ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

মল্লিকা বাহারঃ নারী সমকামিতার বাহারি গল্প

বাংলা সাহিত্যে কমলকুমার মজুমদার স্বতন্ত্র এক প্রতিষ্ঠান। অনেকের ভিড়ে একা একজন নন তিনি, ভিড়ের থেকে বহু দূরে দাঁড়ানো, বৃত্তের একেবারে বাইরে তাঁর অবস্থান। এরকম ক্ষেত্রে মূল স্রোতের বাইরের সেই একাকী একজন সাধারণত হারিয়ে যাবার কথা। কিন্তু, তিনি যান নি। স্বাতন্ত্র্যের সৌন্দর্য নিয়ে জ্বলে উঠেছেন বাংলা সাহিত্যের সুবিস্তৃত আকাশে।

কল্লোল-কালিকলম, বা পরিচয় পত্রিকা থেকে উদ্ভুত লেখককুলেরই সমসাময়িক তিনি, কিন্তু তাঁকে এরা কেউ চিনতো না। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ চিনলেও, তিনি যে সাহিত্য সাধনা করতেন, লেখালেখি করতেন, সেটা তাঁদের কাছে ছিলো অজ্ঞাত বিষয়। খুব সযত্নে সমসাময়িকদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন তিনি। সাহিত্যসাধনা যাঁরা করেন, তাঁদের মধ্যে সাধারণত নিজেকে প্রকাশের, অন্যের কাছে নিজের লেখা উপস্থাপন করার এক তীব্র তাগিদ কাজ করে। কমলকুমার ছিলেন এর একেবারেই ব্যতিক্রম।

ঝিনুক যেমন মুক্তোকে আড়াল করে রাখে প্রাণপনে নিজ শরীরের অন্তরালে, তেমনি নিজের সাহিত্য প্রতিভাকে সবার কাছ থেকে আড়াল করায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি। নিজেকে আড়াল করার, অদৃশ্য করার, পর্দার অন্তরালে ঠেলে দেবার এই কাজটা কেনো তিনি করেছেন, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। এর ব্যাখ্যা জানার জন্য যে উপস্থিতি থাকা দরকার ছিলো সাহিত্য অঙ্গনে, সেটাও তাঁর ছিলো না। জীবিত অবস্থায় লেখক হিসাবে স্বীকৃতিই পান নি তিনি। কোনো সাহিত্য সভায় ডাক পড়ে নি তাঁর, তৈরি হয় নি কোনো ভক্তকুল। প্রথম থেকেই কমলকুমার মজুমদার চারিত্র্যে ও লেখকসত্তায় সবার থেকে আলাদা। দেশ-চতুরঙ্গ-পরিচয়, এই সব নামী পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে বটে, তবে তা খুবই অল্প পরিমাণে। এতোই অল্প পরিমাণে যে সেগুলো কারো চোখেই পড়ে নি।

কমলকুমার মজুমদার মোট আটটি উপন্যাস লিখেছেন। সেই সাথে লিখেছেন বেশ কিছু ছোট গল্পও। এই সব লেখার বেশিরভাগই ছাপা হয়েছে ‘এক্ষণ’, ‘কৃত্তিবাসের’ মতো লিটল ম্যাগাজিনে। দুই একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে, সেই সময়কার প্রসিদ্ধ এবং জনপ্রিয় কোনো পত্রিকাতেই তাঁর লেখা ছাপা হয় নি কখনো। তাঁর একটা ছোট গল্প আছে, নাম ‘মল্লিকা বাহার’।

এই গল্পটা ছাপা হয়েছিলো চতুরঙ্গ নামের এক ছোট পত্রিকায় উনিশ শো পঞ্চাশ সালে। চতুরঙ্গের মতো ছোট পত্রিকায় ছাপা হবার কারণেই হয়তো গল্পটা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গিয়েছিলো। নইলে এ নিয়ে যে বিস্তর হইচই হতো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এক ব্যতিক্রমী, নিষিদ্ধ এবং কল্পনাতিক্রম্য বিষয় নিয়ে তিনি এই গল্পটি লিখেছিলেন, যা তাঁর সময়ের সাহিত্যিকরা লেখাতো অনেক দূরের কথা, খুব সম্ভবত তাঁদের ভাবনাতেও আনতে পারতেন না।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেমন বলেছেন, ‘মল্লিকা বাহার তাঁর প্রথম দুঃসাহসী, চমকপ্রদ গল্প। এরকম বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প লেখার কথা বাংলায় আগে কেউ চিন্তাও করেননি। গল্পের ভাষা দেখেও বোঝা যায়, এ আমাদের পরিচিত বাংলা ভাষা নয়, বিশুদ্ধ বর্ণনারীতি এর মধ্যে নেই, এর বাক্য গঠন ভিন্ন জাতের। “এখনও মল্লিকার আবক্ষ, সে আপনাকে আর এক ভবিষ্যৎ থেকে অদ্য নিরীক্ষণ করে; কেমনধারা মুখটা হয়ে আছে যে তার, অথবা পুরুষোচিত ক্লান্তি এখানে সেখানে। আয়নার সাক্ষাৎ নীচেই ব্রাকেটে, ওটা পাউডার এটা কাজল এটা এসেন্সের শিশি, তাতে শুধু স্বচ্ছতাই, তেল টসটসে ফিতে, কিছু কাঁটা – এ সকলই সদ্য মৃত কোনও জনের সমারোহ বা; আর যে, এই পুরুষচিত ক্লান্তির ক্ষেত্রে এ সকল যে, ম্রিয়মান, নিষ্ক্রিয়া। “এই গদ্য বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম মানে না। অথচ অনাস্বাদিতপূর্ব একটা ব্যঞ্জনা যে রয়েছে তা-ও ঠিক।”

মল্লিকা বাহার শুধু ভাষা ব্যবহারের জন্যই চমকপ্রদ এবং তাক লাগানো গল্প নয়। এর বিষয়বস্তুটাও ভিন্নতর। পুরুষের নিঃসঙ্গতা, কিংবা এক পুরুষের একাধিক নারী গমন কিংবা এর বিপরীতটা বাংলা সাহিত্যে অদৃষ্টপূর্ব কিংবা বিরল কিছু নয়। এ নিয়ে অনেক সাহিত্যকর্মই হয়েছে। কিন্তু, মল্লিকা বাহার এগুলোকে অতিক্রম করে গিয়ে একজন নারীর সাথে অন্য একজন নারীর নিষিদ্ধ সম্পর্ককে তুলে এনেছে বাংলা সাহিত্যে প্রথমবারের মতো। এই বিষয়বস্তু নিয়ে লেখার সাহস, ইচ্ছা, কিংবা কল্পনা, এর আগে আর কারো হয়েছে বলে মনে হয় না।

মল্লিকা বাহার গল্পটা এমন। মল্লিকা নামের এক মেয়ে হঠাৎ করেই চাকরি পাবার চিঠি পায়। এই চাকরি তাকে স্বাধীনতা দেবে। কিন্তু, একই সঙ্গে তার মধ্যে এই আশংকাও জন্ম নিলো যে, একদিন তার যৌবন ফুরিয়ে যাবে। চাকুরিজীবি মেয়েদের দিকে পুরুষ লোকের আগ্রহ কম। সে এখনও সঙ্গীহীন। একদিন কতো জনে তার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। নিজেরও যে কারো কারো প্রতি আগ্রহ ছিলো না, তাও নয়। কিন্তু, লজ্জার কারণে বা অন্য কোনো কারণে কারো সাথেই প্রেম করা হয়ে ওঠেনি তার।

মল্লিকা হিসাব করে দেখলো তার জীবনে খুব কাছে প্রায় চার-পাঁচজন এসেছিলো। কাল থেকে চাকরি শুরু। আজই তার শেষ দিন। এর পরে হয়তো কোনো পুরুষই আর আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করবে না তাকে। মল্লিকা সেজেগুঁজে বের হয় পূর্ব পরিচিত সেই সব ব্যক্তিদের সাথে দেখা করতে। কিন্তু, এতোদিন পরে তাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা খায় মল্লিকা। সময়ের নিষ্ঠুর আঁচড়ে বদলে গিয়েছে সব। সেই সব ব্যক্তিদের কেউ সংসারী হয়ে গিয়েছে পাকাদস্তরভাবে, কেউ বা আগের অসাধারণত্ব হারিয়ে হয়ে গিয়েছে নিতান্তই সাধারণ কেউ, কেউ বা আবার মল্লিকাকে দেখে ভয় পেয়েছে আচম্বিতে। এগুলো দেখে দেখে ক্লান্ত এবং হতাশ মল্লিকা যখন দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়, তখনই তার সাথে দেখা হয় পূর্ব পরিচিত শোভনা দির সাথে। শোভনা দি তাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে।‘

শোভনা যখন হাত বাড়িয়ে মল্লিকার হাত ধরে, মল্লিকা অনুভব করে, ‘শোভনার স্পর্শের মধ্যে কেমন এক দিব্য উষ্ণতা, এ উষ্ণতা বহুকাল বয়সী বহুজন প্রিয়। মল্লিকার এ উষ্ণতা ভারি ভালো লেগেছিলো। কাজেই, সে আর অমত করে নি শোভনা দির বাড়িতে যেতে।

শোভনা মল্লিকার হাত ধরে নিয়ে যায় নিজের বাড়িতে। ছাদে গিয়ে মাদুর পেতে বসে দুজনে। গরমের কারণে গায়ের ব্লাউজ খুলে ফেলে শোভনা। অঞ্জলিবদ্ধ ফুলসম্ভার উপহার দেয় শোভনা মল্লিকাকে। খোঁপায়, নয় গলায় পরতে বলে। নিজেই শেষে মল্লিকাকে কাছে টেনে সোহাগ করে মালা পরিয়ে দেয় গলায়।

মল্লিকা বাহার স্পষ্টতই নারীসমকামিতার গল্প। সমকামিতাকে এখনও আমাদের সমাজ গ্রহণ করার মতো উদারতা দেখাতে পারেনি। একে প্রকৃতিবিরুদ্ধ এবং প্রচলিত সমাজসংস্কৃতিবিরুদ্ধ হিসাবেই ধরে নেয় বেশিরভাগ মানুষ। অধিকাংশ মানুষই এই সম্পর্ককে অশ্লীল আচরণ বলে চিহ্নিত করে এর প্রকাশে সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দেবার চেষ্টা করে। এই সম্পর্ককে বিকৃত এবং অস্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তি বলে মনে করা হয়। ফলে, এটি সামাজিক ট্যাবু হিসাবেই রয়ে গিয়েছে সমাজের কাছে।

সমকামিতা সামাজিক ট্যাবু বলে লেখক-লেখিকারাও এই বিষয় নিয়ে লেখালেখি করার ঝুঁকি নিতে দ্বিধান্বিত হন। তাঁরা সেই বিষয়েই লিখতে চান, যেটি সমাজসম্মত, অহেতুক প্রবল আন্দোলন তৈরি হবে না জলরাশিতে, তরী যাবে তীরের দিকে তুমুল বেগে।

সমকামিতার প্রতি শুধু আমাদের সমাজই যে শুচিবায়ুগ্রস্থ তা নয়, পাশ্চাত্যেও একে পাড়ি দিতে হয়েছে কঠিন এক সংগ্রামমুখর পথ। ইংরেজি সাহিত্যরের প্রথম স্বীকৃত নারী সমকামিতাভিত্তিক উপন্যাস হচ্ছে র‍্যাডক্লিফ হলের দ্য ওয়েল অব লোনলিনেস। এটি প্রকাশিত হয়েছিলো উনিশশো আটাশ সালে। র‍্যাডক্লিফ হল নিজেও একজন সমকামী ছিলেন। বইটা প্রকাশ হবার পর পরই বৃটিশ কোর্ট এটিতে অশ্লীলতা আবিষ্কার করে ফেলে। কারণ, বইটাতে দুইজন নারীর অস্বাভাবিক কার্যক্রমকে অনু্মোদন দিয়েছে। কোর্টের কারণে বইটা দুই দশকেরও বেশি সময় নিষিদ্ধ থাকে বৃটেনে। একই ধরনের আইনগত চ্যালেঞ্জ বইটা আমেরিকাতে মোকাবেলা করেছিলো। তবে, এখানে ভাগ্য ভালো যে, বইটি নিষিদ্ধ হয় নি। র‍্যাডক্লিফ হল জীবিত থাকা অবস্থায় এই বই আর আলোর মুখ দেখে নি বৃটেনে। তিনি মারা যান ১৯৪৩ সালে আর বইটা বৃটেনে নিষিদ্ধতার জাল ছিড়ে মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে।

সমকামিতার প্রতি আধুনিক সমাজ এতোখানি খড়গহস্ত হবার পরেও, একথা বলা যায় যে, সমকামিতার ইতিহাস বহু প্রাচীন। মানুষের সমকামী হওয়ার বহুবিধ কারণ রয়েছে। যদিও কিছু মানুষ সমকামিতার অঙ্কুর নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। সমকামিতা নিয়ে মানুষের ভুল ধারণা যে সমকামিতার ক্ষেত্র বুঝি শুধু শারীরিক, আসলে সমকামিতা ভীষণভাবে মনস্তাত্ত্বিকও, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সমস্যাটাই তাদের বহুদিনের আত্মদমনের সংস্কৃতির পাঠ থেকেই অঙ্কুরিত হয়ে মন ও শরীর দুয়ের মধ্যে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গেছে। ফলে, সঠিক কারণগুলোর সনাক্তকরণ সবসময় সম্ভব হয় না। আধুনিক বিশ্বে নারী সমকামিতা সমাজের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের বহু ক্ষেত্রেই সম্যক ধারণা নেই।

সিমোন দ্য বোভেয়ার তাঁর ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ বইতে লিখেছেন, ‘নারী এমন একটা সত্তা যাকে ব্যবহার করা হয় বিষয় হিসেবে, ফলে তার যৌনক্ষুধা অনেক ক্ষেত্রেই যা পুরুষের দেহে তৃপ্ত হয় না, অতৃপ্ত থেকে যায়। তবে সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা হয় তার গর্ভে একটি শিশুকে স্থাপন করে। কিন্তু এই সমাজবিদিত স্বাভাবিকত্ব কম-বেশি সামাজিক স্বার্থের দ্বারা নির্দিষ্ট। এ বিষয়ে বিষমকামীরাও অন্যান্য সমাধান অনুমোদন করে। সমকামিতা নারীর শরীরের নিষ্ক্রিয়তার সঙ্গে, তার অপারগতার সঙ্গে, তার স্বাধীনতার সমন্বয়ের জন্য অন্যান্য প্রচেষ্টার মধ্যে একটা প্রচেষ্টা। বিভিন্ন মনোবৈজ্ঞানিক সমীক্ষার দ্বারা দেখা গেছে যে, প্রতিটা কিশোরী ভেদকরণ ও পুরুষ প্রাধান্যকে ভয় পায়। পক্ষান্তরে নারীদেহ তার কাছে একটা কামনার বস্তু। এবং পুরুষের কাছেও তা কামনার বস্তু। অন্যদিকে যদি প্রকৃতির কথা বলা হয়, তবে সব নারীই প্রাকৃতিকভাবে সুপ্ত সমকামী প্রবনতাসম্পন্ন। নারীদেহ নারীকে শঙ্কিত করে না, তার বোন ও মায়ের সঙ্গে তার প্রায়ই একটা অন্তরঙ্গ পরিচয় হয়। যাতে অবচেতনে স্নেহ-ভালবাসা সূক্ষ্ণভাবে যৌন অনুভূতিতে রঞ্জিত হয়। মেয়েদের মধ্যে পারস্পরিক আদর-সোহাগে কোনও কুমারীত্ব নাশের ভয় থাকে না। যৌন ভেদকরণও থাকে না অথচ কৈশোরের যৌন উত্তেজনাতেও তৃপ্ত করে। কুমারী মেয়েটা কোনো নতুন অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা ছাড়াই তার বৃত্তিটা উপলব্ধি করতে পারে।

শঙ্করী মুখোপাধ্যায়ও তাঁর 'বাংলা সাহিত্যে নারী সমকামিতা' বইতেও সিমোনের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বণি তুলেছেন। তিনি লিখেছেন,

‘যখন একটি মেয়ে শৈশবে মায়ের প্রাধান্যতা থেকে বেরিয়ে তরুণী হয়ে ওঠে, তখন সে তার মায়ের অধীনতা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনতে চায় ও তার তারুণ্যের পুর্ণতাকে বাইরের জগতে উপলব্ধি করতে উৎসাহ পায়। ফলে সে অন্যের চেতনায় থাকার প্রয়োজনবোধ করে এবং প্রায়ই দেখা যায় যে এই উৎসাহ ও সাহায্য সে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে পেয়ে থাকে এবং বান্ধবীরা তাকে তার যৌনতার বিষয়ে বিভিন্ন নতুন তথ্য জানার বিষয়ে সাহায্য করে। বান্ধবীদের কাছে তার নারীদেহ তাকে শঙ্কিত করে না। কারণ শৈশব থেকেই তার বোনদের সঙ্গে ও মায়ের সঙ্গে তার একটা অন্তরঙ্গ পরিচয় হয়। যাতে স্নেহ ভালবাসা সূক্ষ্ণভাবে যৌন অনুভূতিতে রঞ্জিত থাকে। এই সময় দুটি বান্ধবী একে অন্যকে পৃথক ভাবে না ও তাদের অহং সীমা ছাড়িয়ে যায় না। এভাবে পরস্পর পরস্পরের কাছে এক প্রকা্র মানসিক আশ্রয় পায়, যা তাদের দুজনকেই নিজের নিজের কাছে আত্মমর্যাদা দেয়। এর ফলে একটি মেয়ে তার বান্ধবীর কাছে নিজের নগ্নদেহ দেখায়, নিজের স্তনের তুলনা করে। যা আমরা বোর্ডিং স্কুল, মেয়েদের হোস্টেল, বেশ্যালয় ইত্যাদি জায়গাগুলোতে প্রায়ই দেখতে পাই। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবে বোনদের মধ্যে এই ব্যাপারগুলো খোলাখুলিভাবে হয়ে থাকে। তার সুস্পষ্টভাবে আদর-সোহাগ বিনিময় পর্যন্ত করে থাকে সেখানে যৌনতার তুলনায় – সমপ্রেমই বেশি লক্ষিত হয়।'

কিন্তু, মল্লিকা বাহারে শোভনা আর মল্লিকার সম্পর্ক, শঙ্করী মুখোপাধ্যায়ের বর্ণনাকৃত নিষ্কাম সমপ্রেমের নয়, এই সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছে তীব্র যৌনতাও, পরস্পরের প্রতি দুজনের টান থেকে বের হচ্ছে দেহজ প্রেমের মাতাল গন্ধ। মল্লিকা বাহার গল্পের শেষাংশ পড়লে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্রও কোনো সংশয় থাকে না।

‘মল্লিকা বুক যেমন হিম শুধু অতিশয্যেই। আপনকার গলা পরিষ্কার করে বললে, ‘আচ্ছা সে আচ্ছা শোভনাদি … না থাক …?

‘বলো না, বলো না।‘

‘আচ্ছা আপনি কখনও কাউকে ভালবেসে ….’

মল্লিকা, শোভনা তার হাত দুটো ধরে টেনে আপনার কাছে আনল, কাঁচের চুড়ি ভেঙে টুকরো, ভাঙার শব্দ এতই অল্প যে, লোক জড় করলে না অথচ বিজ্ঞরা বলবেন প্রয়োজন ছিল।

শোভনা আপনার মধ্যে মল্লিকাকে এনেছে, সোহাগ করে মালা পরিয়ে দিয়েছে, সে মালা তার কণ্ঠে বিলম্বিত, চুম্বনে চুম্বনে শোক ভুলিয়ে দিয়েছে।

এবার শোভনা খাদের গলায়, ‘কই তুমি তো আমায় খেলে না? তুমি আমায় ভালবাসো না?’

‘বাসি!’

‘মল্লিকা শোভনাকে বিশেষ অপটুতার সঙ্গে গভীরভাবে চুম্বন করলে।‘

শোভনা জিজ্ঞাসা করলে, ‘আগে কাউকে কখন এমনভাবে …’

‘হ্যাঁ, আচ্ছা আপনি?’

‘আমায় তুমি বলো, আমি তোমার কে? বলো?’

‘আচ্ছা তুমি?’

‘না’, দৃঢ়কণ্ঠে শোভনা বললে। বোধহয় মিথ্যা হেসে বললে, ‘আমি তোমার স্বামী, তুমি –‘

‘বউ’

শুনে শোভনা আবেগে চুম্বন করলে। শোভনার মুখসৃত লালা মল্লিকার গালে লাগল।'

রোজামন্ড লেম্যান তাঁর ‘ডাস্টি আনসার’ উপন্যাসে এ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, প্রায় সমস্ত তরুণী মেয়েদের মধ্যে সমকাম প্রবণতা রয়েছে। যে প্রবণতা কদাচিৎ আত্মরতিমূলক উপভোগ থেকে পৃথক করা যায়। অ্যাড্রিয়েন রিচও মোটামুটি একই কথাই বলেছেন। তাঁর ভাষায় ‘প্রত্যেক নারীর মধ্যে রয়েছে একটি নারী সমকামী, সে অভিভুত হয় নারীশক্তি দিয়ে, সে আকর্ষণ বোধ করে শক্তিশালী নারীর প্রতি।‘ মল্লিকা বাহার গল্পের মল্লিকাও সেই একইভাবে আকৃষ্ট হয়েছে পুরুষালি আভা দীপ্ত, শক্তিশালী নারী শোভনা দির প্রতি।

সব নারীর মধ্যে যতোই সমকাম প্রবণতা থাকুক না কেনো, সমাজ এটাকে কখনোই স্বাভাবিক হিসাবে মেনে নিতে পারে নি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীর সমকামকে মেনে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে যে, নারীবাদীরাও চেপে রাখতে চেয়েছে এই বিষয়টাকে। বোনি জিমারম্যান তাঁর ‘যা কখনো ছিলো না’ প্রবন্ধে নারীসমকামবাদকে উপেক্ষার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। পিতৃতন্ত্র স্বীকার করে শুধু বিষমকামকে। এটা তাকে স্বস্তি দেয়, আধিপত্যের অপার আনন্দ দেয়। জিমারম্যান দেখান যে, শুধু পিতৃতন্ত্রই নয়, নারীবাদীরাও দীক্ষিত পিতৃতন্ত্রের বিষমকামবাদে। তাই নারীবাদী সংগ্রহ থেকে বাদ পড়েন নারীসমকামী রেনি ভিভিয়েন ও র‍্যাডক্লিফ হল, বা সংকলিত হয় ক্যাথেরিন ফিলিপস ও অ্যাড্রিয়েন রিচের বিষমকামী বা নিষ্কাম রচনা, যদিও তাঁরা বিখ্যাত নারীসমকামী লেখার জন্য। জিমারম্যান বলেন,

‘যখন পরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত কোনো সংগ্রহে থাকে স্ত্রী, মাতা, যৌনসামগ্রী, তরুণী, বৃদ্ধা এবং মুক্ত নারী প্রভৃতি বিভাগ, কিন্তু থাকে না নারীসমকামী – তখন তা বিষমকামবাদ। নারীবাদী সংগ্রহে বিষমকামবাদ – পুংকেন্দ্রিক সংগ্রহে লিঙ্গবাদের মতো – মুছে ফেলে নারীসমকামবাদী অস্তিত্ব এবং লালন করে এ-মিথ্যেটি যে নারী শুধু পুরুষের মধ্যেই খোঁজে কাম ও আবেগের তৃপ্তি, বা একেবারেই খোঁজে না।’ (নারী- হুমায়ুন আজাদ)

যে নারীসমকাম পশ্চিমেও এতো সংকট মোকাবেলা করেছে, সেই বিষয় নিয়ে লেখার দুঃসাহস যিনি বাংলাতে করতে পারেন, তিনি যে তাঁর সময়ের চেয়ে বহুগুণে এগিয়ে ছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই রাখাটা শোভন নয়। এমন একটা সময়ে তিনি এই বিষয়টাকে নিয়ে এসেছেন যখন সমাজ এর জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়, এটা বললে কম বলা হবে, বলা যেতে পারে যে এর অস্তিত্ব সম্পর্কেই ধারণা ছিলো না সমাজের বেশির ভাগ মানুষের। তারপরেও এই গল্প নিয়ে নীতিবাগীশরা খড়গহস্ত হন নি, তেড়ে আসেন নি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সমাজকে শুদ্ধ রাখার অভিপ্রায়ে।

এর কারণ হিসাবে সুনীল গাঙ্গুলী বলেছেন যে, ‘চতুরঙ্গ পত্রিকায় প্রকাশিত এই গল্প অনেকেই ধৈর্য ধরে পড়েন নি, পড়ার চেষ্টা করলেও অনেকে বোঝেননি।‘

আমার নিজস্ব ধারণা অবশ্য ভিন্নতর। এটা ঠিক যে মল্লিকা বাহারে কমলকুমার মজুমদার কঠিন এবং ব্যতিক্রমী ভাষা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু, তাঁর সুহাসিনী পমেটম উপন্যাসের মতো অমন কঠিন ভাষা ব্যবহৃত হয় নি মল্লিকা বাহারে। বরং বলা যেতে পারে যে, শুরুর দিকের তাঁর গল্পগুলোর ভাষা, পরের দিকের তাঁর উপন্যাসের ভাষার চেয়ে অনেক সহজ। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে এ গল্প বুঝতে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। বিশেষ করে শেষের অংশটুকু এতোই সরাসরি বলা হয়েছে যে শিক্ষিত যে কোনো বাঙালির জন্যই সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই।

এ নিয়ে হইচই না হবার মূল কারণ সম্ভবত এই যে, চতুরঙ্গ পত্রিকার পাঠক সংখ্যা প্রচণ্ড রকমের সীমিত ছিলো। হাতে গোনা অল্প কিছু সংখ্যক কিছু মানুষ গল্পটা পড়েছে। এবং সেই স্বল্প সংখ্যক মানুষ এই গল্পের অর্থ বুঝলেও, এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া কমলকুমার তখন একেবারে অপরিচিত একজন মানুষ সাহিত্যজগতে। তাঁর কোনো লেখা সমাজে সামান্যতম প্রভাব বিস্তার করার মতো অবস্থায়ও ছিলো না। এর অনেক পরে এসে সমরেশ বসু তাঁর বিবর এবং প্রজাপতি উপন্যাস নিয়ে এই সব নীতির কাণ্ডারীদের যে কঠিন সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন, সেটা দেখলেই এই বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যায়। বিবর প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৬৫ সালে। প্রকাশের পরেই একে অশ্লীল ঘোষণা দিয়ে সমরেশ বসুকে নিয়মিত আক্রমণ করা হয়েছে।

১৯৫০ সালে অপ্রস্তুত সমাজে যে বিপ্লবের চিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন কমলকুমার মজুমদার, তারই ফসল হিসাবে পরবর্তীতে অনেক লেখকই বিশেষ করে নারী লেখকেরা এগিয়ে এসেছেন নারীসমকামের এই অনালোকিত বিষয়ের উপরে লেখালেখি করার জন্য। বাধের কারণে আটকে পড়া নদীর প্রবেশমুখের অর্গল খুলে একে সাগরের দিকে ধাবিত করার প্রধান পুরুষ তিনি।

মল্লিকা বাহারে যে বাহারি ভাবনা তিনি প্রকাশ করেছেন প্রথমবারের মতোন, সেই বাহারি ভাবনা আজকে নিত্য সত্যি হয়ে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে প্রতিটা ঘরে, প্রতিটা মানুষের মস্তিষ্কলোকে।

6404 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।