বিষয়টি যদি এভাবে শুরু করি, সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র ভারতের বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর 'মানবতার সেবা’ রক্ষার কাজই সম্পাদনা করছেন সেখানকার শতাধিক বড় বড় নারীবাদী সংগঠনগুলো। আর এই কাজে তাদের নিবেদিত কর্মকাণ্ড দেখে অবাক হই, আসলেই কি তারা নারী মুক্তির তাগিদে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভাঙা কিংবা মানব মুক্তির লড়াইকে ত্বরান্বিত করছে? নাকি বহুজাতিক একচেটিয়া পুঁজিবাদী কোম্পানীগুলোর আধিপত্য বিস্তারে সহযোগিতা করছে?আমার তাই মনে হয়! হয়তো নারীবাদীগণ এখন বলবে আমি 'নারীবাদ' সংজ্ঞটা'ই বুঝি নি কিংবা পুরুষতান্ত্রকিতার আষ্ফালন দেখাচ্ছি। তবে আমি নারীবাদ বলতে এটাই বুঝি যে, নারীরা এই সমাজের বাইরের কেউ নন বা ভিনগ্রহ থেকে উড়ে আসা এলিয়েনও নন; তারা এই সমাজেরই নাগরিক, তারা এই আর্থসামাজিক কাঠামোর সঙ্গে জড়িত। তাই তাদের সামগ্রিক মুক্তি নিহিত, সমাজ মুক্তির পথেই, সমাজ মুক্তির আন্দোলনই আমাদের সকলের প্রকৃত মুক্তির পথ।
তবে একটা বিষয় বলতেই হয় যে, সাদিয়া নাসরীন যিনি বাংলাদেশের একজন নারীবাদী এক্টিভিস্ট তিনি তার এক বইয়ে বলেছেন- 'নারীবাদ শব্দটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটি শব্দ, নারী মুক্তি আন্দোলনকারীদেরকে নারীবাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়।'
তাহলে এই যে, এটাও একটা ট্যাবু আপনি নারী, আপনার প্রত্যেক মাসে মাসিক হয়, কিংবা আপনি ছোট কাপড় পড়লে কথিত মোল্লা সমাজের লালা ঝরে যায়। এগুলো হচ্ছে পুরুষতান্ত্রকি সমাজ থেকে চাপিয়ে দেওয়া ট্যাবু। তবে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধেই যদি আপনার লড়াই হয়ে থাকে তবে আপনাকে খুঁজতে হবে পুরুষতন্ত্র নয়, তার মূল সমাজ ব্যবস্থা যে এই নিপীড়নকারী পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখছে। এই ট্যাবুযুক্ত সমাজ ভাঙার জন্য কোন পথে এগুতে হবে মুক্তিকামী নারীবাদীদের নিজেদেরই বের করে নিতে হবে। তবে এ জায়গাটা বেশ ভালো করে ধরেছেন সামগ্রিক চিন্তাশীল লেখক নাদিয়া ইসলাম (মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন) নারী মুক্তি আন্দোলনের বলিষ্ঠ লেখক। তিনি লিখেছেন, 'ধর্ম নারীকে বানিয়েছে শস্যক্ষেত্র আর পুঁজবিাদ বানিয়েছে পণ্য।' এখন বুঝে নিতে হবে আপনার লড়াইটা আসলে কোথায় এবং কার সাথে হবে।
বহুজাতিক কোম্পানীগুলো যারা পশ্চাৎপদ দেশগুলোর দিকে এমনভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন যেন শুধুমাত্র তাদের কর্পোরেট পুঁজির মাধ্যমইে আস্তে আস্তে একটি দেশের সকল নির্যাতন, অত্যাচার, কুসংস্কার, সমাজ উন্নয়ন, মানবাধিকার ও সমাজের সামগ্রিক সব অসুবিধা ঘুঁচে যাবে! যদি তাই হয় তাহলে ভারতের সবচাইতে বড় ৯০ হাজার সদস্য বিশিষ্ট "ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংগঠন" (রেভলু্শানারী আদিবাসী ওম্যান্স অ্যাসোসিয়েশন) ’এর থেকে কেনো পুঁজিবাদী কোম্পানীগুলোর সাহায্যপ্রাপ্ত নারীবাদী সংঠনগুলো দূরত্ব বজায় রাখে? এই বিষয়ে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন মানবাধিকার কর্মী ও লেখিকা অরুন্ধতী রায়। তিনি বলেছেন, "ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংগঠন" একই সঙ্গে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে পুরুষতন্ত্র এবং দন্ডাকারণ্যে খনি কোম্পানিগুলো যে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সেটাই কি এই দূরত্বের কারণ? লাখ লাখ নারী যেখানে নিজের মালিকানাধীন ভূমিতে কাজ করতো, মালিকানা কেড়ে নিয়ে তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করাকে কেনো নারীবাদী সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হবে না, বলতে পারেন?"
বাংলাদেশের আদিবাসী নারীদের ওপর চলছে তীব্র নির্যাতন। আর এই নির্যাতনের মূল হোতা রাষ্ট্র ক্ষুদ নিজেই। উল্লেখ্য, (হিল উইমেন্স ফেডারেশন) 'এর নারীরা ও রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী যেন দুইটি পক্ষ। একদল শাসক আর এক দল শাসিতের ভূমিকায়। এই নারী সংগঠনটির আন্দোলন মূলত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, তাদের ওপর অত্যাচার, খুন, গুম ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে- অর্থাৎ সমগ্র সম্প্রদায়ের মুক্তির জন্য এই লড়াই। এখানে সবচাইতে বড় সমস্যাটা হচ্ছে পাহাড়ে যে সম্প্রদায়টা লড়ছে তাদের সামগ্রিক মুক্তির পক্ষে কথা বলার মতো কোনো বিজ্ঞ নারীবাদীদের দেখা যায় না। আমরা দেখেছি দুই আদিবাসী তরুণীকে ধর্ষণের পর কিভাবে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিলো সারা দেশে, যেন শুধুমাত্র ধর্ষণ করলেই প্রতিবাদ করা যায়। আর ঐ দুই নারী যে ব্যবস্থায় থাকে, যে ব্যবস্থায় বেড়ে উঠে তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে সেই ব্যবস্থা পরিবর্তনের যেন কোনো দরকার’ই নেই। এর মানে আমি বলতে চাইছি যে তাদের শাসন করার অধিকার সেনাবাহিনীর নেই, এটা সামরিক বাহিনীর শাসিত রাষ্ট্র নয়। এটা তাদের'ই ইঙ্গিত যারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মমদ পুষ্টতা পায়, যারা গণতন্ত্রের ধারক-বাহক নামে শোষিত-নির্যাতিত আদিবাসী ও নিপীড়িত জনগণের ওপর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শাসন চালায়। বিচার করে না তাদের পোষ্য ধর্ষক-নির্যাতক সেনাবাহিনীর। তাই এখানে মূল ব্যবস্থাটাকেই উপড়ে ফেলার পক্ষে কথা বলা প্রধান কাজ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
পাহাড়ে শোষণ ও শাসনকে আড়াল করে জাতিভেদটা কেনো যেন প্রধান করে দেখা হচ্ছে? এই বিভক্তিকরণের মধ্য দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানি ও রাষ্ট্র বেশ ভালো করে সুবিধা লুফে নেয়, এই জন্যই জাতিভেদ ও আদিবাসীদের মধ্যেকার গোত্র কোন্দলকে টার্গেট করে এগুচ্ছে সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্র। তাই নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলেছে, কিন্তু কোনো যৌথ কঠোর আন্দোলন হচ্ছে না।
আদিবাসী জাতিসত্তার মুক্তির আন্দোলনে সমর্থন দিলে আপনাদের নিজেদের জাতিসত্তার অর্থাৎ বাঙালিত্বের ওপর আঘাত আসবে এই জন্যেই কি আপনাদের মূল আন্দোলন থেকে এতো দূরত্বে দেখা যায়? আমি এ কথা বলার কারণ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের দখলদার ও উৎপীড়নকারী বাহিনীর কামলালসার কবলে পড়ে আছে হাজার হাজার আদিবাসী তরুণী, তাদের মুক্তির দায় এড়িয়ে যাওয়ার মানে কি? এখানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি জাতির মুক্তির প্রশ্ন, এখানে একটি নির্যাতনকারী বাহিনীর বিপক্ষে একটি মুক্তিকামী জাতিসত্তার লড়াই চলছে। এখানে অন্যায়ভাবে শাসন করার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। তাই এই বড় আন্দোলনগুলোকে ক্ষুদ্র না করার অনুরোধ জানিয়ে, এই পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থা ভাঙার কাজে নিয়োজিত হোন। পুরো ব্যবস্থার কাঠামো না পাল্টে উপরিকাঠামো পাল্টাতে চাওয়া এক ধরণের পুরনো মদে নতুন বোতল ব্যবহার করার মতো হয়ে যায়। আপনার-আমার সকল অধিকার তখনি প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন পুরাতন ব্যবস্থা সর্ম্পূণ রূপে ভেঙে নতুন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন।
চলবে...