতে গুহামানবদের মৃত্যু ঘটলে তারা মনে করত শক্তিটি কোনো কারণে তাদের উপর মনোক্ষুন্ন। এইভাবে তারা বাতাস, বৃষ্টি, অন্ধকার, চাঁদ- সব কিছুকে মহা ক্ষমতাধর ভাবতে শুরু করেছিলো। তারা দেখেছিলো এসবের খামখেয়ালীর কাছে তারা জিন্মি হয়ে আছে। তাদের কাছে সবচেয়ে শক্তিধর প্রভাবশালী হিসেবে ধরা দিয়েছিলো সূর্য। সূর্যকে তাই পৃথিবীর প্রধান একজন ‘ঈশ্বর’ হিসেবে নিজের স্থান করে নিতে বেশি সময় লাগেনি।
আদি ঈশ্বরের যে কনসেপ্ট তা থেকে আজকের প্রচলিত ধর্মগুলোর ঈশ্বর ধারণায় খুব বেশি একটা পরিবর্তন বা আধুনিকতা লাভ করেনি। এখনো বৃষ্টি জন্য আল্লার কাছে বৃষ্টি নামানোর নামাজ পড়া হয়। বৃষ্টি দেবতা, বজ্র দেবতা, বাতাসের দেবতার মতো বয়েসে নবীন ধর্ম ইসলামে উক্ত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে এক ধরণের স্বর্গীয় অবস্তুগত অস্তিত্ব যাদেরকে ফেরেস্তা বলা হয়। প্রাচীন ধর্মগুলোতে ভূতপ্রেতের উৎপাত, কখনো কখনো ভূতদের ভগবান বা দেবতাদের সাহায্যকারী রূপেও দেখা যেতো। সবচেয়ে নবীন ধর্ম ইসলামে সেই ভূত এসেছে জ্বিন নামে। আসল সত্য হচ্ছে জ্বিন এই অতিপ্রাকৃত অস্তিত্ব ভারতবর্ষের ভূতপ্রেতের সমান বয়েসের। ঠাকুর মার ঝুলির গল্পগুলো যেমন কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে চর্চিত হয়ে এসেছে তেমনি চেরাগের ভেতর জ্বিন কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। এই জ্বিনই পরে প্রফেট মুহাম্মদের কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছে! আপনি আমি যখন শুনবো হিন্দুদের কোনো ভগবান ভূতের সঙ্গে দোস্তি করছে তখন শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিবো। কিন্তু যখন মুহাম্মদের কাছে জ্বিন জাতি ইসলাম গ্রহণের কথা শুনব তখনো কি বলব ইসলাম হচ্ছে সবচেয়ে আধুনিক আর স্মার্ট ধর্ম?
যাই হোক, আদি ঈশ্বরের যে সৃষ্টি তা মানুষের প্রতিকূল পরিবেশে ভয় এবং অনিশ্চয়তা থেকে। মানুষ যখন সভ্য হলো, পৃথিবীর নামজাদা সভ্যতাগুলোতে গুহামানবদের সৃষ্টি করা ঈশ্বরও তার স্থান করে নিলো। শুরুতে ঈশ্বর একা ছিলেন না। তারা কয়েকজন মিলে বিশ্বজগত চালাতেন। কখনো কখনো এই পরিচালনা করতে গিয়ে তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেন। ঈশ্বরদের ছিলো নিজস্ব এক বিরাট কর্মী বাহিনী। আকাশে ঈশ্বরদের রাজ্য থেকেই মর্তের সব কিছু পরিচালিত হতো। গ্রীসের দার্শনিকরা বহুশ্বরবাদী ঈশ্বরের মধ্যে কিছু ত্রুটি পরিলক্ষিত করে ঈশ্বর একা হলেই বরং অনেক বেশি ‘লজিক্যাল’ হয় এরকম চিন্তা করতে থাকলেন। এদের থেকেই একেশ্বরবাদের সৃষ্টি হয়েছিলো। এটুকু বাদে একেশ্বর আর বহুশ্বরবাদের আর কোনো পার্থক্য নেই। ঈশ্বরের রাজ্য, তার কর্মীবাহিনী, ভূত জ্বিন, অপশক্তি, জাদুটোনা সবই থেকে গেলো। প্রাচীন ধর্মগুলোর কালো জাদু সবচেয়ে নবীন ধর্ম ইসলামও বিশ্বাস করে। স্বয়ং প্রফেটকে জাদু করা হয়েছিলো বলে মানা হয়। আসছি এসব কথায়। তার আগে বলা দরকার যে ঈশ্বর ধারণাই সরাসরি ধর্মীয় সেটা আবার অধর্মীয়ভাবে হয় কিভাবে?
দার্শনিকরা যেমন বহুইশ্বরবাদকে একটা শক্ত ‘লজিক্যাল’ ভিত্তি দিয়ে বহু শতাব্দী পর্যন্ত বহুইশ্বরবাদী ধর্মগুলোর পৃষ্টপোষকতা দিয়ে গেছেন, তেমনি এই দার্শনিকদের মধ্যেই কেউ কেউ বহুইশ্বরবাদের ফাঁকফোকরগুলো বের করে একেশ্বরবাদের সুচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে সব রকম ঈশ্বরের ত্রুটি চিহ্নিত করে দার্শনিকদের অনেকেই ঈশ্বর ধারণাই নাকচ করে দিয়েছিলেন। এই নাস্তিক দার্শনিকদের বয়স পৃথিবীর প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোর সমবয়েসী। ভারতবর্ষের ঋষিরা (দার্শনিক) নাস্তিকতাবাদ প্রচার করতেন। গৌতম বুদ্ধ সবরকম ঈশ্বর স্বর্গ পরকালের বিশ্বাস উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই হিসেবে প্রচলিত ধর্মীয় ঈশ্বরকে বিশ্বাস না করা বিশ্বজগত সৃষ্টি করা অধর্মীয় ঈশ্বরের বিশ্বাসী অজ্ঞেয়বাদীদের জন্ম বেশিদিন নয়।
ঈশ্বর মানুষকে খাওয়ায় না পরায় না, নরকে ফেলে না স্বর্গেও স্থান দেয় না। ঈশ্বর আসলে আদৌ মানুষের কথা জানেই না। তিনি সৃষ্টির আরো বিরাট কোনো কাজে নিয়োজিত আছেন- এইরকম ঈশ্বর চিন্তা আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে আধুনিক যুক্তিবাদী মন ধর্মীয় ঈশ্বরকে মেনে নিতে পারে না আবার কিছু নেই এটাও সে মানতে পারে না- এই দোলাচলে তার ‘অধর্মীয় ঈশ্বর’ ধারণার জন্ম। একবার স্টেফিন হকিং এইরকম ঈশ্বর সম্পর্কে বলেছিলেন, এরকম একজন ঈশ্বর থাকলেই কি আর না থাকলেই বা কি? তাকে তো মানুষের কোনো কাজে আসবে না। তো এই ধরণের ঈশ্বর বিশ্বাসীরা তাদের ঈশ্বর নিয়ে কি করেন সেটা কখনোই খোলসা করেন না। বিশ্বজগত সৃষ্টিকরা একটা ঈশ্বরের তো কিছু প্রশংসা স্তুতি প্রাপ্য। কিছু সন্মান এবং মানবজাতি হিসেবে সেই ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। এখান থেকেই তো প্রার্থণার সৃষ্টি হয়েছিলো! অধর্মীয় ঈশ্বর বিশ্বাসীরা তাহলে দেখা যাচ্ছে ধর্মের অনেক কাছাকাছি। নাস্তিকতা ধর্মের সৎ ভাইও হতে পারে না। নাস্তিকতা ধর্মের বিনাশ চায়। অজ্ঞেয়বাদীরা ধর্মীয় ঈশ্বরবাদীদের পিশতুতো ভাই হন! বেশির ভাগ অধর্মীয় ঈশ্বর বিশ্বাসী এক সময় তাদের পারিবারিক ধর্মে ফিরে যান যখন তার ‘অধর্মীয় ঈশ্বর’ আর ‘ধর্মীয় ঈশ্বরের’ মধ্যে ব্যবধান কমে আসে। নাস্তিকতা যুক্তি, প্রমাণকে ধারণ করে এগিয়ে যায়। কোন মূর্খ নাস্তিক তার অবিশ্বাসকে বিশ্বাসের মতো করে গ্রহণ করা একেবারেই তার নিজস্ব ভ্রান্তি।
লেখাটা শেষ করি কথিত পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক আর স্মার্ট ধর্ম ইসলাম নিয়ে কথা বলে। বহুবার বলা একটা কথার প্রভাব যে থেকে যায় তার প্রমাণ ইসলাম তুলনামূলকভাবে অন্য ধর্ম চেয়ে কম নারী বৈষম্যকারী, কম জাতিভেদকারী, কম নিপীড়নকারী ইত্যাদি প্রচারণাগুলো না বুঝে না জেনেই সবাই ব্যবহার করে। ইসলাম ধর্মটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কেমন সেটা জানাতে কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াসসহ লক্ষ লক্ষ ইমামের সর্বমান্য ফতোয়া পড়তে হবে। নবীর নাতি তিনশোর উপরে বিয়ে করেছিলেন ইসলামী আইনের সুচতুর কৌশলকে কাজে লাগিয়ে। একজন মুসলিম পুরুষ একত্রে চার স্ত্রী রাখতে পারবে এটাই ইসলামের নিয়ম। এর মানে হচ্ছে সে চারজন স্ত্রীকে ত্যাগ করে ফের নতুন চারজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারবে- এতে তার কোনো দোষ হবে না। আর স্ত্রী তালাকের কোনো কারণ থাকার প্রয়োজন নেই। ইসলাম দাসপ্রথাকে প্রমোট করেছে। ইহুদীখ্রিস্টানদের দাস বানানো ইসলাম মতে হালাল। অমুসলিম নারীদের যৌনদাসী বানানো আল্লার তরফ থেকে সম্পূর্ণ হালাল। দাসীবাদীদের নিজের স্ত্রীর মতোই অবাধে সেক্স করা যাবে। একজন মুমিন মুসলমান তার স্ত্রীকে ঘরে বন্দি করে রাখবেন। নারীর স্বাধীন কোনো সত্ত্বাকে স্বীকার করার কোনো চান্স ইসলামে নেই। ইসলামে নারীর তালাক দেয়ার অধিকার, সম্পত্তিতে ভাগ ইত্যাদি ইসলামকে আধুনিক বলে প্রমাণিত করে না। কারণ প্রাক ইসলাম যুগে আরবে নারীরা স্বামীকে ত্যাগ করে নতুন বিয়ে করতে পারত পুরুষদের মতো। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ তার প্রমাণ। হিন্দ ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে খুবই প্রভাবশালী মহিলা। সম্পত্তিতে নারীর পূর্ণ অধিকার বিবি খাদিজার মৃত স্বামীর সমস্ত সম্পত্তি প্রাপ্তিই প্রমাণিত করে। খাদিজা ছিলেন নারী ব্যবসায়ী। ইসলাম আসার পর নারী তার স্বামী সন্তান ব্যাতিত ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ হয়ে যায়। নারী হয়ে পড়ে বাবার মাথার বোঝা আর স্বামীর সম্পত্তি। ভারতবর্ষের মনুর বিধানের চেয়ে কোনো অংশে ইসলাম নারীকে ছাড় দেয়নি। সাদা চোখে ইসলামকে কম নারী বৈষম্যময় ধর্ম মনে করা হলেও এরপর ভেতর প্রবেশ করলেই শুভংকরের ফাঁকি বেরিয়ে পড়ে। কথিত ‘আধুনিক ধর্ম ইসলাম’ নিজের মধ্যে পুরুষতন্ত্রের সমস্ত বৈষম্য আর নিপীড়ন সবই রক্ষা করে চলেছে। তবু ইসলামকে অন্যদের চেয়ে বেটার বলাটা ইসলাম সম্পর্কে কম জানার জন্যই দায়ী।