‘মেয়ে বড় হইসে? দিনকাল ভালো না, বিয়ে দিয়ে দেন। আরে বিয়ের পরেও পড়তে পারবে তো! পড়াশোনা শেষ? এখনো বিয়ে দিচ্ছেন না কেনো? মেয়ের কামাই খাবেন? কতো টাকা রোজগার করে? এই টাকায় তো লিপিস্টকও কেনা যায় না, বিয়ে দিয়ে দেন, জামাইর টাকায় ইচ্ছামতো শপিং করুক, ঘুরে বেড়াক। আরে নাতি-নাতনির মুখ দেখতে হবে তো, বয়স তো আর বসে থাকবে না!’কথাগুলো কম-বেশি অনেক অবিবাহিত নারীর অভিভাবককেই শুনতে হয় পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে। বিবাহযোগ্যা নারীকেও ঘরে-বাইরে হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে আত্মীয় এবং কাজের জায়গায় একটিই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে- বিয়ে কেনো করছো না? সমস্যা কি? পরিবারের লোকজনের একটিই চিন্তা- বিয়ে না হওয়া মানে মেয়ের জীবন নষ্ট, বাপ-মায়ের মান-সম্মান নষ্ট। স্বামী ছাড়া মেয়ে আর ছাড়া গরু এক কথা।
বিয়ে না হলে কোনো যোগ্যতাই কাজে লাগে না। বিয়ে এবং সন্তান হওয়াই নারীর একমাত্র যোগ্যতা, আর কিছু নয়। মেয়ের বিয়ে না হলে সমাজে মুখ দেখানো যায় না। কোনো মতে বিয়েটা হয়ে গেলেই পারিবারে চিরস্বস্তি নেমে আসে।
একটি মেয়েকে নিজের মতো করে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু দিতে চায় না পরিবার ও সমাজ। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুরুষের নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য হয় নারী। পুরুষ অভিভাবক ছাড়া চলা-ফেরা এবং বেঁচে থাকার তার অধিকার নেই, নেই নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছে-অনিচ্ছে। মৃত্যু অব্দি পুরুষের হাজতেই তাকে বাস করতে হয়। নিজের এক টুকরো জগৎ সে তৈরি করে নিতে পারে না যতই সে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হোক। তার কানের কাছে নিত্য সুর বাজে ‘বিয়ে করো, বিয়ে করো’। কোরবানি দেওয়ার মতো নারীকে ধরে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করে পরিবার, আত্মীয়, সমাজ। সে বিয়ে করতে চায় কি চায় না তা জানার আগ্রহ হয় না কারো। যার জীবন সে পারে না কোনো সিদ্ধান্ত নিতে। একটাই কথা- বিয়ে করো, বাচ্চা নেও, বিয়ে আর বাচ্চাতেই নারীর সার্থকতা।
পুরুষ বিয়ে না করলে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা হারায় না। সমাজে টিকে থাকার প্রথম ও প্রধান শর্তই হচ্ছে পুরুষ হয়ে জন্মানো। কিন্তু নারীকে বিয়ে করতেই হবে। শুধু বিয়ের মধ্য দিয়েই সে সমাজে গৃহীত হতে পারে। কিন্তু বিয়ে নারীকে দেয় কি?
বিয়েতে নারী পায় যৌনতার সনদ। অবিবাহিত নারীর জন্যে যৌনতা নিষিদ্ধ, তাই যৌনতা চাইলে নারীকে বিয়ে করতেই হবে। কিন্তু বিয়েতে নারী হয় কেবল যৌনতার উপকরণ মাত্র! পুরুষ ঘরে-বাইরে যৌনতা চরিতার্থ করে নারীর যৌনতাকে করে নিয়ন্ত্রণ। নারী হয় পুরুষের ভোগ সামগ্রী। নারী যৌনতা দিয়ে সেবা করে পুরুষের।
বিয়ে নারীকে দেয় একটি সংসার। সে সংসারটি কিন্তু পুরুষের, নারীর নয়। সংসারে পুরুষটি রাজা। নারী ওই পুরুষটির নামে নিজের সত্ত্বা বিলুপ্ত করে দেয়। তার সমস্ত জীবন পালটে নিতে হয় নতুন একটি জীবনের সাথে। মূলত নারীর কোনো ধর্ম নেই, সে পুরুষটির ধর্মে ও শ্রেণিতে অন্তর্ভূক্ত হয়। স্বামীর নামটিও জুড়ে যায় স্ত্রীর নামের সাথে। পুরুষটি যেভাবে চলতে বলে, যেখানে থাকতে বলে সেখানে সেভাবেই থাকতে বাধ্য হয় নারী। নারী হয়ে ওঠে মেরুদণ্ডহীন। সন্তান জন্ম দিয়ে সে অন্তপুরে জড়িয়ে যায়। বাইরের পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে চলতে পারে না। অনেক পেশাজীবী নারী বিয়ে করে তার চেয়ে অনেক উঁচু পেশার পুরুষকে। সেখানেও ওই নারীর অস্তিত্ব ঠিক থাকে না, সেও পরিণত হয় দাসীতে।
নারীকে বলা হয় মায়ের জাত। পুরুষতন্ত্র নারীকে শিখিয়েছে সন্তানেই নারীর স্বার্থকতা। অথচ মা কিন্তু তার নয় মাস গর্ভে ধারণ করা সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকারটুকু পায় না! পুরুষকে পিতার জাত বলা হয় না। বিয়ে এবং মাতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয় নারীর ওপর, পুরুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় না। এদেশের নারী বিয়ে করে না, তাকে বিয়ে দেওয়া হয়।
সমাজ চায় নারীর জীবনের লক্ষ্যই হোক বিয়ে। পুরুষের জীবনের লক্ষ্য কিন্তু বিয়ে নয়। পুরুষের জীবনের লক্ষ্য যেখানে অর্থনৈতিক সাফল্য, সেথানে সমাজ এবং পরিবার চায় নারী কেবলমাত্র বিয়ের জন্যই প্রস্তুত থাকুক। সমাজ ধরেই নেয় বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকাই নারীত্ব! পুরুষের জীবনে বিয়ে একটি কাজ মাত্র, তার কাছে বিবাহ বহির্ভূত যৌনতাই বেশি আগ্রহের।
নারীর জীবনের সার্থকতা অবশ্যই বিয়ে এবং সন্তান ধারণ কিংবা পুরুষের মাংসের পুতুল হওয়া নয়। বিয়ে এবং মা হওয়া ছাড়াই একজন নারীর জীবনে বিভিন্ন দিক থেকে সফলতা আসতে পারে। বিয়ের বয়স বলেও কিছু হয় না। একজন মানুষ যখন নিজেকে তৈরি মনে করে সেটিই তার বিয়ের বয়স। যাকে নিয়ে পরিবার, সমাজ, আত্মীয়রা এতো কথা বলছেন, তার মাথা তাকেই ব্যথা করতে দিন না! সবার জীবন এক রকম হয় না, তাই অহেতুক বেশি কথা বলা বা নিজেদের জীবন দিয়ে অন্যকে তুলনা করা বেশ বিরক্তিকর।