লেখাটি বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে উৎসর্গ করা হলো।
ভারত ভাগের আগের বাংলা আর এখনকার বাংলাদেশ কিন্তু এক নয়। যদিও বাংলাদেশ: বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেরই ফসল। তাহলে কী হওয়া উচিত এই অঞ্চলের মানুষের জাতিসত্ত্বার পরিচয়?
গত শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষের মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে জাতিগত পরিচিতি নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। আমাদের রাজনীতি, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তিগত পরিচয় দেবার ক্ষেত্রেও সেই সিদ্ধান্তহীনতার স্বাক্ষর থেকে যাচ্ছে। পাকিস্তানের জন্ম সেই রকম একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তহীনতার প্রমাণ। এর ফলে পাঞ্জাব, কাশ্মীর এবং বাংলাকে টুকরো করা হয়েছে। অন্তর্দ্বন্দ্ব বেড়েছে, শোষণ বেড়েছে, অবিশ্বাস বেড়েছে। আবার বছর কুড়ি যেতে না যেতেই ‘উনকে রাসুল, মেরে রাসুল। উনকে কুরআন, মেরে কুরআন’ তত্ত্বও মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলাফল: বেলুচিস্তান, বাংলাদেশ!
ভারত ভাগের আগের বাংলা আর এখনকার বাংলাদেশ কিন্তু এক নয়। যদিও বাংলাদেশ: বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেরই ফসল। তাহলে কী হওয়া উচিত এই অঞ্চলের মানুষের জাতিসত্ত্বার পরিচয়? ভারতবর্ষের পূর্বে বাংলায় যে সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে, তাঁদের পরিচয় কিন্তু এত সংকটাপন্ন নয়। তাঁরা চাকমা, সাঁওতাল, বা এরকম কোনো গোষ্ঠী, এ পর্যন্তই। এর পরে কোনো প্রশ্নের রেশ থাকে না। এক্ষেত্রে একটা কারণ হচ্ছে: ওরা এখনো একক ক্ষমতা চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিযোগীতা, যেমন রাষ্ট্র তৈরি নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাকি যে বিশাল জনগোষ্ঠী, তাঁরা বিশ্বাস ও আচরণের ভিত্তিতে হিন্দু এবং মুসলমান হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে পছন্দ করেন; অথচ ‘বাঙালি’ শব্দটি উপেক্ষা করতে পারেন না কেউ-ই।
তাহলে তাঁদের পরিচয় কি হিন্দু বাঙালি বা মুসলমান বাঙালি? নাকি বাঙালি বলার প্রয়োজন-ই নেই, শুধু হিন্দু বা মুসলমান? নাকি শুধুই বাঙালি? আরেকটি কথা উল্লেখ করা উচিত, যদিও এর কোনো শক্ত ভিত্তি নেই। বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদ্দয়, তাই বলে বাংলাদেশী কোনো সম্পূর্ণ জাতিগত পরিচয় হতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ বাঙালির খণ্ডিত ভৌগলিক অংশকে তুলে ধরে মাত্র।
বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস মানুষের জীবনাচরণকে চরমভাবে প্রভাবিত করে। দৈনন্দিন শব্দ চয়ন, পোষাক, খাবার এবং অন্যের সাথে ব্যবহারেও সেই বিশ্বাসভিত্তিক পার্থক্য ফুটে ওঠে। হিন্দুর হোটেলে পানি/জলের(?) কলস ছুঁয়ে দিলে মরে যায়, উঠোন অশুচী হয়। মুসলমানের ছায়া ডিঙ্গালেও ব্রাহ্মণকে পাপের প্রয়াশচিত্ত করতে হয়। হিন্দুদের এই ধরনের আচরণ মুসলমানদেরকে অবজ্ঞা, হিংসা এবং প্রতিরক্ষাপরায়ণ করে তুলেই ক্ষ্যান্ত হয় নি, নিজেদের ভেতরেও ‘আশরাফ’ আতরাফ ভেদ তৈরিতে ইন্দন যুগিয়েছে। আর মুসলমানদের ধর্মানুভূতির তীক্ষ্ণ ফলা কোথায় নেই!
বাঙালির আগে বা পরে ধর্মীয় পরিচয় বসানো নিয়ে দ্বন্দ্ব, বা অন্য কারো কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও মুসলমানদের ভিতরে এই দ্বন্দ্ব প্রকট। এদের কাছে ইসলামের শত্রু চার দিকে, প্রতিনিয়ত। হিন্দু, খৃষ্টান, ইহুদী, বৌদ্ধ সবাই এক হয়ে মুসলমানদেরকে দুনিয়া থেকে মুছে ফেলতে চায়, মুসলমান বলে সবাই তাঁকে অবজ্ঞা করে, অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। এ কারণে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র চাই, আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। এবং যেহেতু বাকি সব ধর্মবিশ্বাসীরা চরম শত্রু, ফলে- এদের সবাইকে ইসলামিক রাষ্ট্র থেকে নিপীড়ন করে নিঃশেষ না করা পর্যন্ত জিহাদ ওয়াজিব। সংক্ষেপে এটাই বাংলার মুসলমান মানস। শিক্ষা, দর্শন ও বিজ্ঞানে পশ্চাদপদ এই সম্প্রদায় তাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এই অনুভূতি এদেরকে হীনমন্য এবং উগ্র করে তুলেছে।
সেই হীনমন্য অবস্থানের আগুনে ফুঁ দেয়ার মতো উপাদানের ইসলামে কোনো অভাব নেই। অন্য সবার থেকে মুসলমানরাই শ্রেষ্ঠ, ইসলাম-ই হতে পারে একমাত্র জীবন বিধান। অন্য সব জীবন বিধান শুধু অগ্রহনযোগ্যই নয়, তাঁরা সবাই ‘কাফের-মুশরিক’ তাই তাঁরা হীন অত্যাচারযোগ্য, অমানুষ। মুসলমানদের এই দৃষ্টিভঙ্গি সমগ্র মানবজাতি থেকে তাঁদের আলাদা পরিচয় তৈরি করছে। ফলে সবাই ইসলামকে এড়িয়ে চলছে, ঘৃণা করছে, ভয় পাচ্ছে এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। বাস্তবে সামাজিক শান্তির জন্য এই আদর্শের সবাইকে ‘বাধা’ হিসাবে চিহ্নিত করছে। বাংলার মুসলমানরাও এমন ধারণা পোষণ করে। আর যে সমাজের যে অংশে যারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখান থেকে অন্যান্য বিশ্বাসের মানুষকে তারা বিতাড়িত করছে। এর প্রমাণ আমাদের জাতিসত্ত্বায়। তাই বলে ভিন্ন বিশ্বাস ও আচারণের মানুষের সহাবস্থান কি বাংলাদেশে অসম্ভব?
সোজা উত্তর হচ্ছে: না। এবং তারও উদাহরণ মিশে আছে এই বাংলাদেশের মাটিতেই। কমপক্ষে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের এই অঞ্চলের মানুষকে বিদেশী ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে একটা দ্বিধা যে ঢুকে পড়েছে, এবং ভেতরে ভেতরে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, তা অস্বীকার করা হবে অজ্ঞতা। এর পেছনে কারণ হচ্ছে বাঙালির জ্ঞানার্জনে অনীহা এবং দারিদ্র।
বাঙালির এই দূর্বলতা-ই সেন, পাল, মুঘল, ইংরেজদের উপনিবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। যেখানেই জ্ঞানহীনতা, সেখানেই দারিদ্র; আর সেখানেই ধর্মীয় উন্মাদনা। ভারতবর্ষের জাতিগোষ্ঠিগুলোর কেউ-ই গত এক হাজার বছরের ভেতর নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হতে পারে নি। এর ভিতরে কখনো নিজেদের নেতৃত্ব দেয় নি। আর নেতৃত্ব না দিলে নিজেদের রাষ্ট্রকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো গড়ে উঠবে কীভাবে? ঢাকা, কলকাতা তো মুঘল বা ইংরেজরা এই অঞ্চলের মানুষদের শাসনের জন্য প্রাদেশিক রাজধানী করেছিলো মাত্র। সেখানে তাঁদের মতো করে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলেছিলো। দারিদ্র এবং শিক্ষায় পশ্চাদপদ হওয়ায় গত এক হাজার বছর ধরে শাসকেরা সেই সুযোগ পেয়েছে। জাতিসত্ত্বা হিসাবে ‘বাঙালি’ গুজরাটি, মারাঠি তাই কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে নি। সেই সুযোগে ঢুকে গিয়েছে বিশ্বাসভিত্তিক বহিরাগত শাসকেরা। সাম্প্রতিক আট’শো বছরে মুসলমান এবং ইংরেজ। যারা তাঁদের বিশ্বাস, ভাষা এবং আচরণকে এই অঞ্চলের মানুষের উপর দীর্ঘদিন ধরে চাপিয়ে দিয়ে জাতিসত্ত্বার পরিচায়ক স্থানীয় উপাদানগুলোকে ভেঙ্গে দিয়েছে। বাঙালির তিন হাজারেরও বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি দুর্বল, দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছে। সে কারণে ভৌগলিক ও ভাষাগত উপাদানকে ছাপিয়ে বিশ্বাসভিত্তিক পরিচয় সামনে চলে এসেছে। ‘বাঙালি মুসলিম, না মুসলিম বাঙালি এই নিয়ে তর্কটি বড় হয়ে উঠেছে। অথচ শুধু ‘বাঙালি’ বলে জাতিসত্তার পরিচয় বলতে গেলে কেউ-ই দেয় না।
ইংরেজরা আসার আগে মুসলমান, সেন বা পাল শাসকেরা বাঙালি জাতিসত্ত্বার পরিচয়ের উপর আঘাত হানতে শুরু করেছে। সে কারণে পাঁচশো বছরের পেছনে বাঙালির ইতিহাস জানতে চাওয়ার পথটি দুর্গম। ঠিক কেমন ছিলো হাজার বছর আগের বাঙালির বিশ্বাস, দৈনন্দিন জীবন? এসব জানতে, উপাদান খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়। শুধু পাহাড়পুর, ময়নামতি, কিছু ধর্মীয় পুঁথি পুরাণ ছাড়া কিছু খুঁজে পাওয়া এখনো দুঃস্কর। এসব প্রমাণ ধ্বংস না করলে নিশ্চয় আমাদের পূর্বপুরুষদের হাতের আঙ্গুলটি ধরতে এত কষ্ট হতো না। যে সমস্ত উপাদান এখনো টিকে আছে, তা থেকে এ শতাব্দী শুরুর আগে কোনো জ্ঞান আরোহন করা হয় নি। হয় নি কারণ, আমরা সেই দক্ষতা হারিয়ে অজ্ঞতা চর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমরাই আমাদের যাপিত জীবনভিত্তিক জ্ঞানের চর্চা থেকে দূরে সরে গিয়ে হিন্দু-মুসলমান-ইংরেজ চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলাম। যা আমাদেরকে শুধু দ্বিধান্বিতই করেছে। এই গত শতাব্দীর কথাই ধরি না কেনো: হিন্দু-মুসলিম দুই বিশ্বাসীদের ভেতরে মুসলিমরা শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আরও বেশি পশ্চাদপদ। এ কারণেই বিংশ শতাব্দীতে যখন পুনরায় রাষ্ট্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো, তখনই হিন্দুদের দ্বারা শোষিত হবার ভয় এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় যথেষ্ঠ অংশীদারিত্ব না পাওয়ার আশঙ্কার সুযোগে, বিশ্বাসভিত্তিক রাষ্ট্র ধারণাকে (দ্বিজাতিতত্ত্ব) সামনে এনে, মুসলিমরাই অদূরদর্শী এক সিদ্ধান্ত গ্রহন করে: ভারতকে টুকরো করে ‘হিন্দু’ রাষ্ট্র এবং ‘মুসলমান’ রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলে। এটা ছিলো বাঙালি জাতিসত্তার মুখে দ্বিতীয় চড়।
একটি জাতির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র থাকতে হবে এমন ধারণাটি এখনো শক্তিশালী। কিন্তু কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্য কতখানি স্পষ্ট থাকলে জাতীয়তাবাদী চেতনা রাষ্ট্র গঠনের জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়, তা খালি অঙ্কের হিসাবের ব্যাপার নয়। এর সাথে আবেগ ও বিশ্বাস জড়িত। ভৌগলিক অবস্থান, ভাষা, ধর্ম ছাড়া সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদানের প্রতি মানুষের আস্থা জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রধারনার পেছনে শক্তি যোগায়। এখানে শুধুমাত্র বিশ্বাসের সাধারণত্বের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এবং সে কারণে পাকিস্তান কখনো সেই অর্থে ‘রাষ্ট্র’ হয়ে উঠতে পারে না। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস সার্বভৌমত্বের নির্ণায়ক হতে পারে না বলেই পাকিস্তান এখনো এক দুঃস্বপ্নের নাম। বাস্তবে: একটি পরিবারেও সবাই একই বিশ্বাসের হয় না। বৈচিত্রের এই সৌন্দর্যের ওপর ভিত্তি করে গণতন্ত্রের উতপত্তি। কেবলমাত্র মুসলমানদের বা কেবলমাত্র হিন্দুদের জন্যই কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা তাই অযৌক্তিক ও অবাঞ্ছিত। বিশ্বাস, আচরণ, চেহারা, পোশাকের বৈচিত্র্যকে মেনে নিয়েই একটি আদর্শ রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রধারনা একেই সমর্থন করে।
তাহলে কোন অঞ্চলের মানুষের ভেতর কোন্ কোন্ ঐক্যের উপাদানগুলো ঠিক কত মাত্রায় থাকলে তা একটি আদর্শ রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে? কত শক্তিশালী হলে তা কঠোর জাতীয়তাবাদে রূপ নেয়? সব থেকে সাংঘাতিক প্রশ্নটি হচ্ছে: ধর্মকে ঠিক কত দূর পর্যন্ত জাতিসত্তার উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে? এসব প্রশ্নের এক কথায় কোনো উত্তর নেই, কিন্তু প্রশ্নগুলো নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা না থাকলে যে কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ত্ব ও শান্তির জন্যে ঝুঁকিটা বাড়তেই থাকে। মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি মুসলমান বা বাঙালি হিন্দু পরিচয়ের দৌরাত্ম্য নিয়ে বিস্তারিত চিন্তা করতে হবে। এবং বাঙালি আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার বেলায় তার প্রয়োগ ও প্রভাব সুচিন্তিত হতে হবে।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে একটি মানুষ কোনো ধর্ম অনুসরণ না করে বাঁচতে পারে কি না? ধর্মবিশ্বাস ছাড়া একটি সুস্থ্য দাম্পত্য জীবন যাপন করা সম্ভব কি না? সন্তান কোনো ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে কি না? ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ছাড়া সংস্কৃতির অন্যান্য উপাদান মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ঠ কি না? মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক শৃংঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ইতোমধ্যে উদ্ভাবিত আইন এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ঠ কি না? ২০১৭ সালে পৃথিবীর যে কোনো জায়গার জন্য এ প্রশ্নগুলোর প্রত্যেকটির উত্তর ‘হ্যাঁ’। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে: সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত হতে পারে নি।
বাংলাদেশ এবং পূর্ব-ভারতের কিছু অংশ নিয়েই বাংলা। আত্মপরিচয় হিসাবে ‘বাঙালি’কে সমগ্র এই অঞ্চলের মানুষ ঠিক কিভাবে দেখে সেটা আবার পর্যালোচনা করা দরকার। দু’টো আলাদা রাষ্ট্রের ভিতরে থেকেও জাতিসত্তার প্রশ্নে এক হওয়া কোনো কঠিন কাজ নয়। কারণ পৃথিবী ও জীবনকে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে এদের দৃষ্টিভঙ্গির ভেতরে এখনো রয়েছে অনেক মিল। তার পরেও পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, এসব অঞ্চলের মানুষ নিজেদের ইদানিং কী পরিচয় দেয় তা নিয়ে বহুমাত্রিক গবেষণার প্রয়োজন আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ: মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি মুসলমান, বাঙালি হিন্দু এসব পরিচয়কে ছাপিয়ে শুধু ‘বাঙালি’ পরিচয়কে সবার উপরে তুলে ধরতে পারবে? সেই উপাদান এবং শক্তির কতখানি এখনো অবশিষ্ট আছে?
হাজার বছর ধরে গেলা বিশ্বাসভিত্তিক পরিচয়ের বিষ হজম করতে গিয়ে বাংলাদেশ আজ নীল হয়ে আছে। এর পরেও দ্বিধাহীন ‘বাঙালি’ পরিচয় দিয়ে গর্বে বুক ফোলানোর কাজে অবশিষ্ট শক্তির কতখানি ব্যবহার করা যাবে? প্রথম প্রশ্নটির উত্তর পাতাল থেকে উঠে আসা। হ্যাঁ পারবে। কঠিনতম কাজটি ১৯৭১ সালে করা হয়ে গেছে। বাকি কাজগুলো অপেক্ষাকৃত সহজ। জ্ঞানের মাধ্যমে নিজের সম্পদকে চেনা এবং শক্তিতে রূপান্তর করলেই হয়ে যাবে। বিলে ঘাটে শাপলার কন্দ, শালুকের ভিতরে এখনো বাঙালির প্রাণ লুকিয়ে আছে। ধর্মীয় বিভেদকে ছাপিয়ে বাংলাদেশের অনেক সাধারণ মানুষকে এখনো নিজেকে অনায়েসে ‘বাঙালি’ বলে পরিচয় দিতে দেখা যায়। এই অনুভূতিটাকে যদি একটু জায়গা করে দেয়া যায়, তাহলে আজ যাঁরা বিভেদ উষ্কে দিচ্ছেন, ঠিক তাঁরাই ‘এক বৃন্তে দু’টি কুসুম’ হয়ে ‘জয় বাংলা’র ঝড় তুলবেন। ‘জয় বাংলা’ মন্ত্র-ই আমাদের হাজার বছরের বিষ হজম করে ‘বাঙালি’ করে তুলতে যথেষ্ট।