সুষুপ্ত পাঠক

বাংলা অন্তর্জালে পরিচিত "সুষুপ্ত পাঠক" একজন সমাজ সচেতন অনলাইন একটিভিস্ট ও ব্লগার।

অভিজিৎ রায়ের বহুমাত্রিক খুনিরা

অভিজিৎ রায়কে খুন করেছে ফান্ডামেন্টালিস্টরা, আর এই খুনের ইন্ডিমনিটি দিয়েছে মডারেটরা। অভিজিৎ রায়ের লেখার জন্য একদল খুন করেছে তাকে, আরেকদল তার লেখাকে নিষিদ্ধ করেছে। অভিজিৎ রায় জানতো একদল তালেবান টাইপ ইসলামপন্থী তাকে অরক্ষিত অবস্থায় পেলে হত্যা করতেও দ্বিধা করবে না। কিন্তু তিনি যেটা জানতেন না- তার রক্ত মোছার কাজে নিয়োজিত হবে তারাই যারা সাম্প্রদায়িক আর মৌলবাদ বিরোধী…। অভিজিৎ জানতেন কিনা জানি না, সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে বিভাজিতরাই এ দেশের অসাম্প্রদায়িকতার সোল এজেন্ট…।

অভিজিতের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে তাঁর লেখা সমস্ত বই বাংলাদেশ থেকে অঘোষিতভাবে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে তো বিজ্ঞান জাদুঘরও আছে! আছে বিজ্ঞান পত্রিকার অফিস, জ্যান্ত বিজ্ঞান লেখক, চিন্তক- কই এইসব প্রতিষ্ঠান আর ব্যক্তির উপর তো হামলা হয় না! তাদের বইকে বইমেলায় নিষিদ্ধ করা হয় না। মানে আপনি অভিজিৎ রায়- আপনার লেখা দিয়ে, আপনি এই বাংলাদেশের সবার বিশ্বাসের জায়গাতে আঘাত করেছিলেন। কেউ তাই তাদের সাধ্যের মধ্যে আপনাকে ‘সালাফি সেক্যুলার’ বলে অপমান করে গায়ের ঝাল মিটিয়েছে। কেউ নাস্তিকতার আস্ফালন বলেছে। কেউ চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছে। আর যাদের মুরগীর রক্ত দেখলেও হাত-পা কাঁপে- সেইসব কীর্তিমান বিদ্যানরা আপনার লেখাকে খুন করতে চেয়েছে…।

হুমায়ুন আজাদ অনেক চাঁছাছোলা কথা বলতেন। তিনি বাংলাদেশী জনপ্রিয় উপন্যাসকে ‘অপন্যাস’ বলেছিলেন। বাংলাদেশের এক বিরাট অপন্যাসের পাঠক আছে। এদের বয়েস কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাঠকার্যক্রম পর্যন্ত। এরা অবসর সময়ে অপন্যাস পড়ে। অপন্যাস পড়ার সুবিধা হলো এসব পড়লে কোনো আদিম অনুভূতিই আঘাত প্রাপ্ত হয় না। এসব পড়েও দিব্যি ওহাবী সুন্নি, মুসলিম ব্রাদারহুড, জাকির নায়েক খাপে খাপ বসে যায়। তাদের পাঠকদের সেরকম অবস্থান নিতে কোনো বুদ্ধিভিত্তিক প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয় না। তারা এমন কিছুকে তাদের রচনার বিষয়বস্তু কোনোদিন করেন নি যেটা একজন ধর্মান্ধকে আঘাত করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে কোনো জাতির কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা দূর করা যায় না। বিজ্ঞান সাময়িকীর উপদেষ্টা যদি পাক্কা নামাজী হোন- তাহলে সেই বিজ্ঞানে পঙ্খিরাজ ঘোড়াও সাত আসমান ঘুরে আসতে পারে। দিন রাত পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভেদ করে ঈশ্বরের দুতেরা আসা-যাওয়া করতে পারে। এরকম বিজ্ঞানমনস্ক তরুণের জন্য পরবর্তীকালে জিহাদ করতে সিরিয়া যেতে কেবল ভিসা আর বিমান ভাড়াই প্রতিবন্ধক হতে পারে- তার বিজ্ঞানমনস্কতা নয়।

অভিজিৎ রায় এই দুর্গেই হানা দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’। এই বই কেবল হাটহাজারী, চরমোনাই দরবার শরীফই কাঁপিয়ে দেয় নি, কাপিয়েছিলো ডান বাম মধ্যম মৃদু উচ্চ সব মহলকেই। এক ব্লগ বিপ্লবী বলে বসলেন, অভিজিৎ রায় সালাফী সেক্যুলার। অভিজিৎ রায় কট্টর, উগ্র…। অভিজিৎ রায় তার বইতে লিখেছিলেন, ঘাসফড়িং যেমন নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম নামের এ ধরণের ভাইরাসের কারণে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে, পিঁপড়া যেমন ল্যাংসেট নামের ভাইরাসের কারণে অর্থহীন পাথরের গা বেয়ে উঠানামা করে, তেমনি ধার্মীক তার অন্ধবিশ্বাসের কারণে কোনো যুক্তি ছাড়াই ধর্মকে অন্ধ অনুসরণ করে। একটা তরতাজা তরুণ জান্নাত পাবার আশায় নিজের জীবনকে উড়িয়ে দিতে দ্বিধা করে না কেবল বিশ্বাসের ভাইরাসের মতো প্যারাসাইটের কারণেই…।

এই বইয়ের প্রতিক্রিয়ায় ফারাবীর মতো ফান্ডামেন্টালিস্টরা প্রকাশ্যে অভিজিৎ রায়কে হত্যার হুমকি দিলো। পিয়ানো বাজানো মানসিক খুনিরা রক্তপাত সহ্য করতে পারে না। কিন্তু চাইছিলো এই মেধাটাকে থামাতে হবে যে করেই হোক…। এই মানসিক বোঝাপড়া একদলকে পরিস্থিতি বুঝতে সুবিধা করে দিলো। জাতির প্রগতিশীলরা কন্ঠ মেলালো, চাপাতী বাহিনী আহত হয় এমন বই প্রকাশ করা যাবে না…।

রকমারী ডট কম অভিজিৎ রায়ের সমস্ত বই তিনি বেঁচে থাকতেই নামিয়ে ফেলেছিলো। তার বদলে তাদের সাইটে মাওলানা মওদুদি’র মতো জিহাদ চিন্তকদের বই রাখা হতে থাকলো। বাংলা একাডেমিও রাষ্ট্রীয় জিহাদ প্রকাশনা সংস্থা ইসলামী ফাউন্ডেশনের স্টল বরাদ্দ রেখে মুক্তচিন্তার প্রকাশনীগুলোর উপর অদৃশ্য খড়গ চালিয়েছে। কারণ অভিজিৎ রায় ও তার সমমনা লেখকদের বই সেই তরুণদের সৃষ্টি করতে পারে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে সমস্ত প্রচলিত বিশ্বাসকে। দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর দাঁড়ানো প্রগতিশীলদের ভয়ও অভিজিৎ রায়।

হুমায়ূন আজাদকে আক্রমণ করার পর তার সহ লেখকদের অনেকেই আজাদের লেখাকেই হামলার জন্য দায়ী করেছিলো। এমন লিখলে এমনই হবে। আজাদ লিখেছিলেন, পৌত্রের ঔরষে জন্ম নিচ্ছে পিতামহ। এই পিতামহটি হচ্ছে ৪৭ সালের দ্বিজাতি তত্ত্ব, যার নতুন করে জন্ম হচ্ছে। তারাই এখন বাংলা একাডেমিতে বসে চা-বিস্কুট খেতে খেতে জাতির মননের চর্চা করেন। এমন কথা সহ্য হবে কিভাবে ঢাকার প্রগতিশীল মুসলমানদের?

সত্যের জয় একদিন হবেই- এরকম ভাববাদী আশাবাদ কোনো নাস্তিক মুক্তমনার নেই। কেননা সত্যের জয় নিশ্চিত করতে কোথাও কোনো মহাশক্তিধর বসে নেই আমাদের জন্য। আমরা কেবল আশা করতে পারি এ জন্য যে, মানুষের চিন্তাকে কোনো দেয়াল দিয়ে, শেকল পড়িয়ে, ভয় দেখিয়ে দীর্ঘকাল বদ্ধ করে রাখা যায় না। এ কারণেই মুক্তচিন্তাকে একটা সাময়িক সময়ের জন্য বাধাগ্রস্ত করা যায় সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। কিন্তু মানুষের চিন্তা ঠিকই সীমানা পেরিয়ে বহুদূর ধাবিত হয়। তাই এই রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় অভিজিৎ রায়ের কোনো রচনাই হারিয়ে যাবে না। তার নামও মুছা যাবে না। এখনো বাংলা ভাষার মুক্তমনা লেখকরা লিখে যাচ্ছেন। তাদের রচনা বুদ্ধির মুক্তি, চিন্তা করতে অদম্য সাহস ঠিকই জুগিয়ে যাবে। অভিজিৎ রায়ের হত্যার বিচার চাই না। আগেও চাই নি। অভিজিৎ খুন হয়েছেন একদল প্যারাসাইটের আক্রমণে। আর সেই খুনকে যারা এখনো বিচারের বাইরে রাখছে তারাও একই প্যারাসাইটের শিকার। তারা অভিজিৎ হত্যার বিচার করবে না…। তাই অভিজিতের রচনার নব প্রকাশই হবে তাঁর আত্মদানের সবচেয়ে বড় সম্মান। জয়তু মুক্তচিন্তা। আলো হাতে আপনি একাই পথ চলেন নি প্রিয় অভিদা, আমরাও আছি। অবিরাম পথ চলতেই থাকবো….

2097 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।