ফারজানা হোসেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একই বিভাগে এম.ফিল গবেষনায় রত।

বাসের সংরক্ষিত সিট ও কিছু জানা কথা

যতটুকু বোঝা যায়, নারীদের প্রতি পুরুষের হিংসার অন্যতম একটা ফ্যাক্ট হলো "বাসের সংরক্ষিত সিট।" যখনই আর যেখানেই কোনো অধিকার বা সমাধিকারের প্রশ্ন উঠে তখন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এই ইস্যুটা উঠবেই। খাইতে গেলেও সিটের খোটা! ছাড়তে গেলেও সিটের খোটা! আচ্ছা আমরা কি ভাবতে পারি কোনো কারণে এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটা নেয়া হয়েছিলো?

একটু ভেবে দেখেন। উন্নত বিশ্বে এরকম কোনো সুবিধা নারীদের জন্য নাই। কেননা নারীরা সেখানে সুবিধাবঞ্চিত না। আমাদের গণপরিবহণে যে সিটগুলো সংরক্ষিত তা নারীদের জন্য নয়। আপনার অক্ষরজ্ঞান থাকলে আপনি অবশ্যই জানেন যে, সিটগুলো নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত। তার মানে এটাই আমরা শিশু আর প্রতিবন্ধীদের কাতারেই আছি। কিছু পুরুষতান্ত্রিক মহিলারা যে আবার এ সুবিধার ফায়দা লুটে না, তা বলা যাবে না। এমন অনেক দেখেছি যেখানে বাবার বয়সী অসুস্থ ব্যক্তিকে কথিত মহিলা সিট থেকে উঠিয়ে শক্তপোক্ত কোনো মহিলা সে সিট গ্রহণ করলো। তার অধিকার কিনা! এখানে ঢালাওভাবে নারী শব্দটার ব্যবহার করা ঠিক হয় নি। এটা যেমন বিভ্রান্তিকর তেমনি অসম্মানজনক। আমি নারী বলেই কি আমি শিশুর মতো দুর্বল হবো? নারী বলেই কি ইম্পায়ার্ড হব? ঐ সিটগুলোর "নারী" বা "মহিলা"দের জন্য না বরং বৃদ্ধ, অসুস্থ, গর্ভবতী নারী বা অন্য যে কোনো ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত রাখা ভালো ছিলো।

তবে আমরা বাঙালি কিনা!

১. আচ্ছা, সংরক্ষিত সিট ফিল হওয়ার পর যদি কোনো বয়স্ক নারী, বৃদ্ধ, প্রেগন্যান্ট, অসুস্থ ব্যক্তি বা কানা-লুলা ব্যক্তি যদি বাসে উঠে, তারা কি সিট পাবে? কয়জন মহান ব্যক্তি নিজের আসন ছেড়ে তাদের বসতে দিবেন?

২. "সিট খালি নাই, মহিলা উঠাইস না"। যারা লোকাল বাসে যাতায়াত করেন বাক্যটা তাদের অত্যন্ত সুপরিচিত। এখন রোদ হোক, বৃষ্টি হোক, তুফান হোক, সিট না থাকলে মহিলাদের অসম্মান করা যাবে না। ঐ মহিলা মরুক রাস্তায়, ভিজুক বৃষ্টিতে! তাদের দাঁড়িয়ে বাসে উঠানো যাবে না! অসম্মান!

৩. মহিলাটা উঠেই গেলো সিট ছাড়া বাসে। গেট থেকে শুরু করে ওয়ান বাই ওয়ান পুরুষের ধাক্কা খেয়ে কোনোমতে একটা পজিশনে দাঁড়ালো। নতুন কাহিনী শুরু। বাস ব্রেক না মারলেও ডানের বা বামের লোকটার ব্রেক লাগছে ঠিকই। এখন সেই মহিলার আর কি করার? নিজ দায়িত্বে সিট ছাড়া বাসে উঠার বোনাস হিসেবে ধাক্কা আর গুতা মুখ বুজে গ্রহণ করাই কাম্য।

৪. মাঝে মাঝে ডানের বা বামের লোকটা উপকারী টাইপের হয়। তারা শুধু ধাক্কাই খায় না, অসহায় মহিলাটাকে এমনভাবে প্রোটেক্ট করার চেষ্টা করে যেন তার ঘরের বউ! কখনো তার কুনুইটা ব্যালেন্সড থাকে না, কখনো সে নিজেই। কখনো পিঠে ধাক্কা খায়, কখনো বুকে। এটাই স্বাভাবিক। তবে এই স্বাভাবিক বিষয়টা সইতে না পেরে মহিলা কিছু বললেন তো মরলেন! লেগে গেলো বাসের যাত্রীদের মহাযুদ্ধ। 

যাত্রী বনাম ড্রাইভার-হেল্পার। স্লোগান একটাই "সিট ছাড়া খাড়াইয়া মহিলা উঠাইসস কেনো?"

৫. এই মহাযুদ্ধে আবার যদি সেই মহিলা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে যায়, তাহলে তো কথাই নাই। আরেকটা স্লোগান, "মহিলা মানুষ, ভীড়ের মধ্যে উঠছেন কেনো?" এর কোনো উত্তর নাই। আর কেউ যদি উত্তর দিয়েই ফেলে সে পায় একটা বিশেষ উপাধি, "উগ্র।" আর কেউ যদি এসব নিয়ে নারীদের পক্ষে কোনো যুক্তি দাঁড় করাতে চায় সে হয়ে যায় "নারীবাদী।"

৬. এখানেই শেষ না। বাসে কমন সিটে বসলেও সব সময় রেহাই পাওয়া যায় না। আর ৩৫+ কারোর পাশে বসলে তো কথাই নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই এসব ঘটনা শেয়ার করে অনেকেই পোস্ট করে। আমরা দেখি, পড়ি, ক্ষোভে ফেটে যাই তারপর ভুলে যাই নতুন আরেক সেইম ঘটনার আগমনে।

এইগুলা প্রতিদিনকার ঘটনা। অহরহ ঘটে যাওয়া ঘটনা নতুন কিছু না। বাসে সংরক্ষিত সিট রাখলেই কি আর না রাখলেই কি! আমরা সবখানেই আতঙ্কিত। শিশু, বালিকা, কিশোরী, তরুণী, মধ্যবয়স্কা, এমনকি বৃদ্ধা, কারোরই রেহাই নেই। এমন অরক্ষিত পরিবেশে সংরক্ষিত ৯টা আসন দিয়ে দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে কি আর এমন সুবিধা দেয়া যাবে?

সংরক্ষিত সিট আমরা কখনই চাই না। আমরা মুক্ত হাওয়া চাই। উন্নত বিশ্বের নারীদের মতো আমরাও সবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে চাই।

3008 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।