পুষ্পিতা মন্ডল

বর্তমানে প্রবাসী পুষ্পিতা বাংলাদেশ সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন।

বিয়ের পর শুধু নারীকেই কেনো ছাড়তে হয় নিজের ঘর?

আমার যেদিন বিয়ে হলো আমি একটুও কাঁদিনি। একফোঁটাও না। আমার বোনেরা বৌদিরা কাকীরা সবাই কাঁদার জন্য রেডি হয়ে ছিলো। কিন্তু আমি একদম কাঁদিনি দেখে এরাও কান্নার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমার কেনো যেন কান্না আসে নি। পরিবারকে ছেড়ে যাওয়া বা যাই হোক এসব আমার মনেও আসেনি। আমি খুব নরমাল ছিলাম।

আমার বিয়ের দিনই আশীর্বাদ অনুষ্ঠান হয়। সকাল বেলায়। সেদিনও আমি ঘুরে ঘুরে বিয়ে বাড়ীর এটা ওটা তদারকি করেছি। আশীর্বাদ শেষ হতেই শাড়ীর কোচা একহাতে ধরে ঘুরে ঘুরে কাজ করছিলাম। আমার শ্বশুরবাড়ীর এক মুরুব্বি আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলেছিলো যে বৌমাতো খুব তেজী। আসলে লজ্জাবতী হয়ে বসে থাকার সুযোগ ছিলো না। বাড়ীতে আমি মা আর আমার ছোট বোন। নিজের বিয়ের সব কাজের মধ্যে আমাকে থাকতে হয়েছিলো। 

তো যাই হোক হিন্দু বিয়ের একটা অতি হাস্যকর রীতি আছে। বিয়ের পর মেয়ে মা মেয়ের পিছনে আচঁল ধরে দাঁড়াবে আর মেয়ে উল্টোদিকে ফিরে মায়ের দিকে না তাকিয়ে ওই আঁচলে চাল ছুড়ে দিয়ে বলবে “লক্ষ্মী ফেরত দিয়ে গেলাম।” আর পিছন ফিরে তাকানো যাবে না। বিয়ের দিনের এইটাই মনে হয় সব’চে বাজে দৃশ্য। সব মায়েরা মেয়েরা এইসময় বুক ভাঙা কষ্টে কাঁদে। আমি নিয়ম মানার জন্য চাল ছুঁড়ে দিলেও মুখে কিছু বলিনি। আর পিছনেও ফিরেছিলাম। ফিরে আঙুলে উঁচিয়ে মাকে বলেছিলাম খবরদার কাঁদবে না কিন্তু। এবং সেটা দু’বার করেছি।

আমার চোখে কোনো জল আসে নাই কারণ ভেবেছিলাম আমি কাঁদলে মাকে থামানো যাবে না। আর ভাবছিলাম বিয়ে হয়েছেতো কি হয়েছে? আমার জীবনতো আমারি থাকবে। জীবন কেন বদলাবে? আমার মা কেনো পর হবে? কখনোই না। তাই খুব নরমাল ভাবে হাসতে হাসতে শ্বশুরবাড়ি গেলাম। সাথে আমার তিনটা বোন গিয়েছিলো।

শ্বশুরবাড়ী যাবার সময় গাড়ীর মধ্যে বসে থাকার সময় অন্যরা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। আমি আমার বোনের সাথে হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছিলাম। সেই আমি ওই বাড়ী গেলাম। এতো আনুষ্ঠানিকতা তা আর শেষ হয় না। এরমধ্যে আমার লেগে গেলে ক্ষুধা। ক্ষুধার যন্ত্রণায় আমি অস্থির। খালি মনে হচ্ছে কখন খাবো। কিন্তু ঘরে উঠানোর অনুষ্ঠান চলছে তো চলছেই। এরমধ্যে ওই লোককে বলেছি যে আমার খুব ক্ষুধা পাইছে। কিন্তু কাজ হয় না।

এরপর এলো ভিডিওওয়ালা। একটু কাঁধে মাথা রেখে পোজ দিন, একটু হাসুন। আমার তখন খালি মনে হতে লাগলো এটা যদি মায়ের কাছে হতো চেচিয়ে বাড়ী মাথায় তুলতাম ভাত দাও বলে। এখন পারছি না। এই প্রথম মনে হলো আমার জীবনটা চেঞ্জ হয়েছে। এটা মনে হতেই কান্না এলো। সেইসময় প্রথমবার বিয়ের পরদিন সকালে আমি কাঁদলাম। মজার কথা হলো আমাকে কাঁদতে দেখে আমার নিজের বোন আর কাকাতো তিনটা বোন আমার চেয়ে বেশি কাঁদতে শুরু করলো। দিদিকে কাঁদতে দেখে তারা আর পারেনি। এরপর আমাকে ওই বাড়ীর সবাই খেপাতো আমি নাকি খাওয়ার জন্য কেঁদেছি। হাহা .... আসলে কি তাই?

কোনো পুরুষমানুষ কি কখনো বোঝে বিয়ের সময় তা যতোই প্রেমের বিয়ে বা যাই হোক সে সময় আমাদের উপমহাদেশের মেয়েরা কি পরিমাণ মানসিক দ্বন্দ্ব ভয় আশংকা কষ্টের মধ্য দিয়ে যায়? আমারই যদি অমন লেগে থাকে তাহলে আমি একদম নিজের পরিবেশে বড় হওয়া একটা মেয়ের মানসিক অবস্থা ভাবতে পারি।

মেয়েদের নাকি গোত্রান্তর হয়! আসলেই কি তা সম্ভব? একটা বড় গাছও উপড়ে নিয়ে অন্য জায়গায় গেলে বাঁচে না। কিন্তু মেয়েদের কাছে তেমনটাই আশা করা হয়। মেয়েরা চেষ্টাও করে, পারেও। কিন্তু সেই পারায় কতোটুকু সাপোর্ট বা সহমর্মিতা কয়টা মেয়ে পায়? কতোজন মেয়েকে তার নিজের বাড়ীর মতো ফিল দেওয়া হয়? সাপোর্ট দেওয়া হয়? সময় দেওয়া হয়? নাকি আসলেই তুমি নতুন বউ এটা করো, ওটা মানো, এভাবে চলো এসব বলে আরো ভয় দেওয়া হয়? তবু মেয়েগুলো চেষ্টা করে। নিজের চেনা গন্ডী ছেড়ে নতুন অনেক কিছু মেনে নিতে কি পরিমাণ মানসিক শক্তি দরকার তা ওই মেয়েটাই জানে। সবমেনে নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টাও করে। তারপরেও লোকে বলে মেয়েদের মনের জোর কম। মেয়েরা নাকি অবলা!

4003 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।