ঘরে ঢুকেই একটানে চুল খুলে হাতের ঝোলা ব্যাগটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। নিজের গালে নিজেই চড় মারতে ইচ্ছা করছিল। কত মানুষ বাসে চলাফেরা করছে প্রতিদিন। তাদের সাথে তো এসব ঘটে না। আর আমিও সপ্তাহে ছয়দিনই বাসে যাচ্ছি, এমনt তো হয় না। দুই একবার স্যান্ডেল ছিঁড়েছে, শাড়ি ফুটা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ধাক্কা এদিক ওদিক ছোঁয়া এসব এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজকের মতো এমন ঘটনা এর আগে ঘটে নাই। দু-দুইবার এ কী অবস্থায় পড়তে হল আমায়।
আমি যে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেই ‘শাড়ি আমার প্রিয় শাড়ি’ এই শাড়ি আমাকে আজকে কত বেকায়দা অবস্থায় ফেলল। কাঁধের কাছে ব্লাউজের সঙ্গে আটকানো সেফটিপিন ছিঁড়ে বাসের বন্ধ দরজায় গিয়ে মুখ ঢাকল আমার নকশি করা আঁচল। এবার আমি কোথায় মুখ লুকাই? টান মেরে আঁচল ছুটাতে যেয়ে একটা পাশ রয়েই গেল দরজার মাঝখানে। কিছু নির্লজ্জ চোখের পিটপিটানি চাহনি দেখে আমার মাথার ভিতর প্রলয়ংকর ঝড় শুরু হয়। ঠোঁটের কোণে হাসি, সেও তো আমার চোখ এড়ালো না। রিক্সাওয়ারা চাকায় চাকা আটকে গেলে যেমন খিস্তি করে ওরকম গালি দিতে ইচ্ছা করছিল। ভাবলাম প্রলয়ংকর ঝড় কেলেঙ্কারিতে যেন পরিণত না হয়! তারচেয়ে পরের স্টপেজে নেমে পড়াই ভালো। নেমে অপেক্ষা করতে থাকি আর একটা বাসের জন্য। বাড়ি ফেরার বাস এখন আর পাব না। শাড়িটা বদলে অফিস যেতে দুপুর হয়ে যাবে। অফিসে গিয়ে শাড়ির কুঁচি কমিয়ে আঁচল বড় করে ফেলব। শাড়ির সামনে কুঁচিগুলি হচ্ছে ফ্যাশন। বাসে রিক্সায় উঠতে নামতে যত ঝামেলায় ফেলে। পুরানো দিনের মতো ঘরোয়া একপেচে কোমরে আঁচল বেঁধে শাড়ি পরে বের হতে পারলে মনে হয় এতোটা হেনস্তা হতে হয় না। বিয়ের আগে জিন্স, সালোয়ার কামিজ, স্কার্ট সবই পরতাম। এই পাঁচ বছর এক নাগাড়ে শাড়ি পরছি কারণ আমার স্বামীর পছন্দ শাড়ি। আমার সব রাগ গিয়ে পড়ল এবার শাহানুরের উপর। মিষ্টি কথায় পটিয়ে আমাকে দিয়ে তার পছন্দ মতো সব কিছু করিয়ে নেয়। আমি জানি শাড়িতে আমাকে ভালো দেখায় কিন্তু আমার একটুও আরাম হচ্ছে না চলা ফেরায়। আজ শাহানুর অফিস থেকে ফিরলেই সোজা গিয়ে দুইসেট সালোয়ার কামিজ কিনে আনব। একই দিনে দ্বিতীয় প্রলয়ঙ্কর ঝড় অপেক্ষা করছিল আবার অফিসগামী বাসে।
ছোটবেলা থেকে মা ধমকে ধমকে আমার চুল কাটতে দিত না। ভাবতাম বিয়ে হলে মা আর আমার উপর খবরদারি করতে পারবে না। মনের সুখে তখন ইচ্ছা মত চুল কেটে ফ্যাশন করবো। আমার সেই সাধে গুড়েবালি! বিয়ের রাতে বর আমার চুলের খোঁপা খুলে দিয়ে বলল- ‘তোমার রেশমের মতো চুলে মুখ গুঁজে আমার সুখ।’ গেল আমার চুল কাটার শখ ভেস্তে!
ভেজা চুল বাঁধতে পারি না। মাথা ধরে, হাঁচি শুরু হয়ে যায়। শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হয়। রেশমের মতো চুল শুকানোর অপেক্ষায় অফিস দেরি হয়ে যায়। চাকরি টিকানো দায়। তাই ভেজা চুলেই বাসে উঠতে হয় প্রতিদিন।
দুপুরের মগজ গরম করা রোদে দাঁড়িয়ে আধঘন্টা পর একটা বাস পাই। দেখি প্রচন্ড ভিড়। ধাক্কা খেয়ে কোন রকম একটা সিটের পাশে এক ভদ্রলোকের হাঁটুর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। ছেড়া আঁচল কোমরে গুজে রিঙ ধরে রেখেছি। আজ শনিবার না হলেও তখনো বুঝি নাই শনির দশা আমার পিছনে অপেক্ষা করছে। আমার চুলে বেশ একটা টান লাগতেই পিছন ফিরে দেখি ভদ্রলোক তার সার্টের বোতাম থেকে আমার চুলের গিট ছাড়াতে হিমসিম খাচ্ছে। আমি তাকাতেই অপরাধির মতো মুখ করে বোঝাতে চাইল এখানে তার কোন হাত নাই। এই ঘটনার অপরাধি হচ্ছে শাহানুরের প্রিয় রেশমের মতো চুল। আমার সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল হাতের কাছে একটা কাঁচি যদি পাওয়া যেত এখনি খচখচ করে চুলের গোছা কেটে ভদ্রলোককে বিপদ থেকে উদ্ধার করতাম।
আমি দাঁড়িয়ে থাকলে নিচু হয়ে বোতাম থেকে চুল ছাড়ানো যাবে না। বললাম, আপনি দাঁড়ান। ভদ্রলোক খানিকটা হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি তার জায়গাটায় বসে পড়লাম।
-আপনার কাছে কাঁচি আছে?
ভদ্রলোকের চোখ দুইটা রীতিমতো গোল হয়ে গেল।
-কাঁচি দিয়ে কী করবেন?
-চুল কেটে ফেলব না হয় আপনার সার্টের বোতাম কেটে দেব।
- কী বলেন?
- আপনি বলুন এছাড়া আর কী উপায় আছে?
- একটু চেষ্টা করা যায় না?
- দেখি চেষ্টা করে।
ভাগ্য ভালো বলতে হয় চেষ্টায় কাজ হলো। উদ্ধার পেতেই আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। বললাম- আপনি বসুন।
- না না আপনি বসুন। আমি পরের স্টপেজে নেমে যাচ্ছি।
তৃতীয় কোনো ঝামেলায় আর পড়তে চাইলাম না। আমিও পরের স্টপেজে বাস থেকে নেমে সোজা একটা সিএনজি নিয়ে বাড়িতে এসে চুল কাটার জন্য কাঁচি খুঁজতে থাকি। আজ এই ঝামেলা এক্ষুনি এই মুহূর্তে শেষ করে ফেলতে হবে।