নীল জোনাকি

নীল জোনাকি নামে যিনি লিখেন, তিনি একজন অনলাইন এক্টিভিস্ট এবং লেখক।

বিয়ে'তে নারীর প্রাপ্তি (শেষ পর্ব)

বিয়ের আগেই নারীকে বুঝে নিতে হয় যে, সংসার সুখে রাখার দায় শুধু স্ত্রী বা পত্নীর, স্বামী বা পতির কোনো দায় নেই। আর সংসারে সুখ মানেইতো স্বামীর সুখ। এজন্য নারীকে শিশুকালেই শিখিয়ে দেয়া হয় যে, পতি বা স্বামী অসন্তুষ্ট হয় এমন কোনো কাজ যেন স্ত্রী'রা না করে, স্বামীর অনুমতি ছাড়া একটি পাও যেন না ফেলে। স্বামী প্রহার করলেও যেন তারা মুখ বুজে সহ্য করে। সহজ ভাষায়- হাসিমুখে স্বামীর দাসত্ব মেনে নেয়াই স্ত্রী বা নারীর দস্তুর।

বিয়ের পর স্ত্রী'রা শুধু স্বামীর দাসত্বই করে না, তাদেরকে শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-দেবর সহ পরিবারের সকলেরই দাসত্ব করতে হয়। হিন্দুদের কিছু কিছু সমাজে আজও এই প্রথা চালু আছে যেখানে ছেলেরা বিয়ে করতে যাওয়ার সময় মা'কে বলে- 'মা, আমাকে আশীর্বাদ করো আমি তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি।' তথাকথিত সভ্য সমাজেও এটা পরিলক্ষিত হয়- পাত্রীর সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে গিয়ে পাত্রপক্ষ অন্তত দু'টি বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায় যে, পাত্রী ঘর-সংসারের কাজকর্ম জানে কী না এবং নিরীহ, শান্তশিষ্ট ও মা বাবার অনুগত কী না। অর্থাৎ পাত্রপক্ষ সেই মেয়েকেই বধু করে আনতে চায়- যে সব দিক দিয়েই হবে স্বামীর সংসারে দাসীর মতো কাজ করার উপযোগী। যারা শ্বশুরবাড়ি গিয়ে দাসীসুলভ কাজ ও আচরণ করে এ সমাজ তাদেরকে বলে গৃহলক্ষ্মী। এটা হচ্ছে পুরুষদের নিদারুণ চালাকির একটি অংশ, নারীকে দাসীর মতো খাটিয়েও ভালো ভালো শব্দে ভূষিত করে যাতে নারীরা পুরুষের চালাকি ধরতে না পারে এবং সারাজীবন দাসীগিরি করে।

বর্তমানের তথাকথিত গৃহলক্ষ্মীদের দূর্দশার সাথে ক্রীতদাসদের বড্ড মিল পাওয়া যায়। সে যুগে দাসদের নিজের জীবনের ওপর তাদের অধিকার ছিলো না, এই যুগে স্ত্রীদেরও কোনো অধিকার নেই নিজের জীবনের ওপর। সাংবিধানিকভাবে এ যুগে স্ত্রীগণের যেটুকু অধিকার আছে তা কেবল শারীরিকভাবে বেঁচে থাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

স্ত্রীগণ নিজেদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মালিক নিজেরা নয়, বিয়ের পরপরই নারীর শরীরের যাবতীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মালিকানা হস্তান্তরিত হয়ে যায় স্বামীর কাছে। স্ত্রীর ঠোট, স্তন, জরায়ু-সহ গোটা শরীরের ওপর তার আর কোনো অধিকার থাকে না, তার শরীরের সবকিছুর মালিক তার স্বামী। স্বামী যখন, যে মুহুর্তে যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য স্ত্রীকে কাছে ডাকবে সেই মুহুর্তেই তাকে ছুটে যেতে হবে। কোনো অসুবিধার কথা বললে তা অবাধ্যতা হিসেবে গণ্য হবে। স্ত্রী কখন তার গর্ভে সন্তান ধারণ করবে তা স্বামীই স্থির করে, স্ত্রী যে সন্তানের জন্ম দেয়-প্রতিপালন করে তার মালিকও সে নয়, মালিক স্বামী অর্থাৎ সন্তানের পিতা।

সন্তান কী পড়বে- ডাক্তারী না ইঞ্জিনিয়ারিং তা ঠিক করবে বাবা, মা নয়। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে সে কার সন্তান সে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেনো- সবাই তার বাবার নামই বলে, মায়ের নাম নয় কারণ সে জানে প্রশ্নকর্তা তার বাবার নামই জানতে চেয়েছে। স্কুল-কলেজ বা হাসপাতালে ভর্তির জন্য পিতা বা স্বামীর পরিচয়ই জানতে চাওয়া হয়, জানতে চাওয়া হয় না মা বা স্ত্রীর পরিচয়। এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে সন্তানদের ওপর অধিকার কেবল বাবাদেরই, মায়েদের নয়। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সংবিধানও বাবাকেই সন্তানের আইনসঙ্গত অভিভাবক বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছে (দুগ্ধপোষ্য বা নেহায়েতই শিশু না হলে)।

স্ত্রীর অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলো স্বামীর বংশরক্ষা করা। কোনো স্ত্রী যদি স্বামীকে সন্তান দিতে ব্যর্থ হয়, তার জন্য দায়ী যদি নাও হয় তবুও তাকে গঞ্জনা ও অত্যাচার সইতে হয়, বিবাহিত জীবনে এটাই নারীর জন্য অলিখিত নিয়ম। শুধু গঞ্জনা ও অত্যাচারই নয়, তার জন্য তখন আরো কঠিন পরিণতি অপেক্ষা করে, সন্তান লাভের জন্য স্বামী আরো একটা বিয়ে করে। সেক্ষেত্রে আগেকার স্ত্রীকে সতীনের জ্বালা ও অত্যাচার মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয় এবং স্বামীর পরিবারের সকলের দাসত্বের পাশাপাশি সতীনেরও দাসত্ব করতে হয়। দ্বিতীয় স্ত্রীও যদি সন্তান দিতে ব্যর্থ হয় তবে তারও পরিণতি হয় প্রথম স্ত্রীর মতোই।

যেকোনো বিয়ের সময়ই বরের পিতা কনের পিতা বা পরিবারকে বলে থাকেন -'আপনাদের মেয়ে আমার পরিবারে আমার মেয়ের মতোই থাকবে।' কিন্তু বাস্তবে তেমনটা পরিলক্ষিত হয় না কোথাও। কোনো পরিবারই বাড়ীর বউকে আপন ভাবতে পারে না। পরিবারের কোনো মেয়ের জন্য যা সিদ্ধ বউয়ের জন্য তা নিষিদ্ধ। আবার বউয়ের জন্য যা নিষিদ্ধ তা পরিবারের মেয়ের শ্বশুরবাড়ীতে সিদ্ধ দেখতে সবাই আকুল হয়ে থাকে। যদিও কস্মিনকালেও তা দেখার সুযোগ হয় না।

পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ পুরুষগণ কথার মায়াজাল বিস্তার করে বিয়ে প্রথাকে যতই মহিমান্বিত করার চেষ্টা করুক না কেনো, বিয়ে প্রথা আসলে একটি প্রভুত্ববাদী প্রথা যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো নারীর দাসত্ব। এই প্রথাকে প্রত্যেকটি ধর্মই যুগে যুগে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে আরো শক্তপোক্ত ও মজবুত করেছে এবং মানব সমাজের গভীর থেকে আরো গভীরে প্রোথিত করে নারীর জীবনকে সম্পূর্ণ বিয়ের ছকে গেঁথে দিয়েছে। সমাজের প্রতি স্তরে নারীর সমস্ত বিষয় বিয়ের আবর্তে ঘুর্ণিপাক খায়। নারী কী পোষাক পরিধান করবে তা ভাবার আগে ভাবতে হয় এই পোষাক ভবিষ্যতে বিয়ের পথে কোনো বাগড়া দিবে কিনা! পড়াশোনাও বিয়ে'কে লক্ষবস্তু নির্ধারণ করে, রান্নাবান্না বা বাড়ীর কাজকর্মের ক্ষেত্রেও সেই বিয়ের বিষয়টাই চলে আসে পরিবারের অভিভাবকদের মাথায়। যেন বিয়েই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য এবং লক্ষ্য হওয়া উচিৎ!

নারী অধিকার, স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের পরিপন্থী হলো 'বিয়ে' নামের এই প্রথাটি। তাই এই প্রথাটিকে সমাজে শক্তপোক্তভাবে টিকিয়ে রেখে এবং বিয়ে নামক মরণফাঁদ নারীর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে কোনোভাবেই নারীমুক্তি সম্ভব নয়। আবার হাজার হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় প্রথাটি যেহেতু প্রতিষ্ঠিত সত্য সেহেতু সহসাই এর বিলুপ্তিও সম্ভব নয়। তাই নারী মুক্তির জন্য, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য 'বিয়ে'টাকে নারীর ঐচ্ছিক সিদ্ধান্ত হিসেবে ঘোষণা দেয়া বাঞ্ছনীয় এবং এর চর্চা শুরু হওয়া উচিৎ পরিবার থেকেই। তবেই নারী ঘরের খোঁজে ঘর হারানোর বৃত্ত থেকে বের হয়ে জেগে উঠবে স্ব-মহীমায়।

1937 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।