নারীর আধুনিকায়ন ঘটেছে কিন্তু মুক্তি ঘটেনি এদেশে। নারী মেকাপ গেটাপে মাত্রাতিরিক্ত সচেতন হয়েছে কিন্তু তার মনের মুক্তির জন্যে হাহাকার তৈরি হয়নি। এ বাঙলায় নারী যতোটা বাইরে এসেছে, তথাকথিত অন্ধকার (ঘর) ছেড়ে তথাকথিত আলোয় (বাইরে) এসেছে-তার প্রায় পুরোটাই পুরুষের জন্যে, পুরুষের সংসার, পুরুষের জগৎ রক্ষার জন্যে। নিজের জন্যে খুব কমই বাইরে এসেছে নারী।
নারীশিক্ষা নারীর জন্যে নয়, পুরুষের সন্তানের শিক্ষার জন্যে নারীর শিক্ষা কেননা সন্তানটিই তো নারীর নয়। নারীর উপার্জন নারীর জন্যে নয়; সংসারে স্বচ্ছলতা আনাই প্রধান এখানে। সংসারটিও কিন্তু নারীর নয়। নারী এক ভাসমান মনুষ্যসদৃশ্য প্রাণীমাত্র। একটি-দুটি স্বাক্ষরের মাধ্যমে যখন সংসার ভেঙ্গে যায় নারী তার সমস্ত স্বত্ব ত্যাগ করে নিঃস্ব হয়ে যেতে বাধ্য হয়। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরে নারীকে। এ অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা পেতে নারী প্রয়োজনীয় বিচ্ছেদের বদলে বেশীরভাগ সময়ই পুরুষাধীনতা এবং নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করাকেই শ্রেয় মনে করে। নারী তার নিজকে নিজ হতে মুক্ত করতে পারেনি আজও। মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত, উপার্জনক্ষম নারীও এ থেকে মুক্ত নয়।
আগে পুরুষ দাসী পেতো-যে দাসী লেখাপড়া জানতো না, জানলেও তা অল্প, নিজকে গুছিয়ে রাখতে পারতো না তেমন, সংসারও থাকতো প্রায় এলোমেলো, উপার্জন করে সংসারে শ্রীবৃদ্ধির প্রশ্ন তো ছিলোই না। আর এখন পুরুষ পাচ্ছে শিক্ষিত দাসী যে আবার রুপ-লাবন্যেও পুরুষের মনোরঞ্জনে মনোযোগী, পাচ্ছে উপর্জনক্ষম নারী-দাসী যার উপার্জনে সংসারে আসছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। লাভটা পুরুষেরই হয়েছে। নারীর লাভ হবার কথা ছিলো, হয়নি। শিক্ষা, উপার্জন এসব দিয়ে কিন্তু নারীরই লাভ হবার কথা ছিলো। এক্ষেত্রে পরিশ্রমটি নারীর হলেও লাভটি উঠিয়ে নিয়েছে সুচতুর পুরুষ তার একান্ত নিজের জন্যে। পুরুষের চাতুর্যই কেবল নয় নারীর সীমাহীন বোকামীও এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। পুরুষতন্ত্র রক্ষার জন্যে পুরুষ যে কেবল নারী বিরোধী শ্লোক তৈরি করেছে তা নয়, তৈরি করেছে নারীপ্রিয় শ্লোকও; যা আসলে নারীবান্ধব নয়। এ আসলে নারী বিরোধী শ্লোকের থেকে চরম নারী বিরোধী শ্লোক। নারী তার মনের মুক্তি ঘটাতে পারেনি। শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা নিয়ে উপার্জন করে এখনো কথা বলছে পুরুষের ভাষাতেই, চলছে পুরুষের নির্দেশ মতোই। ভালোবাসার নামে পুরুষ নারীকে করে চলেছে ক্রমাগত শোষণ, নারী এটাকে ভালোবাসাই ভাবছে, আসলে এটা কতোটা ভালোবাসা আর কতোটা পুরুষতন্ত্রে সচতুর সুদৃশ্য আবরণে পুরুষের তার নিজের ঘরে লাভ উঠানো-তা নারী বুঝতে পারবে তখনই যখন সে তার নিজের মতো করে চলতে চাইবে। বউ ততোক্ষণ ভালো যতোক্ষণ সে বিবাহিত পুরুষের চোখের দিকে তাকিয়ে তার নিজের জীবনটি যাপন করে। একবার শিক্ষিত উপার্জনক্ষম সব নারীরা নিজের মতো করে বাঁচতে শুরু করুক দেখি পুরুষ নারীকে কতোটা ভালোবাসে বা আদৌ বাসে কিনা!
উপার্জনক্ষম নারী বাইরে আসবে স্বাভাবিক। কিন্তু সচতুর আরেক ধরনের পুরুষ রয়েছে-যারা আবিস্কার করেছে ‘ঘরে বসেই উপার্জন করুন’। আর এতে কিছু নারীও বেশ লাফিয়ে উঠেছে ঘরে বসে উপার্জনের জন্যে। ঘরে বসে উপার্জনের প্রস্তাবকারী এবং ব্যবহারকারীর যুক্তিগুলি কতোটা পুরুষতান্ত্রিক তা এবার দেখে আসি। ঘরে বসে উপার্জনের সুযোগ হলে কি হবে? নারীরা বাইরে গেলে রোদে পুড়ে গায়ের রং-ত্বক নষ্ট হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা তো জানিই নারীর রং-ত্বক নারীর নিজের জন্যে নয়; পুরুষের জন্যে। ঘরে বসে উপার্জন করলে বাচ্চাকাচ্চার দেখাশুনা করে ‘মাতৃত্বই নারীর সার্থকতা’-এই শ্লোকটির যথার্থতা রক্ষার সুযোগ তৈরি হয়। যদিও সন্তান কখনোই নারীর নয়। ঘরে বসে উপার্জন করলে পুরুষের জন্যে গরম ভাত, গরম বিছানা দিতে বেশ সময় পাওয়া যাবে। গরম ভাত, গরম বিছানা ছাড়া পুরুষ ধরে রাখা কী চাট্টিখানি কথা! ঘরে বসে উপার্জন করলে পুরুষের পরিবারের সদস্যদের দেখভাল করাটাও সম্ভব হবে; নিজের আত্মীয়-পরিজনের খোঁজ নেয়াটা-দেখভাল করাটা নারীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না তো!
কতো সুবিধে ঘরে বসে উপার্জন করলে! বোকা নারী একবারও বুঝতে চায় না ‘ঘরে বসে উপার্জন’-এই আকর্ষণীয় মোহময় শ্লোক দিয়ে পুরুষ তাকে খাটিয়ে পুরো লাভটা তুলতে চাইছে নিজের ঘরেই। নারী ঘরে বসে উপার্জন করছে, বাইরে যাবার প্রয়োজন হচ্ছে না, নিতান্ত আত্মীয়-পরিজনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া ছাড়া; যেটুকু সামান্য প্রয়োজন হয় বাইরে বেরোবার তাও করে দিচ্ছে বিবাহিত পুরুষ বা তার পরিবারের পুরুষ অন্য কোনো সদস্য। নারীর নিজের জগৎ তৈরি হচ্ছে না, কোনো বন্ধু তৈরি হচ্ছে না; লেখাপড়া করাকালীন সময়ে যে ক’টা বন্ধু ছিলো তাও হারিয়ে গেছে সময়ের ফেরে। বিবাহিত পুরুষটি তো কখনোই বন্ধু হতে চায় না। তাহলে নারী কতোটা একলা হয়ে পড়ে-এ বিষয়টি যখন সে বুঝতে পারে তখন আর একাকীত্ব ঘোচানোর কোনো সুযোগ থাকে না। নারীর নিজের কোনো জগৎ নেই, পুরুষের জগৎই তার জগৎ। বন্দী, নিঃস্ব মানুষের কোনো জগৎ থাকে না, মানসিক বিকাশ ঘটে না। অন্য আর দশটা প্রাণীর মতোই তার জীবন? অন্য আর দশটা প্রাণীর মতোও নয় তার জীবন, আগে নারী বন্দী থেকে ঘর-গেরস্থালীর কাজ করতো; কোনো লাভ ছিলো না তার। আর নারী এখন সম্মুখীন হয়েছে ভয়াবহ এক ক্ষতির। ঘর-গেরস্থালীর কাজ তো আছেই, সাথে যোগ হয়েছে উপার্জন করা। নারীর কাজ দিগুণ হয়েছে এতে লাভ হবার কথা ছিলো নারীর কিন্তু হয়েছে লোকসান। হাতে গোনা কিছু নারীই কেবল দিগুণ পরিশ্রমের লাভ নিজের ঘরে উঠাতে পেরেছে।
নারীর মনের মুক্তি যতোদিন না ঘটবে নারীর কেবল অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে নারীর মুক্তি আসবে না আবার অর্থনৈতিক মুক্তি যতোদিন না হবে মনের মুক্তিও ঘটবে না। অর্থনৈতিক মুক্তি এবং মনের মুক্তি যুগপৎ না ঘটলে নারীর মুক্তি অসম্ভব। অর্থনৈতিক মুক্তি এবং মনের মুক্তি যুগপৎ ঘটানো নারীর জন্যে অপরিহার্য।