চৈতী আহমেদ এর আহবানে অন লাইন পোর্টাল নারী’র পেজে লাইক দিতেই দেখি লীনা হাসিনা হক এর লেখা -পূর্ব আফ্রিকার ডায়রী-২। কয়েকদিন আগেই আমি -পূর্ব আফ্রিকার ডায়রী-১ পড়েছিলাম তাই দেরি না করে পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু একটু পড়ার পরেই আমার চোখ লেখায় স্থির করতে পারছিলাম না।
লীনা হাসিনা হক আমার একটু হাল্কা পাতলা পরিচিত। পরিচয়ের সময়কাল প্রায় ৩ দশকের মত হবে। ইদানিং যোগযোগ কালেভদ্রে, জীবন জীবিকার তাগিদে। আমরা থাকি অনেক দূরে দূরে। আজকে তাঁর লেখা এক প্যারা পড়ার পরে আমি হারিয়ে যাই। মনে হয় এ কোন অচেনা লীনা হাসিনা হক! কার লেখা পড়ছি আমি। যার লেখা কখনো থাকে দ্রোহের আগুনে ঝলসানো, কখনোবা এমনি করুণ রসে জারিত যে, পড়তে পড়তে অনেকের চোখ নোনা জলে ভিজে যায়। ওর কোনো কোনো লেখায় মেঘলা মনের জানালা খুলে হাস্যরসে মাতায়, অন্তত আমাকে। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করতে আমার আবার বুদ্ধির গোড়ায় ধূয়া দিতে হয়। সেটা সারতে সারতেই যোগটা মিলে গেলো। দূর বিদেশে একটা উঁচু স্তরের উন্নয়ন কর্মীর বাসার কিশোরী সহকারী অলিভিয়ার অবস্থা দেখে লীনা হাসিনার আচরণে আমিও কিছুটা থমকে গেলাম।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাংলার ষড়ঋতুর মতো মানুষের মনের আকাশের রঙ বদলায়। কখনো মেঘ, কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টির মতো। যতদুর জানি লীনা হাসিনা হক একা একা থাকেন বহু দূর দেশে যার পুরো মন জুড়ে থাকে তাঁর পরিবারের সবার আবছায়া চেহারার ছবি, ভারি মেঘের ছায়ার মতো। কাজের চাপের ঘর্ষণে স্মৃতির পাতায় আঁকা অনেক ছবি মাঝে মাঝে সাময়িক হয়তো আবছা হয়ে যায়। কিন্তু চেতনায় জল পড়লে আবার তা জলজল করে ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে। অসুস্থ অলিভিয়ার অবস্থা দেখে লীনা হাসিনা মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা মাতৃত্ব জেগে উঠেছে। তাই অলিভিয়াকে সে ডাক্তারের কাছে নিতে চায়। ওর অবচেতন মন ওকে এমন করেছে, নিজে কখন যে সে অলিভিয়ার মা হয়ে উঠেছে তা সে হয়তো নিজেও জানে না। এমন অনেক সময় হয়, হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বাংলার আর দশটা পুরুষ মানুষের মতো আমিও সেই একই প্রজাতির মানুষ। আমি কখনো প্রেমিক পুরুষ কখনোবা আসর মাতানো তুখোড় বন্ধু, কখনো সমাজকর্মী, সচেতন নাগরিক, আবার কখনো একজন বাবা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের মতো অনেকের পিতৃসত্তার প্রভাব অনেক প্রবল হয়ে ওঠে সব কিছু ছাপিয়ে।
গতকাল থেকেই আমার মনটা কেমন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। যখন দেখলাম চট্টগ্রামের সানসাইন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়াকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তার পর থেকে। আমি ভাবতেই পারছি না কেনো এমন করা হলো। আরে বোকা মেয়ে কেনো এমন করলি! হয়তো বদমায়েশটা বলেছিলো তোকে অনেক ভালোবাসা দেবে, দেবে আদর। কিন্তু তুই একবারও কেনো ভাবলি না, তর মা-বাবা তোকে এতবড় করতে কত লক্ষ আদর আর ভালোবসা দিয়েছে সেই জন্মের পর থেকে আজ অব্দি! জানিস না বাবা-মায়েরা বিশ্বাস করে যে, ‘তাঁরা মেয়ের বাবা সারাজীবন, কিছু ছেলের বাবা-মা সম্ভবত ছেলের বিয়ের আগে পর্যন্ত’।
বোকা মেয়ে তুই তো ভালো স্কুলে পড়িস। তোর কেনো একবারের জন্য মনে হলো না যে, একটা কিশোর আরেকজন কিশোরীর সারা জীবনের দায়িত্ব কীভাবে নিতে পারে! যতই সে অনিশ্চয়তার কপাট খুলে কপট নিশ্চয়তার মনি মানিক্যের পাহাড় দেখাক না কেনো! এতো আকাশ সংস্কৃতির যুগ! তথ্য ভান্ডার তো হাতের মুঠোয় তোমার বেটা! তোমার তো ভাষার সঙ্কট ছিলো না। তো কেনো? আমরা যারা বয়সী তাঁদের কিছু ভুল হতেই পারে যেমন ভুল করেছিলো আমাদের বাবা-মা’রা। চাইল্ড সাইকোলজী না বুঝে অনেক অন্যায় করেছে আমাদের উপর।
আর বাবা-মা’কেও বলি- কেমন বাবা-মা তোমরা যে, তোমার একটা মেয়েকে দুনিয়ার হাল হকিকত বুঝাতে পারো না! শিখিয়ে দিতে পারো না কী কী সাবধানতা নিতে হয় টীনএজ সময়ে! কেনো তোমরা ছেলে-মেয়ের বন্ধু হয়ে উঠতে পারো নি। এতো টাকাপয়সা দিয়ে কী হবে তোমাদের, যদি তা তোমার সন্তানদের জন্য কাজে না লাগে! বৃথা তোমার পিতৃসত্তা। এখন তো তোমাদের জীবনটা ‘ষোল আনাই মিছে’ হয়ে গেলো।
বাবা-মা হবার আগে কেনো বাবা-মায়েরা বেড়ে ওঠা টিন এজ ছেলে মেয়েদের মানুষ করার কৌশলটা জেনে নেয় না, কেনো জীবন থেকে, সমাজ থেকে শিক্ষা নেয় না! বাবা-মা’কে এটা জানতেই হবে যে, শারীরিক পরিবর্তনের আবর্তে পড়ে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে বলে অনেক প্রি টিন ও টিন এজ ছেলে-মেয়েরা স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা ছাড়াই অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে আর অস্বাভাবিক আচরণ করে। ওদের কথায় সাধরণতঃ ভালোবাসার বিষয়ে নানা জিজ্ঞাসা থাকে যা বড়রা সবাই আঁচ করতে পারার কথা। তাই এমন পরিস্থিতিতে আমাদের প্রি-টিন ও টিন-এজ ছেলে-মেয়েদের জিজ্ঞাসার জবাব দেয়ার দেবার জন্য প্রত্যেক বাবা-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যকে দায়িত্ব নিতে হয়।
আমাদের প্রি টিন ও টিন এজ ছেলে-মেয়েরা যখন কোনো সংগত কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে কারো প্রশংসা বা কারো সম্পর্কে জানার বেশী আগ্রহ দেখায় সে ক্ষেত্রে বেশী দেরি না করে ওদের সাথে আলোচনায় বসা জরুরি। কেনো আমাদের প্রি টিন ও টিন এজ ছেলে-মেয়েরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে এত আগ্রহী তার বিস্তারিত খবর নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন হতে পারে যে, যার বিষয়ে জানতে চাওয়া হচ্ছে তার কোনো কথা বা আচরণ আমাদের প্রি-টিন ও টিন-এজ ছেলে-মেয়েদের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে বলেই হয়তো সে এ বিষয়ে জানতে চায়। বিষয়টি খোলসা করে গেলে আমরা সবাই নিরাপদ হই। এই বেসিক জিনিষ মা-বাবাকে জানতেই হবে।
তাসফিয়াকে হত্যার খবর শোনার পর থেকে নিজেকে মাঝে মাঝে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে কারণ আমিও তো একজন বাবা। না জানি মানুষের প্রতি, বাবাদের প্রতি কত ঘৃণা, অভিমান আর কষ্ট নিয়ে ভাবাবেগী তাসফিয়া আত্মবলিদান করেছে। আমি প্রায় ১০০ ভাগ নিশ্চিত বাবা-মায়ের দেওয়া অবিবেচনাপ্রসূত মানসিক আঘাতের বিপরীতে চরম অভিমানে, একটু ভালোবাসার আশায়, আর একরাশ বিশ্বাসের প্রতিশ্রুতির ফাঁদে বিভ্রান্ত হয়েই তাসফিয়া ঐ পশুটার সাথে গেছে। কতটুকুই আর বোঝার বয়স এই ছোট্ট মেয়েটার! তাসফিয়া তো আমার মেয়েও হতে পারতো, তখন কী করতাম আমি!