প্রমা ইসরাত

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

বাতায়ন উপাখ্যান : পয়লা বৈশাখ, পয়লা শাড়ি

পহেলা বৈশাখ আমার জীবনে একটি ছুটির দিন হয়ে আসবে, এবং আমি সারাদিন ঘুমানোর প্ল্যান করবো, ভাবি নি কোনোদিন। অথচ আজ তাই হলো। বিকেলের পরে ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার আগে ঝড়, শিলা বৃষ্টি এসে ধূয়ে দিয়ে গেলো দাবদাহে ক্লান্ত পিচের রাস্তা গুলোকে। তবে এই শিলা বৃষ্টি অন্তত কৃষকের জন্য আকাঙ্ক্ষিত কিছু নয়। বৃষ্টি আমার মন খারাপ করে দেয়, আমি বাতায়নের পাল্লা দুটো টেনে সরাই, বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা হাওয়ায় আমি স্নিগ্ধ হই।

আমার মায়াময় আমার বাতায়ন, আমাকে শাড়ি কিনে দিতে পারে নি বলে আফসোস করছিলো। হ্যাঁ শাড়ি খুব বিশেষ একটি পোশাক। অন্তত এখনকার সময়ে, কিংবা এটা বরাবরই ছিলো। আমার মা শাড়ি খুব পছন্দ করেন, অনেক যত্নে গুছিয়ে শাড়ি গুলো তিনি সংগ্রহে রেখেছেন। আমার মনে আছে, আমি যখন খুব ছোট, সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি, আমাকে ঘুম থেকে তুলে আমার মা শাড়ি পরাচ্ছিলেন। তাঁর বিয়ের লাল শাড়িটা। আমাকে বউ সাজিয়ে স্কুলে নিয়ে গেলে আমি বুঝতে পারি আজকে পহেলা বৈশাখ এবং আমারই এক বান্ধবীকে পায়জামা পাঞ্জাবী পরিয়ে আমার বর সাজানো হয়েছে। আমার জন্য সেই দিনটা খুব মজাদার একটা দিন ছিলো। আশে পাশের মানুষের উৎসাহ, বাহ! বাহ! আমার ভালো লাগছিলো। আমি বোধ হয় সেদিন প্রথম শাড়ি পরেছিলাম। আমার মায়ের অত বড় শাড়ি, সেই শাড়ির কুঁচি গুলো পেটিকোটের ভেতরে দেয়াতে আমার পেটটা একটু উঁচু দেখাচ্ছিলো। তবুও আমি খুব খুশি ছিলাম কারণ জয়নুল আবেদীন পার্কে আইসক্রিম ওয়ালা আইসক্রিম বিক্রি করতো, আর আমার মনে হয়েছিলো আজকের দিনে আইস্ক্রিম চাইলে কেউ না করবে না।

বড় হওয়ার পর আমি শাড়ি পরেছি নানান অনুষ্ঠানে। শাড়ি আমার জন্য খুব একটা আরামদায়ক পোশাক না, একটা নির্দিষ্ট সময় পর আমার শাড়ি অসহ্য লাগে। বাতায়নের সামনে স্নিগ্ধ হতে হতে বলেছি সে কথা। বলেছি, আমি রাবীন্দ্রিক কেউ নই গো। শাড়ি পরতে অতো ভালোবাসি না, আমার কপালের টিপের সাইজও মাঝারি, তবু ভালোবাসবে? বাতায়ন স্বশব্দে হেসেছে। ঠিক যেমন আমার বাবা হেসেছিলো, আমার বড় বড় কুঁচির শাড়িতে উঁচু পেট দেখিয়ে যখন বলেছিলাম, বাবা আমার পেটের ভেতর বাবু।

আমার অন্যান্য যে সকল প্রেমিকেরা ছিলো তাদের সামনে আমি শাড়ি পরে গিয়েছিলাম। তাদের মুখে আমি আমার প্রশংসা শুনি নি। হয়তো তারা ভেবেছিলো শাড়ি পরার সঙ্গে সঙ্গে নারী বদলে যায়, দেবলোকের আলোতে তারা একেক জন ভারতীয় নায়িকা হয়ে মর্ত্যে নেমে আসে। তাদের প্রতি রইল সমবেদনা। তবে মনে আছে বেশ কয়েকজন আমার প্রশংসা করেছিলো, এবং এদের মধ্যে একজন প্রেমিক ছিলো, যার চোখের দিকে আমি তাকিয়ে ছিলাম, এবং আমার মনে হয়েছিলো, সে আসলে প্রেমিক নয়, সে আমার ধর্ষক। শুধু সুযোগ পেলো না বলেই তফাতে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ি পরি, বা অন্য পোশাক, দর্শনে ধর্ষনের শিকার হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারি নি। আমি কোথাও নিরাপদ বোধ করি না। সি এন জি স্ট্যান্ড এর চালকদের সামনে দাঁড়ালে আমার মনে হয় তারা একেকটা পটেনশিয়াল রেপিস্ট।

বড় বড় অফিসে, আদালতে, প্রশাসনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মননে মগজে একেকটি পটেনশিয়াল রেপিস্ট বাস করে, যাদের নিরীহ চিন্তা হলো, টাকা হলে থাই ম্যাসাজ নিতে ব্যাংকক যাওয়া আর হিংস্র চিন্তায় থাকে তাহারুশ খেলা। তাহারুশ, আরব্য ধর্ষণ সংস্কৃতি, যা ঘটাতে চেয়েছিলো, বাংলায় জন্ম নেয়া কিছু বরাহ শাবকেরা, পহেলা বৈশাখে, টি এস সি তে ২০১৫ সালে। তারা টেনে ছিঁড়ে দিয়েছিলো মেলায় বেড়াতে আসা নারীদের শাড়ির আঁচল। অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, তাদের ঘরে কি মা বোন নেই?

আমাদের দেশে শাড়ির আঁচল সম্মানের কেবল মায়ের কিংবা বোনের হলেই কেন হয়, কেউ কি বলতে পারে? প্রেমিকার শাড়ির আঁচলের সম্মান কি কম?

যারা নারীকে ধর্ষণ করতে চায়, তারা মূলত কেউ প্রেমিক নয়। তারা ভালোবাসতে জানে না। হয়তো প্রেমের সম্পর্কের নাম দিয়ে তারা ধর্ষণ করে, কিংবা তাদের উদ্দেশ্য তাই থাকে। এমনকি তারা যখন স্বামী হয়, তারা তখনও ধর্ষক থাকে। এর পেছনের কারণ কী? কারণ কি এটাই যে তাদের বাবারাও আসলে তাদের মায়ের ধর্ষক? এবং তাদের মায়ের শাড়ি আসলে একটি তাজা জীবিত দেহে জড়িয়ে রাখা কাফন।

আমি বাতায়নের দেয়া শাড়ির জন্য অপেক্ষা করবো, একজন সত্যিকার প্রেমিকের দেয়া সাধারণ সূতি শাড়ি, অপ্রেমিক স্বামীর দেয়া দামী বেনারসির চাইতে ভালো, যার লোলুপ দৃষ্টি তে স্পষ্ট বোঝা যায়, সে শাড়ি দিয়েছিলো, যেন তা টেনে খুলতে পারে।

1482 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।