অদিতি ফাল্গুনী

লেখক ও কলামিস্ট

বহুগামীতা: পুরুষের জন্য ধর্মীয় বিধান নারীর জন্য চরিত্রহীনতা

বাংলাদেশে বা পুরো পৃথিবী জুড়েই নানা দেশে বা সভ্যতায় কোথাও আইন আর কোথাও ধর্মের সাহায্যে পুরুষ আজো বহুবিবাহের ক্ষমতার অধিকারী। দেড়শো/দু’শো বছর আগের সময়ের প্রেক্ষিতে লেখা বাংলা সাহিত্য পড়লেই দেখা যাচ্ছে বাঙ্গালী হিন্দু বিশেষত: কুলীন ব্রাম্মণ পুরুষ শত শত বিয়েও করার ক্ষমতার অধিকারী। নব্বইয়ের বৃদ্ধ নয়ের শিশুকে বিয়ে করে হয়তো সেই শিশুর উনত্রিশ বা উনচল্লিশের পিতাকে চিরকৃতজ্ঞ করছে।

ভারতে অবশ্য ১৯৫৫ সালে জহরলাল নেহেরুর সময়ে হিন্দু আইন অনেক সংস্কার হয় ও হিন্দু বিবাহিত পুরুষ সেখানে দু’টো বিয়ে করতে পারে না। বাংলাদেশে হিন্দু আইন সংস্কার না হলেও সামগ্রিক ভাবে জনসংখ্যাই এতো কম যে একটির জায়গায় দু’টো বউ পাওয়াই তো কঠিন। একইভাবে ইসলাম ধর্মে একজন পুরুষের চারটি বিয়ে করার ক্ষমতা থাকলেও ১৯৬১ সালে আইয়ুব খানের সময়ে এই আইন তদানীন্তন পাকিস্থানে সংস্কার হয় যার সুফল স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙ্গালী মুসলিম নারীও ভোগ করছেন।

তবু, পুরুষের বহু নারী ভোগের একটি লিখিত বা অলিখিত ক্ষমতা থেকেই যায়। গ্রামে-গঞ্জে আজো অনেক নারী ১৯৬১ সালের আইন জানেনই না। আজো অনেক গ্রামে ‘এক তালাক দুই তালাক তিন তালাক- বাইন তালাক’ বা ‘হিল্লা বিয়ে’ প্রচলিত। ইসলামে নারীর ‘ডেলিগেটেড পাওয়ার অফ ডিভোর্স’ থাকলেও আজো এ সমাজ ভাবতেই পারে না যে একজন নারী কাউকে উল্টো ‘তালাক’ বা ‘ডিভোর্স’ দিতে পারে। সে বড় জোর বরের কাছে ‘তালাক’ পেতে গেলে তার কাছে অনুনয় বা কান্না-কাটি করতে পারে- শাবানার মত পা জড়িয়ে ধরতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। অথবা, ‘তালাকপ্রাপ্ত’ স্ত্রী হয়ে সমাজের সহানুভূতি পেতে পারে। অথবা একজন নারী তখন তালাক দিতে পারে যখন তার বর তাকে দিনমান পেটায় বা খেতে দেয় না বা অন্য নারীর সাথে জড়িয়ে পড়ে, তখনো সমাজ মিনমিন করে হলেও মেনে নেয়।

কিন্ত, একজন পুরুষ, যেমন ধরা যাক অনেক সময়ই প্রথম প্রেমিকা বা প্রথম স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ বা আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে দ্বিতীয় কারো পাণি গ্রহণ করেন, তেমন কাজ যদি কোন নারী করে? তবে ত’ সে অবশ্যই চরিত্রহীণ! না- এখানেই আপনার বোঝার ভুল। যে নারী বা পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করেন, আপনি তাকে ‘কঠোর একগামী’ বলতে না-ও পারেন, তবে ‘চরিত্রহীন’ নয়। ঘরে বউ রেখে সেক্রেটারি থেকে কাজের মেয়ে বা মেয়েদের ক্ষেত্রেও ঘরে বর রেখে পাড়াতুতো দেবর থেকে কলিগ (হয় যে না একদম এমন নয়) সহ নানা প্যারালাল সম্পর্ক রাখার চেয়ে বিয়ে ভেঙ্গে নতুন কারো সাথে একনিষ্ঠ সততায় ঘর করাই বরং ‘একগামীতা।’

বরগুণার মেয়েটি দ্বিতীয়বার বিয়ে যদি করেও থাকে, তাতেই তার ‘প্রাক্তন’ বরের এসে ‘বর্তমান’ বরকে খুন করার কোনোভাবেই কোনো অধিকার জন্মায় না। কারণ কতো মেয়েকেই তো তার বর ছেড়ে যায়। মেয়েরা কি গিয়ে বরের নতুন বউকে কোপায়? মেয়ের বান্ধবী যায় রাম দা হাতে? যায় না কারণ মেয়েদের অস্ত্র বা পেশী শক্তি নেই। ছেলেদের এটা আছে বলে তারা সেই অস্ত্র বা পেশী শক্তির আস্ফালন করে।

আর যদি এই ঘটনা ‘ত্রিভুজ প্রেমের দ্বন্দ’-ই হয়, মেয়েটি কি পারিবারিক চাপে প্রথম প্রেমিক/বরকে ছেড়ে এসে দ্বিতীয় জনকে বিয়ে করেছিলো? এ সমাজে কয়টি মেয়ে আজো তার পছন্দের সঙ্গীকে বিয়ে করতে পারে? এমনকি এই হত্যাকান্ডে যদি মেয়েটির প্রচ্ছন্ন সমর্থন আগে থেকেও থাকে, দ্বিতীয় যে ছেলেটির সাথে সে কিছুদিন হলেও থেকেছে, তার প্রতিও নিশ্চিত তার মায়া তৈরি হয়েছিলো। কাজেই বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। যদি প্রথম প্রেমিক/বরের প্রতিই দুর্বলতা বেশি থেকে থাকে, তবে পরিবারের চাপে হয়তো সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। সেক্ষেত্রে মূল হত্যাকারী এই সমাজ যেখানে নর-নারীর প্রেমের চেয়ে ছেলেটির টাকা-কড়ি বেশি কিনা, সেটির ভিত্তিতে মেয়েদের বিয়ে দেয়া বা বিয়ে দেবার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। আর যদি সে স্বেচ্ছায় ছেড়ে আসে, তাতেও আগের ছেলেটির খুনের অধিকার জন্মায় না।

পুলিশের তদন্তে সব ঘটনাই বের হয়ে আসবে। এটাকে রাজনৈতিক হত্যাকান্ডই মনে করতাম যদি না ভিডিও ফুটেজে মেয়েটি হত্যাকারীদের একজনের কাছ থেকে ব্যাগ নিচ্ছে বা হত্যার পরে স্যান্ডেল পায়ে দিচ্ছে এমন তীক্ষ পর্যবেক্ষণমূলক একটি পোস্ট না পড়তাম। সবচেয়ে অবাক লাগলো গোটা দুপুর এটা ভেবে যে নারীকে কতোখানি ‘প্রপার্টি/সম্পত্তি’ আজো মনে করা হয় যে প্রাক্তন বর বা প্রেমিক শুধু নয়, তার পক্ষে তার বন্ধু রাম দা নিয়ে কোপানো শুরু করে! ‘খুন’ বা ‘নরহত্যা’র কোনো অনুতাপের ভাবনাই নেই। এখানে বন্ধুর আহত পৌরুষবোধে তারও পৌরুষবোধ আহত। যেনো তার নিজের ঘরের নারীটি কখনো অন্য কোথাও না যায়। সেই সাথে দেশে বিচার ব্যবস্থা কাজ করে না এই অভয়বোধ তো আছেই। হ্যাঁ, ‘রামায়ণ’ আর ‘ইলিয়াড’ যে কাব্য-কল্পনা নয়, ইতিহাসই ছিল সেটা খানিকটা মনে হচ্ছে বটে!

1942 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।