বন্যা আহমেদ

সম্পাদক, মুক্তমনা।

এত জাত-ফাত, ছুঁৎ-অচ্ছুৎ, ফর্সা-কালো, ধর্ম-অধর্মের ভেদাভেদ করে লাভটা কী হলো?

এত জাতপাত, ব্রাহ্মণ-শূদ্র ছুঁৎ-অচ্ছুৎ, কে গরু খায় আর কে শুয়োর, কে ফর্সা, কে কালো, কে পৈতা পরে আর কে টুপি – এ নিয়ে নিরন্তর মারামারি, কাটাকাটি, দাঙ্গাদাঙ্গির পরে দিন শেষে কী জানা গেলো? নাহ আমরা নাকি তিন ঐতিহাসিক গোষ্ঠীর শঙ্করমাত্র –যেভাবেই কড়ি গুনি না কেনো, আমাদের জিনের ‘ষোল আনা’টা ভরেছে এই তিন দলের আনা-আনা অবদানে। কেউ কম, কেউ বেশী; অঞ্চলের উপর ভিত্তি করে কেউ এর সাথে মিশ খেয়েছে বেশী, কেউ বা ওর সাথে।

আমাদের, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অধিবাসীদের উদ্ভব ঘটেছে এই তিন জনগোষ্ঠীর মিলনের ফলে – ৫০-৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে এসে ভারতে বসতিস্থাপনকারী প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক গোষ্ঠী (যাদেরকে আমরা এখন আদিবাসী বলার চেষ্টা করি), খৃষ্টপূর্ব ৫-৭ হাজার বছর আগে পারস্য থেকে আসা ‘চাষাভুষা’ মানুষ আর তারপর খৃষ্টপূর্ব ১-২ হাজার বছর আগে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চল থেকে আসা ‘পশুপালকদের’ দল।

যাক বাবা, আমার ছোটবেলার পাড়ার খালাম্মাদের একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলো এতদিনে, এত বড় বড় গবেষকদের কাজের ফলে! ওনাদের সেই হাহাকার, ‘আহারে আপা আপনার দুইটা মেয়ে কী সুন্দর ফর্সা, বড়টা কালো হইলো ক্যামনে’র উত্তর পাওয়া গেলো – বংশগতির মিক্স-আপের খেলায় আমার গায়ের রঙের জিনে নিশ্চয়ই অপেক্ষাকৃত ফর্সা পারস্য ‘চাষী’ এবং তার চেয়ে আরেকটু বেশী ফর্সা স্তেপবাসী ‘মেষপালকদের’ চেয়ে ভারতীয় আদিবাসীদের জিনটাই বেশী পড়ে গেছিলো!

ফাজলামি রেখে এবার তাহলে এই গুরুগম্ভীর গবেষণাটা নিয়ে দুটো কথা বলি। বিখ্যাত বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২ জন গবেষক (জীববিজ্ঞানী, জেনেটিসিস্ট, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদসহ বিভিন্ন শাখার গবেষকরা একসাথে হয়েছেন এখানে) বংশগতীয় (genetic) এই গবেষণাটিতে কাজ করে আসছেন অনেক বছর ধরে। তাদের সেই কাজের একাংশের উপর ভিত্তি করে সম্প্রতি এই রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়। ওনারা ইরান, আফগানিস্তান এবং তার উত্তরের উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাকাস্তানের মতো দেশগুলো থেকে সংগৃহীত ৬১২ জন প্রাচীন পূর্বপুরুষের ডিএনএর সাথে এখনকার দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ২৪৬ টি গ্রুপের মানুষের ডিএনএর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। গবেষণার সারমর্মটা মোটামুটি এরকম:

১) সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিলো বহু আগে আফ্রিকা থেকে আসা প্রাচীন শিকারি-সংগ্রাহক গোষ্ঠী এবং পরে পারস্য থেকে অভিবাসিত গোষ্ঠীর সমন্বয়ে। এদেরকে সিন্ধু উপত্যকার পূর্বপুরুষ (Indus Valley ancestors) হিসেবে অভিহিত করা হয়। পারস্য থেকে আসা এই নতুন জন্যগোষ্ঠীদের আগমনের পূর্বেই সম্ভবত ভারতে কৃষি কাজের সূচনা হয়েছিলো, তবে এদের আগমনের পরে সিন্ধু উপত্যকায় কৃষিকার্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। এরাই বোধ হয় পশ্চিম এশিয়া থেকে ধানচাষের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছিলো।

২) এক-দুই হাজার খৃষ্ট পূর্বাব্দে স্তেপ অঞ্চলের প্যাস্টোরাল বা পশুপালক গোষ্ঠীর মানুষেরা উত্তর-পশ্চিমে ইউরোপের দিকে আর এদিকে দক্ষিণ-পুর্বে সিন্ধু উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এদেরকেই আমরা আর্য বলে চিনি।

৩) আর্যদের সাথে সিন্ধু উপত্যকার মানুষের মিশ্রণের ফলে দুটো ব্যাপার ঘটে:

ক) ধারণা করা হয় যে সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে খৃষ্ট-পূর্ব দুই হাজার বছরের দিকে বেশ বড় কিছু পরিবর্তন ঘটছিলো। কিন্তু কেনো ঘটেছিলো সেটা এখনো একটা রহস্য। অনেকেই মনে করেন সে সময়ে জলবায়ুগত সমস্যার ফলেই হয়তো সেখানে এই পরিবর্তনগুলো ঘটেছিলো – একদিকে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে আবার অন্যদিকে শুরু হয় উত্তর থেকে আসা আর্যদের অভিবাসন। সে সময়ে সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীদের যে অংশটি উত্তরাঞ্চলে থেকে যায় তারা আর্যদের সাথে মিশে জন্ম দেয় উত্তর ভারতীয় পূর্বপুরুষদের (Ancesteral North Indians or ANI)।

খ) আর ওদিকে এদের আরেক অংশ দক্ষিণের দিকে সরে যেতে থাকে। এরা তেমনভাবে আর্যদের সাথে মিশ খায় নি। এরাই আমাদের দক্ষিণ ভারতীয় পূর্বপুরুষদের (Ancesteral South Indians ba ASI) জন্ম দেন। এদের উত্তরপুরুষেরাই পরবর্তীতে আদিম ভারতীয়দের সাথে মিশতে মিশতে আরও পূর্বদিকে বসতি স্থাপন করতে থাকেন।

৪) তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, আর্যরা আসার আগে সিন্ধু উপত্যকার এই প্রাচীন পূর্বপুরুষেরাই আমাদের সবার পূর্বপুরুষ যারা পরবর্তীতে আরও অনেক জাতির সাথে মিশ খেতে খেতে আজকের দক্ষিণ এশিয়ার মূল জনগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে। পৃথিবীর বেশীরভাগ জনগোষ্ঠীর মতোই আমরা সবাইও দিনশেষে একগাদি ‘ভ্যাজালে’ ভরা শঙ্কর বই আর কিছু নই ??।

৫) কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও, বাংলাদেশী পাঠকদের কথা মনে করে, প্রফেসর রিচার্ড ইটনের বিখ্যাত গবেষণার কথাটা একটু উল্লেখ না করে পারছি না। আগে যে ধারণাটা ছিলো যে, বাংলাদেশীদের বেশির ভাগ মানুষ নিম্নবর্নের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছিলেন তিনি তা ভুল বলে প্রমাণ করেন। উনি দেখান যে, এগার’শ-বার’শ সাল থেকে দিল্লীর মুসলমান শাসকেরা bibhinn মুসলমানকে (এবং সেই সাথে কিছু ব্রাহ্মণকে) জায়গীর দিয়ে পূর্বের বদ্বীপ অঞ্চলের জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করতে পাঠাতে শুরু করে। আর তখন থেকেই স্থানীয় আদি ভারতীয় শিকারি-সংগ্রাহক গোষ্ঠীর(এরাই সম্ভবত জায়গীরদারদের জন্য জঙ্গল পরিষ্কার করা এবং কৃষিকাজগুলো করতো) অধিবাসীরা সচেতন-অসচেতনভাবে, শত শত বছরের প্রক্রিয়ায়, মুসলমানদের আচার-ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। ক্রমান্বয়ে দুই গোষ্ঠীর সংমিশ্রণও ঘটতে থাকে। এ জন্যই আমাদের দেশের মুসলমানদের মধ্যে এত আদিম রীতিনীতির প্রচলন দেখা যায়। ১৮৭০ বা ১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে প্রথমবারের মতো জানা যায় যে, পূর্ববঙ্গে হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেশী, এবং সেটা দেখে সবাই খুব অবাকও হয়েছিলেো। এরপর থেকেই ধারণা করা হতো যে, নিশ্চয়ই নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই দলে দলে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছিলো যদিও এর কোনো ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাওয়া যায় নি। হয়তো ভবিষ্যতে বংশগতীয় গবেষণা থেকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছান সম্ভব হবে।

সে যাই হোক এই গবেষণাটিতে ফেরত যাই। এর ফলে কিছু মিথও ভেঙ্গেছে নতুন করে, যেমন ধরুন,

১) আজকাল ভারতের হিন্দু জাতীয়বাদীদের খুব পছন্দের একটি তত্ত্ব হচ্ছে আউট অফ ইন্ডিয়া থিওরি। যেখানে বলা হয় যে, আর্যরা ভারতের আদিম অধিবাসী এবং ভারত থেকেই তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে উন্নত সভ্যতা ছড়িয়ে দিয়েছিলো। এই গবেষণা প্রমাণ করে যে, এই নব্য হিন্দু/আর্য জাতীয়তাবাদী তত্ত্বটি সম্পূর্নভাবে ভুল।

২) হিটলার বা ইউরোপের ইদানীংকালে আবার গজিয়ে ওঠা সাদা জাতীয়তাবাদীদের আর্যপ্রীতি যে কতটা হাস্যকর সেটাও বোধ হয় এই গবেষণা থেকে আবার বোঝা গেলো।

৩) বৃটিশ রাজত্বকালে ঊনিশ শতাব্দীতে প্রথম ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগুলোর (হিন্দি, বাংলা, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ ইত্যাদি) উৎস আবিষ্কৃত হয়। জানা যায় যে, মধ্য এশিয়া থেকেই তা ভারত এবং ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ঔপনিবেশিক মানসিকতার উপর ভিত্তি করে কিছু ইরোপিয়ান রাজনীতিবিদ এবং গবেষক তখন প্রচার করে যে, ভারতের মূল আদিবাসীদের কোনো উন্নত সভ্যতা গড়ার ক্ষমতা ছিলো না; শক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞানবিজ্ঞানে অনেক উন্নত আর্যরা এসেই উন্নত প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতাগুলো তৈরি করেছিলো। অর্থাৎ সবসময়ে আর্য এবং বৃটিশদের মতো বিদেশী কোনো উন্নত সব সভ্যতা এসেই যেন ভারতীয়দের উদ্ধার করেছে! তবে ১৯২০ সালে হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথালের উন্নত প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অস্তিত্ব আবিষ্কার হওয়ার পরে বোঝা যায় যে, আর্যরা এসে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা তৈরি করে নি বরং এই সভ্যতাগুলো উন্নতির শিখর থেকে পড়ে যাওয়ার অনেক পরে এখানে আযর্দের আগমন ঘটে। এই গবেষণা থেকে এটি আবারো পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হলো যে, হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথালের উন্নত সভ্যতার প্রতিষ্ঠায় আযর্দের কোনো ভূমিকা ছিলো না।

৪) আর্যদের হাত ধরেই বেদিক সংস্কৃতির আগমন ঘটে ভারতে। হিন্দু ধর্মে আর্যদের ‘দেবত্ব-ব্রাম্মণত্বের যে মহান’ আসনে বসানো হয় সেটাও হাস্যকরভাবে ভিত্তিহীন। জাতপাতের ব্যাপারটা সম্ভবত আর্য ব্রাম্মণ-পুরোহিত-ক্ষত্রিয়-রাজারাই শুরু করেছিলো। শূদ্ররা যদি ভারতের সিন্ধু উপত্যকার সেই আদিবাসী হয়ে থাকে তাহলে তারা শুধু ভারতের অরিজিনাল আদি অধিবাসী নন, তারাই আমাদের সবার পূর্বপুরুষ!

সিন্ধু উপত্যকার রাখিগাড়ি অঞ্চলে প্রাচীন ডিএনএর উপর ভিত্তি করে আরও কিছু গবেষণার কাজ চলছে, আশা করা হচ্ছে যে, এই গবেষণার কাজ সমাপ্ত হলে আমরা এ বিষয়ে হয়তো আরও অনেক কিছু জানতে পারবো।

এটা আমার আরেকটি খুব প্রিয় বিষয়, এ নিয়ে লিখলে অনেক কিছুই লেখা যায় কিন্তু আজকে আর লেখাটা বড় করবো না। লিখতে লিখতে শুধু ভাবছিলাম মানুষের সচেতনতা (consciousness) ব্যাপারটা বড়ই আজব এক জিনিস। একদিকে এর কারণেই যেমন আমরা প্রকৃতিতে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করি আবার আরেকদিকে এর কারণেই যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন সত্যি-মিথ্যা, সংস্কার- কুসংস্কার/ মিথ তৈরি করি; কত ভুল, হাস্যকর এবং ক্ষতিকর মূল্যবোধই না ধারণ করে বসে থাকি! আমাদের অস্তিত্বটাই দ্বন্দ্বে ভরা, সচেতনতার এই দ্বান্দ্বিক দিকটিও হয়তো তারই অংশ। জ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে আমরা যত এইসব ক্ষতিকর প্রথা এবং সংস্কারগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো ততই ‘মানুষ’ হিসেবে হয়তো সামনে এগুতে পারবো। হয়তো এর মাধ্যমেই একদিন প্রমাণিত হবে আমাদের সত্যিকারের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’!

তথ্যসূত্র:

১। এখান থেকে মূল গবেষণাটি ডাউনলোড করে নিতে পারেন: The Genomic Formation of South and Central Asia: https://www.biorxiv.org/content/early/2018/03/31/292581

২। বাংলাদেশী মুসলমানদের ধর্মান্তর প্রসঙ্গে প্রফেসর ইটনের বইঃ Eaton, R, 1993, The Rise of Islam and the Bengal Frontier 1204-1760, University of California Press

৩। Who was here first? A new study explains the origins of ancient Indians
https://qz.com/1243436/aryan-migration-scientists-use-dna-to-explain-origins-of-ancient-indians/etics

৪। এখানে এ নিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত একটি ইউটিউব ভিডিও দেখতে পারেন: https://youtu.be/uBuZ9Kd0yRA
Who was here first? A new study explains the origins of ancient Indians

( লেখাটি মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশিত। )

2228 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।