ফেরদৌস কান্তা

পেশাগত জীবনে শিক্ষক কান্তা লেখালেখির সাথে যুক্ত আছেন মন এবং মননশীলতার তাগিদ থেকে।

নারী ও পুরুষঃ দ্বিতীয় বিয়ে ভাবনা

আমার দাদীজান ছিলেন আমার দাদার দ্বিতীয় পক্ষ। বড় দাদীজান মারা যান তাঁর পঞ্চম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে। পাঁচ পাঁচটা সন্তান নিয়ে কি দাদাজান সাগরে ভাসবেন? না, অল্পদিনের ব্যবধানেই দাদার ঘরে বউ হয়ে আসেন মৃত দাদীজানের আপন ছোট বোন। সুন্দরী, অল্প বয়সী মেয়েটি কি এই বিয়েতে রাজি ছিলো কিনা, তা আমার কোনোদিন জানা হয়নি। ছোটবেলাতেই দাদীকে হারিয়েছি। তবে সবার কাছে জেনে বুঝেছি, সংসারে অন্য কাউকে আনলে বাচ্চাগুলির অযত্ন হতো। বোন হবার সুবাদে বোনের বাচ্চাদের মায়ের আদর-যত্নের অভাব হবে না। আমার বাবাসহ কাকা আর ফুফি মিলিয়ে এই সংসারেও বাচ্চা হয়েছে সাত জন। কেউ না জানলে বুঝতেও পারত না এই বারটি সন্তানের মা আমার দাদীজান ছিলেন না।

দাদাজান ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এখনও তাঁর হাতে গড়া সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছাত্ররা তাঁর নাম শুনলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান দাদার সম্মানে। আমার জন্মের আগেই দাদাজান মারা গিয়েছিলেন। তাই শুনে শুনেই তাঁর গল্প আত্বস্থ হয়েছে। দাদীজানকে পেয়েছিলাম স্কুল শেষ হবার আগ পর্যন্ত। চোখ বন্ধ করলেই শুধু ভাবি এত সুন্দর কোনো মানুষ কিভাবে হয়? কম বয়সেই বিধবা হন তিনি। বাড়ি ভর্তি মানুষজন আর বাচ্চাকাচ্চা, তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত একা একাই সব সামলেছিলেন তিনি। তাঁর টাকা পয়সার অভাব ছিল না। নিজেও বড়বাড়ির মেয়ে ছিলেন, দাদাও অনেক কিছু রেখে গিয়েছিলেন। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করিয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন এক এক করে। সবাই উচ্চশিক্ষিত আর সমাজে প্রতিষ্ঠিত। আমার যতটুকু মনে পড়ে, দাদী ছিলেন প্রচণ্ড প্রতাপশালী একজন মহিলা। শুধু যে ঘর সামলেছিলেন তা নয়, সমান ভাবে সামলেছেন বাহিরের সব কাজ ও। ভাঁড়ার ঘরের চাবি থাকত দাদীর কোমরে সবসময়। বউয়েরা বা কাজের লোকেরা কিছু চাইলে তিনি নিজে তদারকি করে জিনিষ নামিয়ে দিতেন। প্রচণ্ড দাপুটে এই মহিলার মৃত্যুর পর আমাদের বাড়িতে, বাবা-কাকা-ফুফুদের মাঝে ভাই-ভাই কিংবা ভাইবোনের টান কমতে শুরু করেছিলো। তাঁর বেঁচে থাকতে থাকতেই আমার বাবা-কাকাদের সবচেয়ে আদরের ছোটবোন তেইশ কিংবা চব্বিশ বছর বয়সে মনে হয়, বিধবা হন তিনটি সন্তান নিয়ে। অনেক সুন্দরী ছিলেন আমার এই ফুফুটি। ভাল ঘর আর বর দেখেই বিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে। ফুফাও খুব ভাল মানুষ ছিলেন। হঠাৎ করেই জ্বরে ভুগে মারা গেলেন। আমার বাবা আর কাকারা দাদীজান কে বলেছিলেন ফুফুর আবার বিয়ের কথা। মায়ের মুখে শুনেছি, অনেক রাগ করেছিলেন দাদীজান। বলেছিলেন, যে বাড়িতে বিয়ে দিয়েছি সে বাড়িতেই সে মরবে। বাচ্চাগুলিকে মানুষ করা ছাড়া ওর আর কিছু চাওয়ার নাই এখন। ভাত- কাপড়ের যেহেতু অভাব নাই তাই এইসব ফালতু কথা যেন আর না শুনেন তিনি। আর এরপরেও সমস্যা হলে তিনি আর তাঁর সব ছেলেমেয়েরা আছেন, এই এক মেয়ে পালা কোনো ব্যাপার না। এসব কিছুই আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা। 

এবার আসি আমার আরেক নিকটাত্মীইয়ের গল্পে। তিনি পছন্দ করবেন না বিধায় প্রকাশ করলাম না কি রকম আত্মীয় হন আমার। তিন ছেলের বাবা তিনি। তাঁর বড় পুত্রের বিয়ের সময় স্ত্রী মৃত্যুবরণ করে, দুই বছর ক্যান্সারে ভুগে। ছেলের বিয়ের সাথে সাথেই তিনি নিজেও বিয়ে পাগল হয়ে উঠেন। উনার বয়স তখন প্রায় ষাটের উপরে। সারাক্ষণ ছেলেদের অভিশাপ দিচ্ছিলেন, এই বলে যে, কেউ তাঁর কথা ভাবছে না। এরা কেউ সুখে থাকবে না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাঁর ছেলেরা আর আত্মীয়রা তাঁর বিয়ে করিয়ে দিলেন। অত:পর তিনি ভালোই আছেন যতদূর জানি।

একটা পুরুষের যখন বউ মারা যায় তখন তার চারপাশের সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায় তাকে বিয়ে করাতে। কখনওবা সেই পুরুষটি নিজে থেকেই আগ্রহ প্রকাশ করে এই ব্যাপারে। বেশির ভাগ সময় দেখা যায়, বাচ্চাদের একটা মা দরকার, সংসারে একজন মহিলা দরকার, পুরুষটিকে দেখাশুনা করে রাখার জন্যও মহিলা দরকার, নানা অজুহাতেই বিয়েটা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, সবাই মিলে সানন্দে বিয়ের আয়োজন করে ফেলে। সেসব ক্ষেত্রেও পাত্রী হিসাবে প্রথম পছন্দ থাকে অবিবাহিতা। তারপর আসে খোঁজ ডিভোর্সি কিংবা বিধবা পাত্রীর। সেখানেও থাকে পাত্রপক্ষের নানা শর্ত। মহিলা বন্ধ্যা হলেই ভালো হয়। মহিলাটির বাচ্চা থাকলে বাচ্চাকে নিয়ে সংসার করতে আসা যাবে না। আমি এরকম বেশ কিছু বিয়ে দেখেছি, যেখানে দ্বিতীয়বার বিয়ের পর মহিলারা নিজের সন্তান বা সন্তানদের নানা-নানীর কাছে, কখনওবা হোস্টেলে রেখে গেছে অন্যর বাচ্চাকে আপন করে বুকে টেনে নিতে। সবাই এমন তা বলবো না। অনেকেই আছেন নিজের বাচ্চার জন্য যে মহিলাটিকে আপন করে নিচ্ছেন, সাথে সাথে তার বাচ্চাটিকেও বুকে টেনে নিচ্ছেন। তবে এমন মহৎ পুরুষের সংখ্যা হাতে গোনা বলাই বাহুল্য। আমার প্রশ্ন পুরুষটির বাচ্চাদেরই কি কেবল মায়ের প্রয়োজন হয়? মহিলার বাচ্চাদের কি বাবার আদর-ভালবাসার দরকার নাই?

একটা সংসারে যখন পুরুষ মারা যায় তখন সবচেয়ে অসহায় হয় কিন্তু বউটি, যার স্বামী মারা গেলো। তিনি যদি চাকরী করেন তবে বেঁচে যান, অন্তত খাওয়া পড়া নিয়ে তার ভাবতে হয় না। সন্তান থাকলে দেখা যায়, খেয়ে না খেয়ে ঠিকই তিনি বাচ্চাগুলিকে বড় করে তুলেন। পুরুষের মতো ঠিক বিয়ে করার জন্য অস্থিরও হয়ে উঠেন না কোনো নারী। অনেক সময় দেখা যায়, মৃত স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার জন্যও তিনি আর অন্য কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে পারেন না। আর পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে বিয়ের কথা ভাবলেও তার চিন্তা থাকে তার সন্তানদের নিয়ে। যে ভদ্রলোককে তিনি পুনরায় স্বামী হিসেবে মেনে নিবেন, সেই ভদ্রলোক ঠিক কতটা তার বাচ্চাদের বাবা হতে পারবে? এসব নানা বিষয় সামলে যখন কোনো মেয়ে দ্বিতীয়বার বিয়েতে রাজী হয়, তখন দেখা যায়, পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ে যতটা আগ্রহের সাথে সবাই মেনে নেয়; মেয়েটির বেলায় তা হয় না। বিয়ের সময় থেকে শুরু করে বিয়ের পর সেই মেয়েটি আর তার বাচ্চারা ক্রমাগত সমাজের অশ্লীল নাক গলানোর শিকার হয়। বাচ্চাগুলিকে কাছে পেলেই, আত্মীয়- পরিজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশি সবাই কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করতেই থাকে, নতুন বাবা কেমন? তোমাদের আদর করে? তোমাদের দেখতে পারে? তোমাদের মারে? কি কুৎসিত আমাদের মন-মানসিকতা আমি ভেবেই পাই না। কখনই ভেবে দেখি না, আমাদের নোংরামির জন্য বাচ্চাগুলির মনে কি প্রভাব পড়ে।

একটা পুরুষের যেমন সব প্রয়োজনে জীবনে একজন সঙ্গী দরকার, ঠিক তেমনি একটা মেয়ের ও তার পাশে প্রয়োজন একজন নির্ভয়যোগ্য সঙ্গী। প্রথমবার বিয়েতে হয়তো অনেক কিছু পাওয়া হয় না, হয়তো একজন ভুল মানুষ জীবনে এসে থাকে, অথবা সময়ই পাওয়া যায় না স্বপ্নগুলি পূরণের। দেখা যায়, অনেক অপ্রাপ্তি নিয়েই কোনো মেয়ে ডিভোর্স নেয়, কিংবা বিধবা হয়। তাহলে কেনো পুরুষের মতো মেয়েটি আবার স্বাভাবিকভাবে সব ভেবে শুরু করতে পারে না? সমাজের দোহাই দিয়ে আমরা আমাদের মনের কুটিলতা আর জটিলতা আর কত লুকাবো? বিয়ে মানে কিন্তু শুধু দু’জন মানুষের মাঝে যৌন সম্পর্ক নয়, বিয়ে মানে অনেক কিছু। দু’জন মানুষ বিয়ের মাধ্যমে পরস্পরের কাছে আসে, নিজেদের উপর নির্ভর করে, ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে। একজন আরেকজনের প্রয়োজনগুলি খেয়াল রাখে। দিন শেষে ভরসা পায়, যাই ঘটুক পাশে একজন আছে, তার সাথে মিলিয়েই সব কিছু সামলে নেয়া যাবে। দ্বিতীয়বারের বিয়েতে ছেলেদের চাইতে মেয়েদের এই বিষয়গুলি খুব বেশি ভাবায়। প্রথমবারের বিয়েতে যদি কষ্ট বা অপ্রাপ্তি বেশি হয়, তখন ভাবে দ্বিতীয়বার ও যদি তাই হয় তবে সবাই মেয়েটিকেই দোষারূপ করবে। বলবে সেই ভাল না, নইলে সংসার টিকে না কেনো? কারণ সবখানেই দেখি, পুরুষ যদি দশটাও বিয়ে করে কোনো খবর হয় না। অথচ কোনো মেয়ে আবার বিয়ে করছে, তার সমালোচনার কোনো সীমা থাকে না। 

প্রথমে আমার দাদীজান আর ফুফুর গল্প করেছিলাম। তাঁদের সেই সময় আর দিন কিন্তু এখন অনেক পালটেছে। এখন পরিবার থেকেই ছেলেদের মতো মেয়েদের জন্য দ্বিতীয়বার শুরু করতে সবাই আগ্রহ দেখায়। একা থাকা মেয়েটির কষ্ট এখন পরিবারের অন্যরাও অনুভব করে। তাই চায়, যাই ঘটে গেছে সব বাদ দিয়ে, মেয়েটি আবার শুরু করুক। মেয়েটির পাশে একজন থাকুক সুখে-দু:খে। আর যে একা থাকতে চায়, সে একা থাকুক না, কি সমস্যা! সেখানেও আমরা আমাদের লম্বা নাক না ঢুকিয়ে থাকতে পারি না। কেনো একা আছে? কি ব্যাপার? নিশ্চয় কোনো না কোনো কাহিনী আছে! আমাদের উর্বর মস্তিষ্ক অন্যদের ব্যাপারে নাক গলানোতে বড় বেশি পারদর্শী। আসুন না, একটু মন-মানসিকতা পালটাই। কি এমন ক্ষতি যে যেভাবে ভালো থাকতে চায়, তাকে সেভাবেই ভাল থাকতে দিতে! যে যার মতো ভালো থাকুক, আমরা শুধু আমাদের নাকটা একটু ভালো কাজে লাগাই।

17938 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।