আজ বিশ্ব বই ও কপিরাইট দিবসে আমার সবচেয়ে ভালোলাগা একটি বই - দৃষ্টিপাত এর সাহিত্যশৈলী সাহিত্যরসিক বাঙালিদের কাছে তুলে ধরতে চাই।
যাযাবর (বিনয় মুখোপাধ্যায়) এর দৃষ্টিপাত উপন্যাসটি পড়েছিলাম এস এস সি পরীক্ষা দেবার পরে, কতই আর বয়স, ১৫/১৬ সে বয়সে দৃষ্টিপাতের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি বোঝার মতো ক্ষমতা মোটেও ছিলো না। ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণের আভাস পাওয়া যায় এই বইটিতে।
বইটির রচনাকাল ১৯৪৬, তবে ১৯৪০ এর কাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন ইউরোপের প্রতিটি দেশে ছড়িয়ে পরেছে, বৃটেনের একের পর এক সামরিক পরাজয় জার্মানিরর নাৎসি বাহিনীর হাতে ও কলোনিগুলো একের পর এক হাতছাড়া হচ্ছিলো, সে সময় ভারতবর্ষে স্বাধীকারের আন্দোলন দানা বেধে উঠেছিলো। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের সমস্যা সম্পর্কের সমাধান করার জন্যে, ভারতীয় নেতাদের কাছে এক প্রস্তাব পাঠালেন।
চার্চিল তাঁর ওয়ার ক্যাবিনেট মন্ত্রী স্যার ষ্ট্রাফোর্ড ক্রিপস কে পাঠালেন ভারতে। দৃষ্টিপাত এর লেখক এই অধ্যায়টি তাঁর সাহিত্যশৈলী দিয়ে যে অপুর্বভাবে প্রকাশ করেছিলেন তা আমি ১৬ বছর বয়সে দুই'দুবার পড়েও অনুধাবন করতে পারি নি সেসময়।
স্যার ষ্ট্রাফোর্ড ক্রিপস এর ভারত সফর কভার করতে এক বিদেশী সংবাদপত্রের দেশীয় সাংবাদিক হয়ে লেখক দিল্লি যান, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দিল্লিকে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত হয়েছে দৃষ্টিপাত। চার্চিল কিভাবে ক্রিপস মিশন এর হাতে একটা শুন্যগর্ভ প্রস্তাব পাঠিয়ে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী (ক্রিপস ছিলো লেবার দলের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী) ক্যারিয়ার শেষ করে দেন। সেসময় ভারতের ভাইসরয় লর্ড লিলিথগোর কিভাবে পর্দার আড়ালে ক্রিপস মিশনের বিরুদ্ধে কাজ করেন সেই ইতিহাসকে সাহিত্যে রুপ দেন যাযাবর। লেখক অনেকটা সংবাদ বর্ননার ধাঁচে বস্তুনিষ্ঠ বর্ননা করেন।
যাযাবরের লেখায় রসবোধ আছে যথেষ্ট, যা এর আগে সৈয়দ মুজতবা আলি পেরেছিলো বাঙালিকে আনন্দ দিতে এছাড়াও যাযাবর কলমের আঁচড়ে এঁকেছেন ছেপেছেন প্রথমে ধারাবাহিক ভাবে বসুমতি পত্রিকায় সাহিত্যিকের কলম। পাঠক যা পেয়েছে তাতে নালিশ করার আর কিছু নেই। ইতিহাস আছে, ভূগোল আছে, ব্যঙ্গ-বিষাদ আছে, রুপক অথবা কোটেশন ও আছে যথেষ্ট, যেমন:
"বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ" এই উদ্ধৃতি কালের সীমা পেরিয়ে আজও আমরা ব্যবহার করি, যা আমাদের মনের মণিকোঠায় অনুরণন তোলে, "তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েশ"।
দৃষ্টিপাত আমি কমপক্ষে তিনবার পড়েছি, ঐযে বললাম প্রথমবার ১৬ তে তখন বেশি কিছু না বুঝেই আনন্দ খুঁজেছি, তারপর কলেজ জীবনের প্রথম প্রেম, তখন প্রেমের কোটেশন ভালো লাগতো যেমন "প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির দাহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।" তারপর সম্প্রতি আর একবার পড়লাম।
প্রথমবার এর সাথে এবারের পড়ার তফাতটা বুঝলাম যখন এই কোটেশনটি আমার এখনকার প্রবীণ রসজ্ঞ দিয়ে যাযাবরের সাহিত্য নতুন করে উপলব্ধি করলাম, যেমন "মেয়েদের চুল ও ছেলেদের দাড়ি দু-এরই সমান প্রসাধন প্রয়োজন, সমান সময়সাপেক্ষ। তফাৎ শুধু এই যে, প্রথমটির যত্ন বৃদ্ধিতে, দ্বিতীয়টির বিনাশে। চুল রোজ বাঁধতে হয়, দাড়ি রোজ কামাতে।" একাবিংশ শতাব্দীর নারীবাদিরা হয়তো উপরের এই উদ্ধৃতি পছন্দ করবেন না তবে যাযাবর, এইধরনের অজস্র উপমা দিয়ে সাজিয়েছেন, নানা তথ্য ও প্যাথোস মিলেমিশে তৈরি করেছেন এক অনন্য পাঠানুভুতি। আর পুরো আখ্যানের প্রেক্ষাপট জুড়ে আছে এক অননুকরণীয় রসের ধারা। সাহিত্যকে যদি বিশাল আকাশ হিসেবে কল্পনা করা যায়, তবে যাযাবরের দৃষ্টিপাত হলো সেই আকাশের এক জলন্ত নক্ষত্র।