তসলিমার নাসরিনের যে সত্তাটা পুরুষের জন্য কাঙালপনা দেখায় সেটিই মানুষের প্রাকৃতিক সত্তা। তসলিমা বা আর কেউ রোবট হলে হয়তো থাকতো না এই কাঙালপনা। সেটা নারীর বেলাতেও যেমন সত্য পুরুষের বেলাতেও সত্য। এই কাঙালপনাটা চাতকের জল তৃষ্ণার মতো। এই কাঙালপনাকে পুরুষ দুর্বলতা ভেবে নিলামে তুলে দেয়, নতুবা বদলে দিতে চায় এর আকার আকৃতি তাদের পছন্দ মতো ছাঁচে।
এই বিকিকিনিতে যে সব নারী বিকিয়ে যায় বা ছাঁচের মতো নিজেকে আটিয়ে নেয়, মানিয়ে নেয়, তারা হলো সমাজের চোখে ভালোমেয়ে! আর যারা বিকোয় না, আঁটে না, তারা হয় তসলিমা নাসরিন।
আমি অবাক হয়ে ভাবি তসলিমা নামটি এখন এই সমাজের পুরুষেরা নারীর বিরুদ্ধে গালি হিসেবে ব্যবহার করছে! তসলিমা নামটি যেন স্বাধিকারকামী নারীর মুখের সামনে সেই অগ্নিশলাকা, যে অগ্নিশলাকা সাপুড়েরা বিষমারার জন্য বিষাক্ত সাপের মুখের সামনে ধরে। ‘তসলিমা হইতে চাস?’ বললেই, যুক্তির ফণা তোলা নারীটি ফণা গুটিয়ে সেই নারীটি হয়ে যায়, যে নারীটি সাপুড়ের সামনে যেমন বিষহারা সাপটি, সাপুড়ে নাচায় সে নাচে। তারা তসলিমা হতে চায় না, বিকিয়ে যাওয়াকেই মনে করে সার্থকতা, তখনই তারা হয়ে ওঠে নারী, হয়ে ওঠে পুরুষতন্ত্রের খাম্বা। তারা ব্যস্ত থাকে জীবনভর পুরুষতন্ত্রের মনযোগাতেই। তসলিমা এই বিকিয়ে যাওয়াকে দেখে অসম্মান হিসেবে।
এই নারীরা ইতর প্রাণীর চেয়েও নিজেকে সস্তা করে তোলে নিজেদের বস্তা বস্তা আটা ময়দা ঘষে রূপসী করে তুলে পুরুষ ভজনা করে। কারণ ইতর প্রাণীর পুরুষগুলো সাজসজ্জা করে ভজনা করে নারী ইতর প্রাণীটির, উদাহরণ টানা যায়- ময়ূরটি নিজেকে কিভাবে সাজিয়ে তোলে ময়ূরীর মন পাবার জন্য? সিংহকেও সুন্দর হয়ে উঠতে হয় সিংহীর কাছে ঘেষবার জন্য। মানুষের ক্ষেত্রেই এর শুধু ব্যতিক্রম, মানুষ পুরুষের এই সব বালাই নেই, তার লিঙ্গ আছেতো ব্যস আর কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। মানুষ নারীর চেয়েও আত্মমর্যাদাবোধ নারী ইতর প্রাণীটির প্রখর। পরিপাটি হবে পুরুষ নারী উভয়েই সেটা নিজের জন্যই। কার্যত দেখা যায় একটা বোম্বা টাইপ চুলে জটা পরা, গায়ে বোটকা গন্ধওয়ালা হলেও একটা পুরুষের জন্য নারী তার ত্বকের উপর চালাচ্ছে স্টীম রোলার, চুলের উপর চালাচ্ছে সকাল বিকেল বুলডোজার। প্রকৃতির নিয়মটাও তারা মানতে চাইছে না। তারপর বিউটিপার্লার থেকে যে বেরিয়ে আসছে সে হলো, না মানবী না রোবট। করুণা এই সব নারীর জন্য।
সম্ভবত “সাত পাকে বাঁধা” ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় না কার একটা উপন্যাসে পড়েছিলাম বেশ কম বয়সে-“যে আমায় কুৎসিত দেখে ভালোবাসলো না সে কি আমায় সুন্দর দেখে ভালোবাসবে?” হুবহু মনে নেই তবে ভাবার্থটা এই রকমই, এই বলে নায়ক ফিরিয়ে দেয় নায়িকাকে। শুরু থেকেই সাহিত্যের সাম্রাজ্য দাপিয়ে বেড়িয়েছে পুরুষের এই দম্ভ। সমাজের দাবী, কুৎসিত হলেও একজন নারীকে ভালোবাসতে হবে সেই কুৎসিত পুরুষটিকে, পুরুষটি যদি ব্যাঙের রূপে আসে তবে তাকেও। রূপকথার মোড়কেও এই ধারণাই নারীর মেধা মননে গেঁথে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। এই সব রূপকথাতেও দেখি এক রাজার অনেক রানী! অথচ পুরুষ কোনো কুৎসিত নারীকে ভালোবেসে কোনো নজির স্থাপন করেনি এই সমাজে বা সাহিত্যে।
এই সমাজ সাহিত্যে কি দেখি? দেখি দীর্ঘ জীবন, হয়তো সেটি ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছরেরও হতে পারে, এক সাথে এক ছাদের নীচে কাটিয়েও নারীটি যদি কোনো রোগে শোকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে পুরুষটি তার চিকিৎসা বা নিরাময় চেষ্টা না করে ভাবতে বসে যায় কি করে তার দেখভাল হবে? কে তাকে সেবা শুশ্রুষা করবে?
এই সমাজই বাতলে দেয় সমাধান-আবার বিয়ে করো। সব বয়সে সব অবস্থায় নারীর উপর তোমার অধিকার বলবৎ আছে। তাই সে শয্যাশায়ী স্ত্রীকে ভাড়ার ঘরে অথবা অন্যত্র ছুঁড়ে ফেলে বসে পড়ে বিয়ের পিড়িতে। আর স্ত্রীটি যদি মারা যায় তো প্রবাদইআছে ‘ভাগ্যবানের বৌ মরে’।
একই সমাজে স্বামী মরলে বৌটি হয়ে যায় বাড়ির পোষা কুকুর বেড়ালের চেয়েও অপাংক্তেয়। সম্প্রতি আমার এক আত্মীয়া যার পতিভাগ্য (তাঁর পতির দিক থেকেই সে আমার আত্মীয়া) নিয়ে আমরা অসুয়ায় ভুগেছি, এমনি প্রেম তাদের, এমনই তাদের বোঝাপড়া, হঠাৎ মারা গেলেন আত্মীয়াটি, আমাদের হতভম্ব করে দিয়ে প্রায় চল্লিশ বছরের সংসার জীবনকে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখে আমার প্রিয় আত্মীয়টি ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিয়ে করে ফেললেন। সেই থেকে আমি আজ অবধি লজ্জায় আমার অতিপ্রিয় আত্মীয়টির সামনে দাঁড়াতে পারিনি। অথচ সে নির্বিকার লজ্জাহীন। তার বিবাহিত দুই ছেলে মৃত মায়ের অপমানে সহ্য করতে না পেরে বেছে নিয়েছে চিরস্থায়ী প্রবাস।
বিয়ের পরে আমরা তাঁকে পরিত্যাগ করায় তিনি একদিন আমাকে ফোন করেন, রাগে ঘেন্নায় কথা বলতে পারছিলাম না। শুধু বললাম তুমি এটা কি করে পারলে? তিনি বললেন-আমি অসুস্থ, কে আমাকে দেখাশুনা করবে? অথচ আমরা জানি তার ছেলেরা তাকে যথেষ্ট যত্ন করতো। আমি তাকে ধমকে বললাম
-আচ্ছা তুমি যদি আগে মারা যেতে, মামী যদি তখন দেখভালের দোহাই দিয়ে বিয়ে করতো তখন তুমি এটাকে কিভাবে দেখতে?
সে তখন আমতা আমতা করে বললো
-না বাচ্চারা আছে সে এটা কিভাবে পারবে? মেয়েরা এটা করতে পারে না?
-বাচ্চা কি শুধু তাঁর তোমার নয়?
মামা এবার স্বরূপে ফিরলেন
-কি বলিস? তোর খালি বাজে কথা বলা স্বভাব
-মামীর সম্মানে তুমিতো আর কিছুদিন অপেক্ষা অন্তত করতে পারতে?
তখন আর তাঁর মুখে কথা নেই।
পরস্পরের জন্য নারীর অথবা পুরুষের কাঙালপনা থাকবেই এটা প্রকৃতি নির্ধারিত। এই কাঙালপনার অধিকারটিকেও পুরুষ ভাবে শুধু তারই। তসলিমা দেখিয়ে দিয়েছে। এই কাঙালপনা নারীরও আছে। তসলিমার যেমন আছে তেমনি অন্য নারীদেরও আছে। অন্যদের সেই সাহস নেই যে বলবে আমারও শরীর আছে সেই শরীরজোড়া আছে সুন্দরের জন্য অসীম তৃষ্ণা। তসলিমা তাই সাহসের প্রতিভূ হয়ে উঠেছে। সেটা কোনো পুরুষ স্বীকার করুক আর নাই করুক। এই জন্যই তসলিমাকে তাদের ভয়। তসলিমাকে দেখে তাদের খোঁয়াড়ের নারীগুলো না আবার বেরিয়ে আসে। তাই তারা তসলিমাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে পরিত্রাণ খোঁজে। তাই তসলিমার মাথার দাম নির্ধারণ করে। অথর্ব সমাজ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।
এই সমাজের নারীদের পায়ে আছে এমন এক বেড়ি স্বামী মরলো কি ছাড়লো, তাকে হয়ে যেতে হবে কামনা বাসনাহীন। নারী যদি আবার শরীর নিয়ে কাঙালপনায় ভোগে তো তার নাম হয়ে গেলো বারো ভাতারী, পুরুষের জন্য এমন কোনো খেতাব নেই পৃথিবীতে, তখনও পুরুষ পুরুষই থাকে যে পুরুষ যত নারী জোটাবে জীবনে সেই পুরুষ তত বীর্যবান!
এমন পুরুষেরই আরাধনা করে খোঁয়াড়ের নারীগুলো। আমি অনেক নারীকেই বলতে শুনেছি যে অন্য নারীকে বলছে বারোভাতারী, শিক্ষিত পরিবারেই শুনেছি, নারীর প্রশ্নে এই সমাজ বরাবরই আদীম। প্রগতি শুধু পুরুষের।
এই ২০১৭ তে পা রেখেছে পৃথিবী, আজও খুব হেরফের নেই কিছু। পুরুষের মধ্যে নারীর জন্য যা আছে তা ভালোবাসা নয় কিছুতেই, সেটিই তসলিমার উপলব্ধি, অন্য নারীদের উপলব্ধিও এর অন্য রকম নয়। তবু নারী ছাড়া পুরুষের কাঙালপনার শেষ নেই, একদিনও চলে না তাদের নারী ছাড়া, তাই কাঙালপনাকেই রূপায়িত করে তারা ভালোবাসায়, ভালো না বাসাকেই তারা নাম দেয় ভালোবাসা। তাহলে নারী কেনো লুকিয়ে রাখবে এই কাঙালপনা?
পুরুষের চেয়ে নারীর অতিরিক্ত আছে এক নৃ্তাত্বিকের মন, যে পুরুষের শরীর খুঁড়ে খুঁড়ে খোঁজে ভালোবাসা, যা থেকে প্রকৃতিই হয়তো বঞ্চিত করেছে পুরুষকে, তাদের শুধু শরীর হলেই চলে যে কোনো নারীর শরীর, নারীর চলে না, নারী চায় ভালোবাসা সমেত শরীর -এই ‘দ্য সার্চ’ নারীর নিজস্ব মরীচিকা।