বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে সমস্যা বহু পুরানো। এই বাংলার মুসলমানেরা বাঙালিত্ব নিয়ে যেমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভোগেন। রবীন্দ্রনাথ কেনো মুসলমান হইলেন না কিংবা কেনো তিনি হিন্দু হইতে গেলেন এটা বাঙলি মুসলমানের বিশাল মাথা ব্যথার কারণ। রবীন্দ্রনাথ কেনো মুসলমানের গুণকীর্তন করে গল্প-উপন্যাস-কবিতা লিখে ভরে ফেললেন না সেটিও কারণ বটে! আবার রবীন্দ্রনাথের মতো কোনো মুসলমান কবির লিখতে না পারার ব্যর্থতাও রবীন্দ্রনাথের অপরাধ! আসলে জগতে অযোগ্য মুসলমানেরাই এমন ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু ছিলেন না, ছিলেন একেশ্বরবাদী ব্রহ্মধর্মের অনুসারী। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিলো অপৌত্তলিক ব্রহ্মসমাজের অনুসারী। তাঁদের প্রার্থনাসভায় উপনিষদ, বাইবেল, কোরআন, গীতা পড়া হতো। তা যাই হোক, হিন্দু গন্ধ তো যায় নি এবং ইসলামি খুশবু গা থেকে পাওয়া যায় না!
এ দেশের আস্তিক, নাস্তিক, ধার্মিক, ধর্মান্ধ- অনেক পণ্ডিতেরই রবীন্দ্রনাথে চুলকানি আছে। উনারা ‘মুসলমানদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছু লেখেন নি’ বলে রবীন্দ্র-শ্রাদ্ধ করে থাকেন। আবার অনেকেই বিখ্যাত(?) হওয়ার জন্য রবীন্দ্র সমালোচনা করে থাকেন। যেন ‘রবীন্দ্র সমালোচনা করে আমি বিশাল সেলিব্রেটি হইয়া গেলাম’ এমন একটি ভাব! উনাদের আবার ১০ লাইন ঠিকঠাক কবিতা লেখারও যোগ্যতা হয় না, আর রবীন্দ্রনাথের মতো দুই লাইন লেখা তো অনেক দূরের কথা!
মুসলমানের ধর্মচিন্তা শুধু বাংলা সংস্কৃতিই নয়, যে কোনো উদার সংস্কৃতির পরিপন্থী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি মুসলমান সমাজকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিলো। ভাষা শহীদদের রক্ত থেকে আমরা একটি বাঙালি সংস্কৃতি পেয়েছিলাম। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সে কালচার থমকে গেছে। ধীরে ধীরে বাঙালি মুসলমান সমাজকে মৌলবাদ গ্রাস করেছে। এই সমাজ রবীন্দ্রনাথকে ভাবে হিন্দু, নজরুলকে ভাবে মুসলমান। ধর্ম পরিচয়ের ঊর্ধে ওঠার ক্ষমতা রবীন্দ্র-নজরুল দুজনেরই ছিলো। কিন্তু রবীন্দ্র-নজরুলকে ধর্মব্যবসায়ীরা হিন্দু-মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত না করলে ধর্মব্যবসাটা ঠিক জমাট বাঁধে না।পাকিস্তান অমলে রবীন্দ্র-বিরোধিতা ছিলো সরাসরি রাজনীতির বিষয়। আশা করা হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা থেকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিতর্ক উঠে যাবে, তাঁকে মান্য করা হবে আমাদের সংস্কৃতির প্রধান পুরুষ হিসেবে। তাঁকে গ্রহণ করা হবে সমস্যা-সাফল্য, উৎসব-পার্বণের পরম আশ্রয় হিসেবে। কিন্তু তা হয় নি, তাঁর একটি গানকে আমরা জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেছি বটে, তবে রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশের নোংরা রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত করতে পারি নি। বাঙালি মুসলমান সমাজ তাঁকে রাজনীতির মধ্যে টেনে এনে ক্ষমতার-রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পাকাপোক্ত করার জন্য পাকিস্তান আমল থেকে একদল সাম্প্রদায়িকতাবাদী লেখক-বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তাদের কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করে নজরুলকে মুসলমানের বিশ্বকবি বানাতে চেয়েছেন। নজরুল-সাহিত্যের অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক দিকটি ঢেকে দিয়ে তাকে মুসলমানের কবি বানাতে চেয়েছেন। আর নজরুলচর্চার সঙ্গে যারা যুক্ত আছেন, তাদের অধিকাংশই প্রগতি ও আধুনিকতা বিরোধী। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে শক্তিশালী করতেই এরা নজরুলচর্চা করেন। এরা মুক্তিযুদ্ধ মানেন না, আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি এতোটুকু মর্যাদা নেই এদের। সাহিত্য-সংস্কৃতিবোধে নিম্নরুচিসম্পন্ন রাজাকারদের কেউ কেউ নজরুলের সাহিত্য নিয়ে বাগাড়ম্বর করেন আজ অবধি। তারা নজরুলের বিদ্রোহী ভাবসত্তাটি ভেঙে ফেলতে উদগ্রীব, প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ইসলামি রেনেসাঁসের কবি নজরুলকে। তারা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বিরোধিতাও সৃষ্টি করেছেন।
বাঙালি মুসলমান সমাজে আজো রবীন্দ্রনাথকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখার প্রসার ঘটে নি। সামগ্রিক দৃষ্টিতে এদেশে রবীন্দ্রচর্চার পরিমাণ খুব কম, বরং রবীন্দ্র নিন্দার চর্চা বেশ প্রসারিত। এদেশে দ্বি-জাতি তত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তানি চেতনা বেশ প্রখর হয়ে উঠেছে।
হিন্দু ধর্ম কালচার অনুগামী আর মুসলমান ধর্ম কালচার পরিপন্থী। মুসলমান ধর্মের প্রভাব তাদের মনে অনড় দ্বিধা জাগিয়ে দিয়েছে বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে। তারা সংস্কৃতি চর্চাকে হিন্দুয়ানি এবং পরকালবিরোধী বলে মনে করেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ মুসলমান সম্পর্কে কী লিখেছেন না লিখেছেন তা দিয়ে কী হবে! আবুল ফজল এক প্রবন্ধে বলেন, ‘অন্ধ বিশ্বাস দুই সমাজেই প্রায় সমান, তবুও জিজ্ঞাসার ক্ষেত্র হিন্দু সমাজে যতোখানি প্রশস্থ মুসলমান সমাজে তা নয়।’
রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যতোটা সম্ভব মুসলিম সমাজ সম্পর্কে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি হিন্দু ও মুসলমানের জন্য আলাদা কিছু রচনা করেন নি। কোনো সম্প্রদায়ের মন ভোলানোর ব্যবসা তিনি করেন নি। তাঁর অভিজ্ঞতায় যতোটুকু এসেছে ততোটুকুই মুসলমান সমাজকে মর্যাদা দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্যাধি ও প্রতিকার প্রবন্ধে বলেন, ‘আর মিথ্যা কথা বলিবার কোনো প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধ। ‘আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমানে বসে না, ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।
‘তর্ক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি, কী করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার তো কোনো বিধান দেখি না। যদি বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয় তবে সে শাস্ত্র লইয়া স্বদেশ-স্বজাতি-স্বরাজের প্রতিষ্ঠা কোনোদিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই।’ এখানে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্মেরই সমালোচনা করেছেন। উল্লিখিত উচ্চারণকেই আমরা বহুভাবে সত্যে পরিণত হতে দেখি রবীন্দ্রনাথের সময়ে এবং তাঁর মৃত্যুরও বহুকাল পরেও এবং এখনো নানাভাবে। যারা রবীন্দ্রবিরোধী, তাঁদের কি রবীন্দ্রনাথের এই উচ্চারণ থেকে একটুও শিক্ষা নেওয়ার নেই?
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজকে হাত ধরে টেনে না তুললে তার সঙ্গে সত্যিকার মিতালি হবে না। বুকে বুক মেলানো আর পিঠে পিঠ লাগানো এক কথা নয়। নাড়ির বাঁধন আর দড়ির বাঁধন এক জিনিস নয়।’ এতটা মূল্যবান কথা যিনি বললেন তাঁকে বা কতটা সম্মান দিতে পেরেছি আমরা?
বাঙালি মুসলমান সমাজের হাতেগোনা ২/৪ জন রবীন্দ্রনাথকে যথার্থ উপলব্ধি করেছেন। কবি মাহাবুব উল আলম চৌধুরী চমৎকার বলেছেন, ‘তাঁর চিন্তা ধারায় আমরা চিন্তা করি, তাঁরই সুরে আমরা গান গাই, তাঁর ভাষায় কথা বলি। আসল কথা আমরা রবীন্দ্রনাথেই বাঁচি, রবীন্দ্রনাথেই মরি।’
মুসলমান সমাজের গ্রহণবিমুখ দৃষ্টি দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্ব প্রতিভার ভালো-মন্দ কিছুই যাচাই করা যায় না। যারা মুসলমানই রয়ে গেছেন, বাঙালি হতে পারেন নি, তাদের রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করা স্পর্ধারই বটে।