যতোবাই-ই বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে কিছু লিখতে গেছি, ততোবারই আক্রমণের স্বীকার হয়েছি। অনেকে আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, কারো বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া কি খুব ভালো জিনিস? কেউ কেউ গালি দিয়ে বলেছেন, একজনের বিবাহ বিচ্ছেদ দেখে দশজন উৎসাহিত হচ্ছে। বিয়ে কি ছেলে খেলা যে ভাল না লাগলেই বিচ্ছেদে যেতে হবে? মেয়েদের এইসব একটু মানিয়ে নিতেই হয়।
ধরে নিলাম বিয়ে কোনো ছেলে খেলা নয়, তবে মেয়েদের-ই কেনো শুধু মানিয়ে নেয়ার দায় থাকবে তা আমার বোধগম্য নয়। বিয়ের মানে যদি হয়ে থাকে, দু'জন নারী-পুরুষ ভাল-মন্দ সময় মিলিয়ে একসঙ্গে বাকী জীবন পার করবে; তবে সেখানে দু'জনেরই কিছু দায়-দায়িত্ব আছে। যেখানে দু'জনেই নিজেদের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত, সেখানে সম্পর্কটি বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাবার কথা না।
সত্যি কথা বলতে গেলে আমাদের সমাজ এখনো বিয়েকে সামাজিক প্রথা হিসেবেই মূল্যায়ন করে। বিয়েকে যদি দু'জন নারী-পুরুষের চুক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করা হত, তবে প্রয়োজনে সেই চুক্তি ভঙ্গের যেই আইন আছে; তা নিয়ে কথা উঠার কথা না। এখন তাদের পরিবারে সন্তান থাকলে কি হবে সেটা নিয়েও দশজনের কথা বলার কিছু নেই, যেখানে আইনে তার সমাধান আছে। আর এমন তো না যে, এই সমাজে বাপ-মা মরা বাচ্চারা নেই যে, কেউ একজন না থাকলে সন্তানের জীবন অচল হয়ে যায়। আর ধর্মীও বা আইনে তো নিষেধ নাই যে ডিভোর্স দেয়া যাবে না। বিষয়টা হচ্ছে বিয়েটাকে আমরা যতোটা না চুক্তি হিসেবে দেখি তার চেয়েও বেশি সামাজিক প্রথা এবং কালচারে পরিণত করে ফেলেছি। একজনের বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে দশজন কথা না বললে শান্তি নেই, সে সাধারণ কেউ হোক বা সেলিব্রেটি। লোকজন সহজে বলে ফেলে একজনের ডিভোর্স দেখে দশজন উৎসাহিত হয়। অথচ এখানে দশজনের উৎসাহিত হবার কোনো সুযোগ নেই, যদি সে তার দাম্পত্য জীবনে সুখী থাকে। ফলে দেখা যায় একজন স্বাবলম্বী নারীও বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে দ্বিধা দন্দে ভোগেন।
একইভাবে দেখা যায় কোনো নারী যখন ধর্ষণের স্বীকার হয়, তখন লোকজন তার পোশাকআসাক, চালচলন, চরিত্র নিয়ে কথা বলে। ধর্ষিতা নারীকে আজও গ্রামের সালিশে দোররা মারা হয়। গ্রামের অনেকেই এতে সমর্থন করে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, কেউ কেউ আবার ভিডিও করেও ছাড়ে। অথচ এটা আইন বিরোধী কাজ। দেখা যায় এইসব দোররা মারার আদেশ যারা দেয়, আর যারা এইসব সমর্থন করে তাদের বেশিরভাগ চেয়ারম্যান, মেম্বার অল্প পড়ালেখা জানা। যারা আজ সমর্থন করছে তারাও তাদের মূর্খ অভিবাবকদের কাছ থেকে এই জ্ঞানই পেয়ে আসছে যে, ধর্ষিতা নারীই দোষী হয়, এতে পুরুষের কোনো দোষ থাকে না। কারণ কোনো এককালে "রাক্ষস বিবাহ" নামে এক ধরণের বিবাহ প্রথা চালু ছিলো। যে কোনো মেয়েকে ক্ষমতাবান পুরুষ চাইলেই জোরকরে ধরে নিয়ে বিবাহ করতে পারতো।
তখনকার সময়ে এটাকে দোষ হিসেবে দেখা হতো না। যেমন, "মহাভারতে" দেখা যায়, কাশীরাজের তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকা'কে ক্ষমতাবান ভীষ্ম তার বৈমাত্রেয় ভাই রাজা বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য নিয়ে আসেন। ঠিক তেমনি, "রামায়ণে" সীতাকে রাবন রাজ হরণ করে নিয়ে আসেন। এখানে রামের ক্ষমতা কম থাকলে, সীতার অবস্থাও অম্বিকা, অম্বালিকাদের মতোই হতো। রাম জিতে যান বলেই তিনি নায়ক আর উল্টো দিকে ভীষ্মকে কেউ হারাতে পারে নি বলে তিনি 'মহান ভীষ্ম' হয়েই আছেন। সেইসব প্রথা আজো আমাদের সমাজে রয়ে গেছে বলে, ধর্ষণে পুরুষের দোষকে দোষ হিসেবে দেখা হয় না। ফলে দেখা যায়, "আপন জুয়েলার্সের মালিক তার পুত্রের ধর্ষণকে সমর্থন করে বললেন," জোয়ান পোলা, একটু আধটু তো করবেই"।
আমাদের শিক্ষিত সমাজ ব্যবস্থা আজও আইন এবং প্রথার পার্থক্য সম্পর্কে অবগত নয়। ঠিক যেমন বি.এ, এম.এ পাস করা লোক বলতেই আমরা ধরে নেই তারা শিক্ষিত, সব তারা জানেন। কিন্তু কোনো এম.এ পাস করা লোককে যদি বলা হয় ভূমির মাপ-জোক করতে, তবে তার পক্ষে হুট করে এটা করা সম্ভব হবে না; কিন্তু যার প্রয়োজন পড়ে সে এম.এ পাস না করেও এইসব মাপ-জোক জানে, প্রয়োজনে মামলাও চালায়। তার একটাই কারণ ভূমির মাপ-জোক কোনো প্রচলিত নিয়মে পড়ে না যে এটা সবাইকে জানতে হবে। যার প্রয়োজন পড়ে সে জেনে নেয়।
অন্যদিকে দেখা যায় খুনের ব্যাপারে শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত, মূর্খ সবাই সচেতন। কেউ বলে না যে, খুন চাইলে করা যায় বা খুন করা এমন কোনো দোষের না। সবাই খুনের আইন সম্পর্কে বেশ সচেতন, সবাই জানে এটা কঠিন অপরাধ এবং এর শাস্তি কি হতে পারে। তাই কেউই কাউকে খুন করতে উৎসাহিত করে না। এটাকে সবাই আইন হিসেবেই জানে।
আমাদের এখন সময় হয়েছে, নগরের নাগরিক হিসেবে এইসব আইন কানুন নিয়ে সামাজিকভাবে আলোচনা করা। আইনকে আইনের যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া এবং প্রথা ও সংস্কৃতি থেকে বের করে নিয়ে আসা। তিনি শিক্ষিত মানেই তিনি সব জানবেন এমন কোনো কথা নয়, তাকে জানার সুযোগ সুযোগ করে দেয়াটাই হচ্ছে মূল কথা। পাঠ্যপুস্তকে "নাগরিক আইন" হিসেবে আলাদা বই সংযোজন করা উচিৎ। তা সায়েন্স আর্টস সবার জন্য বাধ্যতামূলক করে দেয়া হোক। মানুষ এখনো যেখানে সাধারণ কার্টসি জানে না অন্যের ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে কথা বলা যায় আর কোন বিষয়ে যায় না। অনায়াসে প্রশ্ন করে বসে কে কবে বিয়ে করবে, কেনো করছে না? বিবাহিত হলে কেনো বাচ্চা নিচ্ছে না? দোষটা কার, স্বামী না স্ত্রীর? স্বামীর থেকে স্ত্রীর বয়স বেশি কিনা? ডিভোর্স হলে, কেনো হলো, কার দোষ বেশি, আরেকটু মানিয়ে নিলে কি হতো?
কথা হচ্ছে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে আদৌ কি কারো জানার অধিকার আছে, যদি না এতে রাষ্ট্রের কোনো অনুমতি থাকে। কি কারণে একজন সাবালক/সাবালিকা সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ আইন মেনে তার ডিভোর্স সে দেবে আর এতে দশজন নাক গলাবে? এইসব আইন সম্পর্কে আমাদের সবার জানতে হবে যে, বিয়ে কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদ কোনো সামাজিক প্রথা নয়, বরং এইসব আইনানুগ চুক্তি মাত্র।
আমাদের সমাজ বিয়েকে সামাজিক প্রথা বানাতে গিয়ে মনে করে; বিয়ে মানেই ব্রাহ্মন খাওয়ানোর মতো অবস্থা, ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানিয়ে, লাইটিং করে চাকচিক্য আনতে হবে সবকিছুতে। আসল দু'জন মানুষের মধ্যে যে চুক্তিটা হচ্ছে তা ঐসব প্রথা ও কালচারের মধ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদে যেতে হলে লুকাছাপা করতে হয়। ফলে দেখা যায় ডিভোর্সের মতো আইনানুগ বিষয়টি লুকিয়ে মানুষ আবার বিয়ে করে। বিয়েকে সাধারণ চুক্তি হিসেবে দেখলে চুক্তির নিয়ম ভঙ্গ হলে আর তা বাতিলের নিয়ম থাকলে, তা স্বাভাবিক নিয়মে বাতিলও হতে পারে। এখানে এর বেশি কথা বলার জায়গা নাই। কিন্তু সেই সহজ বিষয়টিকে আমরা এতো পঁচিয়েছি যে, ডিভোর্সকে আমরা রীতিমতো দোষ হিসেবে দেখি। এই যে কিছুদিন আগে চিত্রনায়িকা "অপু বিশ্বাস" একজন স্বাবলম্বী নারী, যিনি বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে অস্থির হয়ে গেলেন কি কারণে? তার কারণ হচ্ছে এই প্রথা। সমাজ তাকে কি হিসেবে দেখবে এখন এই ভেবে।
তাই এক্ষুনি সময় আমাদের আইন কানুন বিষয়ে সচেতন হওয়া। প্রয়োজনে জুম্মাবারে খুতবায় এইসব আইন নিয়ে কথা বলা। হুজুররা আমাদের সমাজের প্রতিনিধি। তারা চাইলে নাগরিকদের এইসব কু-প্রথা থেকে মুক্তি দিতে পারেন। মন্দিরেও এইসব নিয়ে আলোচনা করা দরকার। হিন্দু ধর্মে অনেক কুসংস্কার বিদ্যমান, যা থেকে এখন বেড়িয়ে আসা দরকার। যেমন, নায়িকা অপু বিশ্বাসের সাথে যে অন্যায় হয়েছে তা অনেক হিন্দুকেই স্বীকৃতি দিতে দেখলাম শুধু তিনি হিন্দু থেকে মুসলিম হয়েছেন বলে। অন্যায় তো অন্যায়-ই, তা যার সাথেই হোক না কেনো। যেন জীবনে আর কোনো হিন্দু নায়ক- নায়িকার ডিভোর্স হয় নি। শাকিব খানের প্রথম অপরাধ হচ্ছে বিবাহের মতো আইনানুগ একটি চুক্তিকে লুকিয়ে রাখা, তারপর সন্তানের পরিচয় লুকিয়ে রাখা।
অবশেষে বলবো, যেকোন আইনানুগ চুক্তিকে আইনানুগ চুক্তি হিসেবেই আমাদের সকলের দেখা উচিৎ এবং প্রথা ও সংস্কৃতিকে তার আলাদা জায়গা থেকে দেখা। দু'টিকে গুলিয়ে ফেলা কোনো ভাবেই যৌক্তিক নয়।