আমার এক কলিগকে দেখলাম বাচ্চাকে নিয়ে মহা ঝামেলায় আছেন। ঠিক কাজে যাবার আগ মুহূর্তে তিন বছরের বাচ্চা জামা বাছাই নিয়ে ঝামেলা বাঁধিয়েছে। একের পর এক জামা বের করে ভরে ফেলছে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না আজ কোনটি পরবে । ওদিকে বাচ্চাকে ডে-কেয়ারে ড্রপ করে তাকে যথাসময়ে কাজে পৌঁছুতে হবে। প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান অথচ বাচ্চা একদিকে ঘর এলোমেলো করছে অন্যদিকে সময়ও নষ্ট হচ্ছে। তথাপি বাচ্চার উপর মায়ের সিদ্ধান্তটি চাপিয়ে দেবার উপায় নেই। এতে বাচ্চার ডিসিশন মেইকিং ক্ষমতা বিকশিত হবে না। দিন দিন পরনির্ভরশীল হয়ে পড়বে সে।
একবার পড়েছিলাম সহজ এবং কঠিণ সব বিষয় মিলিয়ে একজন মানুষ দিনে মাত্র কয়েকটি ওয়াইজ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ একই রকমের একাধিক শার্টপ্যান্টস কিনে রাখেন যেনো কোন জামা পরবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে না পড়েন। আজকাল এসব দেশে ছোট কাল থেকেই বাচ্চাদের মজবুত ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে নানা রকমের অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়া হয় যেনো তারা ধৈর্য, শেয়ারিং, আত্মনির্ভরশীলতা, সিদ্ধান্তগ্রহণ, ঝুঁকি নেয়া ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়। এমন কী প্রয়োজনে প্রিটেন্ডও করতে শেখে। কেননা জীবনতো কখনও কখনও অভিনয়ও।
যাইহোক, সেদিন দেখলাম দুই বছরের এক বাচ্চাকে একটি চকলেট সামনে দিয়ে একা বসিয়ে দেয়া হয়েছে। চকলেট দিয়ে বাবা বাইরে যাবার সময় বললেন, দশ মিনিট পরে আসবো তখনও যদি তুমি এই চকলেটটি না খাও তাহলে আরও একটি চকলেট পাবে। কিন্তু যদি খেয়ে ফেলো তাহলে আর পাবে না। বাবা বের হতেই বাচ্চা কান্না জুড়ে দিলো, বাবা আমি কী খেতে পারি? আমি কী খেতে পারি? বাবা হ্যা বা না কিছুই বলেন নি, ফিরেও আসেন নি। পুরো দশ মিনিট পর এসে বললেন, এভাবে কেনো কাঁদছিলে? আরও একটি চকলেট দিয়ে বললেন, তুমি এই দু'টি চকলেট এখনই খেতে পারো তবে যদি না খেয়ে আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করো তাহলে আরও একটি চকলেট পাবে।
ওটুকু একটি বাচ্চা না খেয়ে দু'টি চকলেট সামনে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তৃতীয়টির জন্যে অপেক্ষা করেছে তবুও হাল ছাড়ে নি।
আমরা আমাদের বাচ্চাদেরকে বাস্তবতা শেখাই না, দীর্ঘ একটি সময় তাদেরকে আগলে রেখে পরনির্ভরশীল করে ফেলি যদিও এক সময় ছেড়ে দিতেই হয় জীবনের তাগিদে যখন তাদের হোচট আরও বেশী খেতে হয়। মাঝে মাঝেই দেশের অনেকে অভিযোগ করেন ওমুকে এটা করলো না, সেটা করলো না, খোঁজ নিলো না, হেল্প করলো না...। অথচ সেল্ফ হেল্প ইজ দ্যা বেষ্ট হেল্প। তাছাড়া, প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব নানা সমস্যা থাকে। ফলে চেয়েও হয়তো কাউকে দীর্ঘসময় সহায়তা দেয়া সম্ভব হয় না। তাই যারা মনে করেন ওমুকে এটা করে দেবে, তমুকে ওটা করে দিলো না কেনো তারা জীবনের দৌঁড়ে হারিয়ে যেতে থাকেন।
মানুষের সদিচ্ছাই তার সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি যেটা নানাবিধ সমস্যায়ও সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। অন্যের সহায়তা ক্ষণস্হায়ী এবং আর যাইহোক না কেনো এটার উপর নির্ভর করা চলে না। তাই সময় থাকতে প্রতিটি সত্তাকে একেকটি স্বাধীন সোল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া দরকার যেনো নিজ নিজ পথ বুঝে নেবার সুযোগ থাকে। কিন্তু আমাদের সমাজে সেই চর্চা নেই। বুড়ো হয়ে কবরে যাবার সময় হয়ে গেলেও আমরা দলবদ্ধভাবে মানুষকে কন্ট্রোল করতে চাই যেনো সে আর জীবনে ঘাড় সোজা করেই দাঁড়াতে না শেখে। সেখানে মেয়ে হলেতো কথাই নেই, তখন মাথার উপর বাড়তি ধর্মীয়, লৈঙ্গিক, এবং সামাজিক চাপও বর্তায়।
সম্প্রতি, ফারিয়া নামে মিডিয়ার একটি মেয়ে শাকিব খানসহ আরও কয়েকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে আপওিকর প্রস্তাব সম্পর্কিত কিছুর ইঙ্গিত করায় দেখলাম নাফিজা নামে এক মেয়ে লাইভে এসে তাকে নানাবিধ গালমন্দসহ এটা ওটা বললেন। যেনো মেয়েটির তার নিজের সমস্যার কথাটিও বলার অধিকার নেই। যেনো শাকিব খান ধোঁয়া তুলসী পাতা। যেই লোক বাংলাদেশের মতো একটি দেশে অপু বিশ্বাসকে নীরবে বিয়ে করে বাচ্চার জন্মদান ঘটিয়েও সহজে স্বীকৃতি দেবার প্রয়োজন অনুভব করেন নি, বাচ্চার মা পুরো গর্ভকালীন সময়ে ঐ উঁচু পেট নিয়ে একা একা বাংলাদেশের মতো একটি সমাজকে ফেইস করেছেন, তাহলে তাকে আর কতটা মহান পুরুষ বলা যায়? মেয়েটিকে আরও বলা হয়েছে মিডিয়া খারাপ হলে সে কেনো মিডিয়ায় কাজ করবে, যেমন মেয়েদেরকে বাসে উঠলে কেউ গায়ে হাত দিলে অভিযোগ করতেই বলা হয়, কেনো বাসে ওঠেন আপনি? আহ যেনো একেবারে বাপের জমিদারী, যা ইচ্ছে তাই করে যাবে, লোকে কিছু বলতে পারবে না। এখানে বাসের লোকদের মতোই একটি মেয়ে একই কথা বললেন, মিডিয়া খারাপ হলে কেনো মিডিয়াতে সে কাজ করতে চায়?
মিডিয়াও একটি কর্মক্ষেত্রই এবং এটা যদি ঐ মেয়েটির পছন্দের একটি ক্ষেত্র হয় তাহলে তারও ওখানে কাজ করার এবং সমস্যা নিয়ে আওয়াজ তোলার পূর্ণ অধিকার আছে। এতে মিডিয়ার বদনাম ছেঁয়ে যাওয়ায় ব্যাপক লোকশান হলো বলে যে হা হুতাশ করা হচ্ছে তাতে বলতে হয় নারী যে ক্ষেত্রেই চলাচল করুক সবারই জানা কোন কোন ধরণের পুরুষালি চাপের মোকাবেলা তাকে করতে হয় অহরহ। আর এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেই সমাধান আসবে নইলে চক্কর দিন দিন আরও গভীরে যায় ।
এই যে মেয়েটিকে একাই তার নিজের জন্যে লড়ে যেতে হচ্ছে এটিই জীবন। যেখানে আপনজন থাক বা না থাক তাদের হাতে করার আর তেমন কিছু থাকে না, টিকে থাকতে নিজেকেই মোকাবেলা করতে হয়। তাই পরিবার এবং সমাজের কর্তব্য ছোট বেলা থেকেই আত্মনির্ভরশীল হবার সেই সুযোগটি করে দেয়া যেনো জীবনকে আর বোঝা মনে না হয়।
জীবনে যার যার জার্নি তার তার এবং জীবন কখনও পিকচার পারফেক্ট নয়। জীবনের ধর্ম বৈরী পরিবেশেও টিকে থাকার চেষ্টা করা। আগে নিজে বাঁচলে তবেইতো বাপের নাম।