সময়টা ২০০৪ সাল। প্রথমবার মা হতে চলেছি। মনে অনেক আনন্দ। নিজের অস্তিত্বের ভেতর এক অজানা প্রাণের অস্তিত্ব, নড়াচড়া। তার সাথে অফিসে যাওয়া, গল্প করা, গান গাওয়া, আড্ডা, ঘোরাঘুরি। হিরন্ময় এক অনুভূতি!
কে ও? ছেলে না মেয়ে? কেমন দেখতে?
কেমন করে হাসবে?
সবকিছুই তখন কল্পনায় রাঙানো।
আলট্রাসনোগ্রাম করে আগে থেকে জানার উপায় থাকলেও আমরা না জানার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু যতই দিন ঘনিয়ে আসতে লাগলো, ততই কেমন এক ধরনের শঙ্কা ভর করতে লাগলো। তখন এই লেখাটা লিখেছিলাম। লেখা শেষে আমার অনাগত কন্যার জন্য অঝর কেঁদেছিলাম। নাকি নিজের জন্যই, আজ আর মনে নেই।
আজ কন্যা শিশু দিবস। স্মৃতির পাতা থেকে তাই আবার পোস্ট করলাম লেখাটি। শঙ্কার কারণগুলো বদলায়নি যে আজও। সহজে বদলাবে এমন কোনো আলামতও দেখি না।
শঙ্কা
তিন বছরের সোনিয়া ধর্ষিত
এসিডে ঝলসে গেছে আমেনার মুখমন্ডলসহ সারা শরীর
যৌতুক দিতে না পারায় এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে শেফালী
ধর্ষিত অজ্ঞাতনামা তরুণীর বন্তাবন্দী খন্ডিত লাশ উদ্ধার
বখাটেদের উৎপাত সইতে না পেরে সীমার আত্মহত্যা
মা-বাবার চোখের সামনে রাতভর তিনকন্যাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে প্রতিপক্ষ
ডাস্টবিনের পাশে কে বা কারা ফেলে গেছে সদ্যজাত একটি মেয়েশিশু
প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই এমনি হাজারো সহিংসতার খবরে দমবন্ধ হয়ে আসে;
মনে করিয়ে দেয় – ‘মেয়ে, এই পৃথিবীতে তুমি এক মুহুর্তের জন্যেও নিরাপদ নও।’
একটি কন্যাসন্তানের আকাঙ্খা আমার সারাজীবনের।
পুত্রসন্তান লাভের পর আনন্দিত আমার এক প্রিয় বান্ধবীকে হতাশ কণ্ঠে বলেছিলাম –
‘মেয়ে বাচ্চাদের কত সুন্দর সুন্দর জামা, দেখলেই লোভ হয়,
তোর ছেলেকে তুই কি পরাবি? সেইতো একঘেয়ে শার্ট আর প্যান্ট।’
আজ যখন সত্যি সত্যি আমি মা হতে চলেছি –
তখন আমার কন্যাসন্তান কামনার একাগ্রতায় কোথায় যেন ভাঙ্গনের শব্দ শুনতে পাই।
একটি পুত্রসন্তান হলেই কি বেশী ভালো হতো? – মনে দ্বিধা জাগে
মনে হয়, এই শ্বাপদসঙ্কুল পৃথিবীতে আমি আমার মেয়েকে নিরাপদে লালন করতে পারবোতো?
বারবার এক অজানা আশঙ্কায় মন ভরাক্রান্ত হয়ে আসে।
কিন্তু এদেশেও তো জন্ম নিয়েছে বেগম রোকেয়া, ইলামিত্র, প্রীতিলতাদের মতো সাহসী নারীরা
সারাজীবন যুদ্ধ করেছে অন্যায়, অবিচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে,
নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামে পিছু হটেনি কখনো।
তবে আমার মেয়েটিও কি হতে পারবে না তাদেরই মত কোন একজন
রোকেয়া, প্রীতিলতা, প্রিয়ভাষিনী বা তারামনবিবি?
ঈশ্বরকে ডাকিনি কোনদিন, তবু আজ জায়নামাজে বসে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করতে ইচ্ছা করে –
‘হে ঈশ্বর, আমার যেন একটি কন্যা সন্তান জন্মায়।’