'দি গ্রিন অব ইস্ট পাকিস্তান উইল হ্যাভ টু বি পেইনটেড রেড’
একটি সরকারি নথিতে পূর্ব বাংলার গভর্নরের ডেজিগনেটেড মিলিটারি অ্যাডভাইজার মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এই কথাটি লিখেছিলেন। যার জন্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৮ জুন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্রোর কাছে রাও ফরমান আলীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেছিলেন।
সে যাক… সবুজ পূর্ব পাকিস্তানকে রক্তে রঞ্জিত করে দেওয়ার যে প্রতিজ্ঞা রাও ফরমান আলী গভর্নর হাউজে বসে করেছিলো, সেটি অক্ষরে অক্ষরে পালনও করেছিল সে। ৭১-এর মার্চে রাও ফরমান ঢাকায় ক্রাকডাউন পরিচালনা করে। তার সেই অ্যাকশন এতই নিষ্ঠুর ছিলো যে, সমঝোতার সব পথই রুদ্ধ হয়ে যায়। রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। লাশের মিছিলে হারিয়ে যায় মানবতা। রক্তের নদী বয়ে যাওয়া সেই থেকে শুরু…" (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ৮ম খণ্ড, পাতা -৫৩৮) Balaram Roy পোস্ট থেকে নেওয়া।
উদ্ধৃত অংশগুলো চূড়ান্তভাবে ঘটেছিলো বাংলার মাটিতে।
"দি গ্রিন অব ইস্ট পাকিস্তান উইল হ্যাভ টু বি পেইনটেড রেড", রাও ফরমানের এই কথাটাও অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিলো। বাংলার বুক রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিলো পাকিস্তানীরা। সবুজের উপর রক্তরাঙ্গা সেই ক্যানভাসই হলো আমার বাংলাদেশ। ১৯৭১ এর মার্চের এক কালো রাত থেকে দীর্ঘ নয়মাসের রক্তগঙ্গায় ভাসতে ভাসতে আবার বাংলায় সবুজ জেগে উঠে। ভেসে উঠে সবুজের বুক চিরে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সূর্য।
এমন ধারণা থেকেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীকরূপে বিজয়ফুলের আবির্ভাব। যদিও এর আদলটা নেওয়া হয়েছে পপিফুল থেকে। যে ফুল ইউরোপ আমেরিকায় নভেম্বর মাসে বুকে পরে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হারানো সৈন্যদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। বিজয়ফুল সেই ভাব ও শ্রদ্ধার আবহে তৈরি, শুধু রঙ দেওয়া হয়েছে বাংলার সবুজ আর স্বাধীকার অর্জনে জীবনদায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত। সেই সাথে বিজয়ফুল হয়ে উঠলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রতীক। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ বুকে ব্যাজ আকারে বিজয়ফুল পরিধান বিজয়মাসকে যেন আরো উজ্জীবিত করে তুললো, এনে দিলো বিজয়ের অন্যমাত্রার আনন্দ।
আমাদের বিল্ডিং এর পিছনে সবুজঘেরা ছোট্ট একটি পার্ক আছে। বিকেল হলে মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে বসি। বাচ্চাদের ছোটাছুটি দেখি। একটি সৌম্যশান্ত পরিবেশ। এমনই এক বিকেলে বসে আছি পার্কের বেঞ্চিতে। বেঞ্চির অপর পাশে বসে আছেন বয়স্ক এক ভদ্রলোক, বুকে একটি পপিফুলের ব্যাজ লাগিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ হওয়া সৈন্যদের স্মরণে নভেম্বর মাসে পপিফুলের ব্যাজটা কানাডায় রিমেবারেন্স ডে উপলক্ষে অনেকেই বুকে লাগায়। অথচ এখন গ্রীষ্মে পপিফুলের ব্যাজ বুকে লাগিয়ে বসে আছেন বয়স্ক এই ভদ্রলোক। কৌতূহলবশতঃ একটু কাছে ঘেঁষে 'হাই' বললাম। সাথে সাথে ফিরে তাকিয়ে আমাকেও 'হাই' বললো। আমি জিজ্ঞেস করলাম-
'তুমি যদি কিছু মনে না করো, তাহলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?' তখন সে উৎফুল্ল হয়ে বললো-
'সিউর'।
বললাম-
'তুমি এখন পপিফুল পরে আছো কেনো?' ততোধিক খুশি হয়ে সে বললো-
'আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক। আমার নাম জন। তুমি কি অনুমান করতে পারবে, আমার বয়স কত?' বলেই আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আমি অপারগতা প্রকাশ করে হেসে বললাম- 'না বলতে পারবো না।'
কিন্তু ভিতরে ভিতরে অবাক কৌতূহলে থিরথির করে কাঁপছিলাম। কারণ আমার সামনে ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী উজ্জ্বল কিংবদন্তী বসে আছেন। কতকিছু জানতে ইচ্ছে করছে, তাঁকে একটু ছুঁয়েও দেখতে ইচ্ছে করছে। তখন জন ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলো-
'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমার সহযোদ্ধাদের হারিয়েছি, তাদের প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত স্মরণ করি। আমার বয়স এখন এক'শ সাত। এখনো বেঁচে আছি সেই সমস্ত স্মৃতি বুকে নিয়ে।' অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলাম। হঠাৎ জনের ছেলে এসে আমার দিকে তাকিয়ে 'সরি, আমাদের এখন যেতে হবে', বলে, জনের হাত ধরে তুলে নিয়ে গেলো। পরে আরো কয়েকদিন বিকেলে পার্কে গিয়ে জনের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম, কিন্তু জন আর আসে নি। প্রতিবছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হারানো সৈন্যদের কথা কানাডা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নভেম্বর মাসব্যাপী বুকে পপিফুল পরে এবং ১১ নভেম্বর সকাল এগারোটা এগারো মিনিটে সমস্ত কানাডায় এক মিনিটের নীরবতা পালন করা হয়। জনকে আর কখনো দেখিনি তবে পপিফুলের মতো আমাদের বিজয়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিজয়ফুলকে পেয়েছি, যার প্রণেতা কবি শামীম আজাদ।
দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে যারা যুদ্ধ করে মৃত হয়েও বিজয়ীবেশে বেঁচে আছেন কোটি কোটি জনতার মাঝে তাঁদের স্মৃতি বুকের মাঝে জ্বলজ্বল করবে, এটাই স্বাভাবিক। যদিও তারা মননে মগজে জেগে আছেন, তারপরেও শ্রদ্ধার একটু বহিঃপ্রকাশ এই পপিফুল বা বিজয়ফুল। ঠিক এমন একটি বিষয় কবি শামীম আজাদের মাথায় খেলে গেলো। পপিফুল নিয়ে কোনো এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেন, "ক’বছর আগের এক শীতার্ত নভেম্বর। হুইল চেয়ারে করে ব্রিটিশ রয়্যাল লিজিওনের হয়ে মহাযুদ্ধের স্মারক টুকটুকে লাল কাগজের পপি বিক্রি করছিলেন ইংরেজ বৃদ্ধ টেড স্টকওয়েল। নিজেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফেরত আহত সেনা। তার কাছেই শুনেছিলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর প্রাণহীন বিশুষ্ক ভূমিতে প্রথম ফোটা ফুলের নাম ছিলো পপি।
সেই থেকেই হাতে তৈরি পপি বিক্রি করে এক ক্যানাডিয়ান নারী তার বিক্রয়লব্ধ অর্থে মৃত সৈনিকদের সন্তানদের জন্য কিনেছিলেন প্রথম ক্রিসমাস উপহার। সেইতো শুরু। তারপর খুব জানতে ইচ্ছে করে, একাত্তরের ডিসেম্বরে সেই বিস্ময়কর সময়ে গাছে গাছে অথবা কাননে ছিলো কি অনুরূপ কোনো লাল ফুল? না হলেও ক্ষতি কী? ডিসেম্বরেইতো ফুটেছিলো বাংলাদেশের সবচাইতে সুন্দর ফুল। পতাকার ঘন সবুজে যে রক্তিম সূর্য উঠেছিলো, তারই রূপকল্পেই তো হতে পারে আমাদের ’বিজয় ফুল’।”
নয়মাস যুদ্ধে ঘনসবুজের উপর রক্তাক্ত দাগ, যা রক্তিম সূর্য হয়ে ফুটে উঠলো আমাদের লালসবুজ পতাকায়। পপিফুলের ধারণা থেকে পাঁচটি সবুজ পাপড়ি এক লাল বৃত্তে অর্থাৎ সূর্যটাকে ঘিরে বাংলার সবুজ বনানী ধরা পড়ে আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রতীক হিসেবে যার নাম দেওয়া হয়েছে 'বিজয়ফুল'।
বিশ্বযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারীদের স্মরণে বৃটেনে পপিফুলের আদলে ’বিজয় ফুল’ চালু করার ধারণা মূলত বৃটেন প্রবাসী কবি শামীম আজাদের। পপিফুল বিক্রি করে সে অর্থ যুদ্ধে আহত কিংবা নিহত পরিবারের হাতে তুলে দেয়ার রীতি। ঠিক তেমনই বিজয়ফুল বিক্রি করে সেই অর্থ আমাদের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের হাতে তুলে দেয়ার রীতি প্রচলন করা হোক। বছর ঘুরে এলেই প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের এক তারিখ থেকে 'বিজয়ফুলের' কর্মসূচি নেওয়া হয়। প্রথমে এর যাত্রা লন্ডনে শুরু হলেও এখন বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বিজয়ফুল কর্মসূচি গ্রহণ করে বিজয় দিবসের মাহত্ম্য তুলে ধরছেন। কাগজের তৈ্রি হলেও এটি বহন করছে আমাদের ঐতিহাসিক একাত্তরের বিজয়ের স্মৃতি। এই বিজয়ফুলকে ঘিরে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে নতুন প্রজন্মের কাছে অনেক ঐতিহাসিক কথা উঠে আসবে, উঠে আসবে একাত্তরের বিজয়গাঁথা। তাই বিজয়ফুল হোক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রতীক।