সোনালী সেন

জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ।

বহমান ধর্ষণ সংস্কৃতিতে হুমকির মুখে ভবিষ্যত প্রজন্ম

একটা করে ধর্ষণ, হত্যা-সহিংসতার খবর-একজন করে তনু, রূপা, পূজা, খাদিজা, রিশার শিরোনাম হওয়া। প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, কলমে, কলামে ক্ষোভে ফেটে পড়া, ব্যানারে ফেস্টুনে রাজপথে ঝড় বয়ে যাওয়া।

অত:পর হয়তো আসামী গ্রেফতার অথবা কখনো একেবারে নাগালের বাইরে। ঝড় শেষে আবার স্থিতাবস্থা। আবার অপেক্ষা ঘটনার পুনরাবৃত্তির জন্য।

পত্রিকা পড়তে গিয়ে সদ্য বয়:সন্ধিতে পা রাখা ছেলেটা হঠাৎ দুম করে প্রশ্ন করে ফেললো,” আচ্ছা, মা “ধর্ষণ” কি? “এটা কি খুনের থেকে বেশি কিছু?”। “খুব বেশি কি যন্ত্রণাদায়ক?” বিব্রত, স্তম্ভিত মা। সামাজিক মাধ্যমে বর্তমান সময়ে সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দ “ধর্ষণ”। বহমান ধর্ষণ সংস্কৃতিতে হুমকির মুখে ভবিষ্যত প্রজন্ম। একের পর এক বিভীষিকাময় অশনিসংকেত।

আমাদের ছোটবেলায় “ধর্ষণ” শব্দটা ছিলো নিষিদ্ধ গন্ধম। অনেক পরে শব্দটি যুক্ত হয়েছে শব্দভান্ডারে। মর্মার্থ জেনেছি তারও অনেক পরে। একটা সময় চলচিত্রে “ধর্ষণ দৃশ্য” দেখানো ছিলো অবধারিত। মর্মার্থ না জানলেও বিষয়টি ছিলো চরম অস্বস্তিকর, কারো কারো কাছে তা বিনোদনের অংশ। আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য হিসাবে, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের প্রতিনিধি হিসাবে “ধর্ষণ ও ধর্ষিতা” দুটো শব্দ রীতিমত মজ্জাগত। প্রাত্যহিক কাজের অনুষঙ্গ। এখন “ধর্ষণ” শব্দটির প্রকটতা, এর অন্তর্নিহিত বেদনা, প্রতিটি অক্ষরে ধারন করা অবমাননা সব কিছুই তীব্রভাবে অনুভূত হয় নিজের অস্তিত্বে।

ওসিসিতে রক্তাক্ত ধর্ষিতা যখন দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে সামাজিক মর্যাদাহানীর ভয়ে মামলা করতে অপারগতা জানায় তখন সমাজের সদস্য হিসাবে অসহায় লাগে। আমরা দেখছি, মাদ্রাসার শিক্ষক বলাৎকার করছে শিক্ষার্থী শিশু বালককে, শুনছি ভারতে ধর্মগুরুর ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী শতাধিক নারী, দেখছি ছয়বছরের শিশুকে ধর্ষণ করছে আপন ফুফা, দেখছি আট মাসের শিশু সন্তানকে হত্যা করতে, দেখছি বাবাকে তার তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করতে, শুনছি অসহায় প্রাণীকে বলাৎকার করতে। কখনও গরু, কখনও ঘোড়া বা মুরগি। মামলা হচ্ছে, আসামী ধরা পড়ছে, বিচারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে। কিন্তু মহামারি কমছে কি?

এর সমস্তটাই এক যৌন বিকারগ্রস্ততা। যা একটি ভয়ানক অসুস্থতা। এ অপরাধ তার যৌনবিকারের সাথে জড়িত।

আট মাসের শিশুটিকে কেনো এবং কোন মানসিকতায় থাকলে ধর্ষণ করার মানসিকতা জাগে? আমাদের সমস্যার গোঁড়ায় পৌঁছুতে হবে। কোথাও একটি বড় রকমের গড়বড় রয়েছে।

আচ্ছা, কোনো মা কি তার কিশোর সন্তানটিকে ভবিষ্যত ধর্ষকের ভূমিকায় কল্পনা করতে পারে? ধর্ষণের এই ঘৃণ্য সংস্কৃতির স্রোতে হয়তো সবার অগোচরে আপনার আমার সন্তানের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে ধর্ষকামিতার অপদানব।

এখন সময় এসেছে স্পর্শকাতর শব্দটিকে সংবেদনশীল করে তোলার। এতদিন শুধুমাত্র Victim awareness এর উপরই জোর দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের আত্মরক্ষার কলাকৌশল শেখানো, অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি সর্বোপরি জাতীয় হেল্পলাইন গুলোও এখনও ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে রক্ষা করতে সম্পূর্ণভাবে হাত বাড়াতে সক্ষম হয় নি। রয়েছে পর্যাপ্ত প্রচারনার অভাব।

এখন সন্তানেরা আমাদের কাছ থেকে আরও বেশি কিছু প্রত্যাশা করে। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালের। যৌনতা ও ধর্ষণ সম্পর্কিত আলোচনা নিঃসন্দেহে চরম অস্বস্তি ও বিব্রতকর। আমাদের দেশের সামাজিক প্রক্ষাপটেতো আরও বেশি বিড়ম্বনার। বর্তমানে পাঠ্যক্রমে যৌনতা সংক্রান্ত বিষয়বস্তু সংযোজন করা হয়েছে। তার পাশাপাশি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সংবেদনশীল করে তোলাটাও অভিভাবকের নৈতিক দায়িত্ব। যৌনতার পাশাপাশি অন্যের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া, নারীকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা, এ বিষয়গুলোতে সন্তানকে মানবিক করে তুলতে হবে। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে “A good man project”, “Rape free campus”, “voice against rape” “A man who can stop the rape” এই ধরনের গনসচেতনতামূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন অবধারিত।

ধর্মীয় অনুশাসন যাতে গোঁড়ামিতে পরিনত না হয়ে সন্তানের মনের মানবিক বিকাশকে অবরুদ্ধ করতে না পারে।

সমাজের সকল শ্রেণিপেশার মানুষেরা যে যার অবস্থান থেকে সংবেদনশীলতার পরিচয় দেবেন, দায়িত্বশীল বার্তা পৌঁছে দেবেন – এই তো কাম্য।

যে মুহূর্তে দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, সচেতনতা তৈরিতে মিডিয়ার এগিয়ে আসা জরুরি, ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে টক শোতে বসে ধর্ষণের মতো একটি বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা চলচ্চিত্রের প্রতিষ্ঠিত দুই অভিনেতার (যাদের মধ্যে একজন আবার নারী!) কতোটা দায়িত্বহীন, স্থূল এবং অমানবিক ভাবা যায়!

একাত্তরে আমরা যুদ্ধ করেছি পাকি ধর্ষকদের বিরুদ্ধে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বিচার হয়েছে ধর্ষক যুদ্ধাপরাধীদের। সম্প্রতি আমরা সফলতার সাথে জঙ্গীবাদ মোকাবিলা করে বিশ্বের দরবারে নজির স্থাপন করেছি।

এবারে আমাদের যুদ্ধ “ধর্ষকামিতার” বিরুদ্ধে। আসুন, আপনার সন্তানকে সংবেদনশীল, মুক্ত প্রাণের অধিকারী করে গড়ে তুলুন। দেশকে উপহার দিন ধর্ষকমুক্ত একটি সুস্থ জাতি।

1743 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।