শারমিন শামস্

সমাজকর্মী শারমিন একজন ফিল্মমেকার ও সাংবাদিক।

এভাবেই পুরুষতন্ত্রের নোংরা মুখে আঘাত হানুক সুন্দর পুরুষ!

“আমি যখন বাচ্চাকালে চাকরিতে ঢুকলাম, আমার বস যিনি ছিলেন তার বয়স ছিলো পঞ্চাশের অনেক উপ্রে। তিনি আমারে "এই সুন্দরী ইদিকে আসো" কয়া ডাক দিতেন এবং তার সামনে অযথাই বসায়া থুইতেন। 

এরপর বড় হইসি, বুদ্ধি বাড়ছে, লুচ্চা সামলানো শিখসি। এক অফিসে এক লোক হঠাৎ বস হইলো। ঈদে ছুটি চাইতে গেলাম। বললাম, আমার ফ্যামিলির সবাই শ্বশুরবাড়িতে ঈদ করবে, আমিও যাবো, ছুটি দেন। 
তিনি ফিস ফিস কইরা কইলেন, যাক না সবাই, শুধু আমি আর আপনি থাকবো। 

এর পর তিনি প্রায় দিনই আমারে ফোন দিয়া জিগাইতেন আমার বাসায় কেউ আছে কি না আর কেউ না থাকলে তিনি আসতে চান। উত্তরে পরবর্তী শুক্রবারে তারে বউসহ দাওয়াত দিলাম। এর প্রতিশোধ স্বরূপ তিনি আমারে পৃথিবীর সকল ফালতু এসাইনমেন্ট দেয়া শুরু করলেন এবং আমার সকল স্পেশাল স্টোরি আটকায়া দিলেন।

আমি তার সাথে নয়, তার হবু ডাক্তার পুত্রের লগে লং ড্রাইভে যাইতে আগ্রহী।

আরেক অফিসে এক বুড়া হাবড়া আমারে রেগুলার কি কি সব কইতেন। একদিন কইলেন, তার ইচ্ছা আমি তার পাশে বইসা লং ড্রাইভে যাই।

তার পুত্র তখন মেডিকেলে পড়তেন, প্রায় আমারি বয়সী। আমি বুড়ারে জানাইলাম, আমি তার সাথে নয়, তার হবু ডাক্তার পুত্রের লগে লং ড্রাইভে যাইতে আগ্রহী।
বুড়া থামলেন।

এর পর জীবনে আরো বহু লুচ্চা বস, সহকর্মী দেখছি। বয়স কম কালে লুচ্চারে লুচ্চা স্পষ্ট করে কইতে সামান্য সমিস্যা হইতো। এখন আর হয় না। এখন আমি মনে করি, যথাসময়ে তারে তো বটেই, পুরা দুনিয়ারে জানায়ে দিতে হয় সে লুচ্চা এবং অফিসে বইসাই লুচ্চামি করতেসে।

এদেশের প্রতিটা মেয়ের এই বস্তু বুকে ধারন করে কর্মক্ষেত্রে পা রাখা উচিত।”

গতকাল ফেসবুকে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিয়ে নিজের জীবনের এই অভিজ্ঞতার গল্প লেখার পর থেকে এগারোটা চিঠি পেয়েছি। এক একজন মেয়ে নিজেদের জঘন্য সব অভিজ্ঞতার কথা আমাকে লিখে মন হালকা করতে চেয়েছেন। কেউ কেউ কয়েকটা সমস্যার সমাধানও জানতে চেয়েছেন। 

তারা যা যা লিখেছেন, এগুলো কোনটাই নতুন না। বিষয়গুলো আমাদের সামনে আসে না বলেই আমরা জানতে পারি না। এই যেমন এগারোটি মেয়ে আমাকে নীরবে ইনবক্স করেছেন। মনের বেদনা তারা গোপনে আমাকে জানিয়েছেন। আমি তাদের প্রত্যেককে সরব হবার অনুপ্রেরণা দিতে চেয়েছি। কারণ এই সমস্যা সমাধানে সরব হওয়াই একমাত্র কার্যকর সমাধান।

আমি মনে করি, যথাসময়ে তারে তো বটেই, পুরা দুনিয়ারে জানায়ে দিতে হয় সে লুচ্চা এবং অফিসে বইসাই লুচ্চামি করতেসে।

আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছি। আমি যখনই যা লিখি, আমার উদ্দেশ্য থাকে আমার লেখাটা যেন একজন হলেও মেয়েকে সাহসী করে। তারা বলার সাহস পাচ্ছে না, আমি অবলীলায় বলছি- এই বিষয়টিই তাদের ভাবাক। তারা দেখুক, সত্য বললে বাঘে খায় না। প্রতিবাদ করতে ভয় পাওয়াটা নিয়ম নয়। মুখ বুজে থাকাটাই নারী জীবনের ভবিতব্য নয়। বরং মানুষের মতো বাঁচতে, মাথা উচু করে চলতে সবার আগে শিখতে হয় প্রতিবাদের ভাষা। 

আমাদের বাঁচার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখে পিতৃতন্ত্র। এই পিতৃতন্ত্রের নোংরামিকে সজোরে আঘাত করাটাই এখন সময়ের দাবি। আর কিছুই নয়। মাথা নিচু করে তুলতুলে নরম কোমল মন নিয়ে সেই আঘাত হানা সম্ভব নয়। 

দীর্ঘ তিন বছর পর আমি আবার সাংবাদিকতায় ফিরেছি। পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালের নাম সারাবাংলা, গাজী গ্রুপের একটি ভেঞ্চার। নতুন পত্রিকার জন্য নতুন অফিস তৈরি হয়েছে, নতুন কম্পিউটার, ডেস্ক, নতুন কলিগ, নতুন স্বপ্ন। তরুণ সহকর্মীদের উৎসাহ মাখা ঝলমলে মুখ দেখি আর মন ভালো হয়ে যায়। নতুন অফিসের ফ্লোরে প্রবেশের প্রথম দিন একটা মিটিং হলো সবাইকে নিয়ে। এটা সেটা প্ল্যানিং- অনেক কথা হলো। আমাদের ম্যানেজিং এডিটর সানা ভাইও অনেক কথা বললেন। কী করতে চাই কেনো করতে চাই। এইসব টুকরো কথার ফাঁকে তিনি খুব সুন্দর আর স্পষ্ট ভাষায় কয়েকটা কথা জানিয়ে দিলেন। কথাগুলো আমাদের পুরুষ সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে। দুটো শব্দ বললেন তিনি। জিরো টলারেন্স।

হুম, এই অফিসে কোনো মেয়েকে কোনো ধরণের যৌন হয়রানি বা যৌন উস্কানিমূলক কোনো ধরনের আচরণ, কথা, মন্তব্য, স্পর্শ বা এ ধরণের কোনো কিছু কেউ করেছে অভিযোগ পাওয়ামাত্র সেই পুরুষকে ছেড়ে যেতে হবে এই অফিস। ''জিরো টলারেন্স''। হ্যাঁ, বিন্দুমাত্র সহানুভূতি পাবে না কেউ। 

এভাবেই নোংরা ইতিহাসগুলো একদিন মুছে যাবে।

আমি তাকালাম আমার সহকর্মী মেয়েদের দিকে। স্বস্তি আর নির্ভরতার আলো খেলে গেলো মুখগুলোতে। সামনে বসে থাকা নির্বাহী সম্পাদক মেনন ভাই আর ম্যানেজিং এডিটর সানা ভাইয়ের এই কয়েকটা কথাই আরো প্রত্যয়ী করেছে সাংবাদিক মেয়েগুলোকে। ওরা আশা করতে শিখছে, বিশ্বাস করতে শিখছে, হ্যাঁ, দুনিয়াটা এখনও পুরোটা পচে যায় নি। সাহস করে প্রতিবাদ জানালে প্রতিকার পাওয়া যাবে, নিরাপদে কাজ করা যাবে, শান্তিতে শ্বাস ফেলা যাবে, নির্বিঘ্নে অফিসে কাটিয়ে দেয়া যাবে কর্মব্যস্ত সময়গুলো। 

হয়তো এভাবেই নোংরা ইতিহাসগুলো একদিন মুছে যাবে। আসবে সুন্দর দিন। এভাবেই নারীর পাশে বন্ধু হয়ে দাঁড়াবে পুরুষ। এভাবেই পুরুষতন্ত্রের নোংরা মুখে আঘাত হানবে সুন্দর পুরুষ। 

ধন্যবাদ সানা ভাই। ধন্যবাদ মেনন ভাই। সারাবাংলা হয়ে উঠুক একটি নারীবান্ধব মিডিয়া হাউজ। আমাদের সকল পুরুষ সহকর্মীকে অভিনন্দন। তারা হাউজের পলিসির প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাবেন তার প্রমাণ আমরা পেতে শুরু করেছি। 
সবার জন্য ভালোবাসা। 

7018 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।