সুষুপ্ত পাঠক

বাংলা অন্তর্জালে পরিচিত "সুষুপ্ত পাঠক" একজন সমাজ সচেতন অনলাইন একটিভিস্ট ও ব্লগার।

বাঙালি মুসলমানের মন : হলে গিয়ে সিনেমা দেখা পাপ, মোবাইলে একটু দেখি...

কাজি হায়াৎ কতখানি অযৌক্তিক কথা বলেছেন? সিনেমা দেখা পাপ- হলে গিয়ে সিনেমা দেখার উপর মানুষের এই ধর্মীয় বিশ্বাস বাংলাদেশের উপর কতখানি প্রভাব রেখেছে? নাকি সবটাই কাজি হায়াতরা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এবং ‘উগ্র নাস্তিক’ সুষুপ্ত পাঠক সব কিছুর জন্য খালি ইসলামকেই দায়ী করার এটা একটা ষড়যন্ত্র?

এক মহিলার কথা বলি। বিবাহিত এই মহিলা পরকীয়া করতেন। আমাকে কয়েকবার বলেছিলেন আল্লার ইচ্ছাতেই তিনি তার প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হন। লম্বা হাতার কামিজ, মাথায় স্কাফ পরিহিত এই মহিলা ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যাভিচারকে বলছেন সেটা আল্লার ইচ্ছাতে হচ্ছে। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ ছাড়া কোনোদিন জবাব দিতেন না। কাশেম বিন আবু বকরের ইসলামী উপন্যাসের মতো তার এই ‘হালাল ডেটিং’-কে কিভাবে ব্যাখ্যা করবো? মুসলমানদের এইসব হিপোক্রেসিকে মাথায় রেখে এবার ভিন্ন আরেকটা ঘটনার কথা বলি।

বেশ ক’বছর আগে কি একটা আলোচিত সিনেমা হল থেকে দেখে বের হয়েছি, পথে দেখা পুরোনো এলাকার এক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। এটা সেটা কথা বলার পর বললো, তা আসছিলেন কোথা থেকে? বললাম অমুক সিনেমা দেখে। খারাপ না, গিয়ে দেখে আসতে পারো…। ছোট ভাই বছর দুয়েক থেকে সুন্নতী দাড়ি রাখার পর থেকে তার রূপান্তর হতে দেখেছি। সিনেমা দেখার কথা বললে সে মুখে একটা অসম্ভব চিহৃ এনে বললো, নাহ্ ভাই, হলে গিয়ে… নামাজ কালাম ধইরা ফেলছি তো ভাই… দুনিয়াদারী কয়দিন… কবরে তো এইসব সঙ্গে যাবে না ভাই…। ছোঁ মেরে সঙ্গে সঙ্গে ধরলাম, তুমি না সেদিন বলছিলে অমুক সিনেমার কথা (বাংলাদেশের কি একটা সিনেমা) কি নাকি ভালো করেছে…। সে এবার দুই হাত তুলে আড়মোড় ভাঙ্গার মতো একটা ভঙ্গি করে দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললো, ওটা তো মোবাইলে ভাই… সারাদিন পর একটু নেটে বসি তো, মাঝেমধ্যে একটা সিনেমা দেখি এই আর কি… হলে গিয়ে ভাই দেখা… মানে ইয়ে আর কি… তেমন হয় না…।

অর্থ্যাৎ সিনেমা হলে গিয়ে কাউন্টারে টিকিট কেটে তিন ঘন্টা একটা সিনেমা সবার সঙ্গে বসে দেখার যে আয়োজন তাতে তার বর্তমান ইসলামী অবস্থানের জন্য অস্বস্তিকর লাগলেও মোবাইলে সেটা করতে একদমই হচ্ছে না। সমাজে কি ভয়ংকর একটা রূপান্তর ঘটেছে সেটা তো বাংলাদেশের বোরখা হিজাবের সংখ্যা দেখে আন্দাজ করা যায়। বিশ্বাস করা যায় প্রতি দশজন মেয়ের মধ্যে আটজন বোরখা হিজাব পরছে! পাড়ায় পাড়ায় যে ওয়াজ মাহফিল হয় তার আয়োজক কোনো না কোনো যুব সংগঠনের। এইসব ওয়াজের বক্তারা অকুন্ঠ প্রশংসা করে পাড়ায় যুবকদের ধন্যবাদ জানায় প্রতি বছর এরকম মাহফিলের আয়োজন করার জন্য। এক সময় পাড়ার এইসব যুব সংগঠনগুলো গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। নিজেরা নাটক করতো। খেলাধূলার আয়োজন করতো। তারাই এখন প্রতি বছর একটা করে ওয়াজ মাহফিল করছে, রমজানে ইফতার খাওয়াচ্ছে। তাদের সামাজিক কার্যক্রম কেবলি ধর্মের মধ্যে সীমিত হয়ে যাচ্ছে। তার মানে কি এই যুব সমাজ সিনেমা দেখে না? ঘরে ঘরে এখন হিন্দি সিনেমার বিরামহীন প্রদর্শনী। মোবাইল টিভিতে কোনোটাই বিরাম নেই। মোবাইলের মেমোরিকার্ড ভর্তি পর্ণ। কিন্তু এরাই একটা এন্টি-সংস্কৃতি প্রজন্ম হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। টেকচাঁদ ঠাকুর সেই কবে লিখেছিলেন, মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’! এরা সেটাই করছে। অহরহ সিনেমার নায়িকাদের ক্লিভজ এদের চোখ সওয়া হলেও রাজকাহিনীতে বাংলাদেশের জয়া আহসানের সেরকম সিনে এদের ধর্ম সমাজ সব রসাতলে চলে যায়!

প্রবাসে ১০-১৫ বছর কাটানো কোনো প্রবাসী বাংলাদেশের সামাজিক এই পরিবর্তনকে বুঝতে ব্যর্থ হন বলেই তারা অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাস করতে চান না। তাদের আন্দাজ তাদের পরিবার কিছু দেশী বন্ধুদের কথাবার্তা, দেশী সংবাদ মাধ্যম। বাংলাদেশ মানেই ঢাকা শহর নয়। বাংলাদেশে মানে গ্রাম আর মফস্বল। এখানকার চিত্র খোদ ঢাকায় আবদ্ধ নাগরিকের পক্ষেই জানা সম্ভব হয় না। বেঙ্গলের উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর রাত জেগে অনেক মানুষের শোনাটা বাংলাদেশের এক পার্সেন্টও না। আয়নাবাজী মামদোবাজি টাইপ সিনেমা ঢাকার কিছু সিনেপ্লেসে হিট হলেই সেটা থানা জেলা শহরে কোনো উত্তাপ ছড়ায় না। এই ধরণের কিছু সিনেমা আজকাল যা নির্মাণ হচ্ছে তার বেশির ভাগই ঢাকা কেন্দ্রিক। সারাদেশে মুক্তি পায় না। যা পায় তাও লোকে দেখে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কিছু সার্কাস আয়োজনের মফস্বল এলাকা, যাত্রা, মেলা আয়োজন গ্রামের মুরুব্বী এবং যুব সমাজের হস্তক্ষেপে কয়েক বছর ধরে আয়োজন হতে পারে না। কতজন জানে বাংলাদেশের একটা মফস্বলে এখন কোন বাড়ির মেয়ের মাথায় কাপড় ছাড়া গেলে বাড়িতে অভিযোগ আসে?

বাংলা সিনেমার সেই সুদিনেও রোজার মাস ছিলো সিনেমা এক নিষিদ্ধ জিনিস। এই এক মাস হলো মালিকরা হল বন্ধ রাখতেন নয় তো সাদাকালো পুরাতন কোনো সিনেমা এনে মেশিন সচল রাখতো। এই একমাস অতি ধার্মীকতার সময় সিনেমার নাম মুখে আনাও হারাম। কিন্তু ঈদের দিনই লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তো। তখন পর্যন্ত মুসলমানদের কাছে রোজার একমাস এসব দেখা পাপ ছিলো। বিশ-পঁচিশ বছরে এসে সেটাই বিবর্তিত হয়ে মোবাইল পর্যন্ত এসে ঠেকেছে।

কাজি হায়াৎ যা বলেছেন (লিংক কমেন্টে দিলাম) তার কোনো ভিত্তি নেই এমনটা বলার অর্থ আপনি এইদেশের মূল জনগোষ্ঠির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন! সিনেমা দেখা পাপ- এটা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ব্যাপক। কিন্তু সেই সিনেমা নাটক সবই মোবাইলে টিভিতে চলছে। বাঙালি মুসলমানের এখন মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’ অবস্থায় পড়ে নানা রকম ভন্ডামীর আশ্রয় নিচ্ছে। কাজি হায়াত বলেছেন, ‘সিনেমা দেখাকে অনেকে পাপ মনে করে। তো যে দেশে সিনেমা দেখাকে মানুষ পাপ মনে করে সেখানে হল ভর্তি দর্শক কীভাবে আশা করি! এটা হলো প্রথম ও প্রধান কারণ’। এখানে কাজি সাহেবের সঙ্গে প্রধান কারণ হওয়া নিয়ে তর্ক হতে পারে, প্রথম কারণ কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে- কিন্তু এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই বলার কোনো অবকাশ নেই। প্রবাসীরা অন্যের মুখে ঝাল খায়।

বাংলাদেশের নাস্তিকরা চাপাতীর কোপ খাওয়ার ভয়ে আজ এক স্থানে কাল এক স্থানে পালিয়ে বেড়িয়েছে। এসব জেনে শুনে প্রবাসী নাস্তিকরা মর্মাহত হয়েছেন। আজ সময়ের হেরফেরে সেই মর্মাহত হবার আবেগ আপনাদের বিলুপ্ত। কিন্তু আমরা যারা হাড়ে হাড়ে ভোগ করেছি এটা তারা বাংলাদেশকে যেভাবে চিনেছি সেই অভিজ্ঞতা আপনাদের কোথায়? তারা তো জানেই না বাংলাদেশে যে কাউকে ‘নাস্তিক’ এই অভিযোগ তুলে পাড়ায় থাকা কঠিন করে তোলা যায়। একঘরে হয়ে পড়েন সেই পরিবার! অবশ্য তার কল্লাটা না যাওয়া পর্যন্ত ইংলেন্ড-আমেরিকা-কানাডা প্রবাসীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে বুঝানো সম্ভব নয়। বিগত বিশ বছরে এই দেশের যে রূপান্তর ঘটেছে সেটা ভারতীয় বন্ধুদেরও বুঝানো কঠিন। তাদের দেশে মুসলিমদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বাংলাদেশী মুসলমানকে বুঝা যাবে না। আহমদ ছফার ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ যেমন কেবলী বাংলাদেশী মুসলমানদের কথা, কাজি হায়াতের বক্তব্য যেমন কেবলই বাংলাদেশের পেক্ষাপটে, তেমনি আমার বিশ্লেষণ কেবলই বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে।

যেসব বিজ্ঞ ভাইরা আমার আগের পোস্টে দ্বিমত করে গেছেন তারা এখানে এসে একটু আলোকপাত করলে ভাল লাগতো। গন্ডায় গন্ডায় আমার পোস্ট শেয়ার হলে আপনারা মর্মাহত হইয়েন না। যারা শেয়ার করছে তারা এই পরিবেশের ভুক্তভুগি। তারা আমার লেখায় নিজেদের অভিজ্ঞতার মিল পায় বলেই সেটা শেয়ার করে…।

3565 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।