জেসমিন চৌধুরী

প্রবাসী, সমাজকর্মী

প্রসংগ : আত্মহত্যা, সমালোচনা নয়, চাই সহযোগিতা

কয়েক বছর আগে আচ্ছা এক বিপদে পড়েছিলাম। একদিন খুব মন খারাপের এক মুহুর্তে আমার এক সহকর্মীকে বলে ফেলেছিলাম, ‘জীবনের উপর আস্থা উঠে গেছে আমার, মৃত্যু এলে খুব একটা অসন্তুষ্ট হবো না।‘ একথা শোনার পর সে একেবারে ধরে পড়লো আমাকে। বাসায় কল করে জানতে চায় ঠিক আছি কি’না। ফেসবুকে যখন তখন নক করে জানায় সে আমার সাথে আছে। কাজে মুখ কালো করে থাকলেই এসে বলে, ‘উল্টাপালটা কিছু ভাবছো না তো?’ একদিন সে আমাকে বললো, ‘জেসমিন, আমি তোমার এই মানসিক অবস্থার কথা হেডমাস্টারকে বলতে চাই। হয়তো তোমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন যা সে আমার তোমার চেয়ে ভাল বুঝবে’।

মেয়েকে নিয়ে তখন একা থাকি লন্ডনের এক শহরতলীতে। জীবনের সাথে লড়তে লড়তে একেবারেই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। মনে হতো আর পারি না। এমন একটা সময় গেছে যখন মেয়ে স্কুলে যাবার সময় বলে যেতো, ‘মা কোনো বোকামি করো না যেন’। চৌদ্দ বছরের মেয়েটার উপরে এমন একটা দুশ্চিন্তার বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলাম ভেবে এখনো লজ্জিত বোধ করি, তার কাছে ক্ষমা চাই সুযোগ পেলেই। কিন্তু এরকম একটা সময় অনেকের জীবনেই আসে যখন সে নিজের কাছেই অসহায় হয়ে পড়ে। মাথা রাখার একটা ঘাড়, হাত রাখার একটা হাত, তা সে যত ছোটই হোক না কেনো, তখন প্রয়োজন হয়। সময় মত পাওয়া সেই ঘাড় বা হাত একটা জীবন বাঁচাতে পারে।

গত কিছুদিনে বেশ কয়েকটি আত্মহত্যার খবর এসেছে যার সবগুলোর আভাস সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে আগে থেকেই পাওয়া গেছে, কিন্তু কেউ তা গুরুত্ব দিয়ে তলিয়ে দেখে নি। ব্যস্ত জীবনে হয়তো ‘এসব উল্টাপালটা কথা একদম ভাববে না’ বলার চেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা আমাদের থাকে না, কিন্তু আত্মহত্যার ইচ্ছার প্রকাশ দেখে সমালোচনা না করলেও পারি আমরা। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটি মেয়ে যখন বলেছিলো, ‘আমি আগামী কাল আত্মহত্যা করবো’  তখন অনেকে তাকে বলেছিলেন, ‘এটা মহাপাপ’ আর বাকিরা তাকে নিয়ে কৌতুক করছিলো, ‘তাই নাকি? মরে গেছো নাকি আরো পরে মরবা?’ ‘কীভাবে আত্মহত্যা করো একটু জানাইও পরে’। তারপর যখন মেয়েটি সত্যিই কাজটা করলো তখন একদিকে শুরু হলো ভার্চুয়াল কান্নাকাটি আর হাহাকার, অন্যদিকে মেয়েটিকে নিয়ে, তার জীবন যাপন নিয়ে সমালোচনার ঝড়।

অন্যান্য সমালোচকদের মতো আমিও সমস্যা নিয়ে বেশি কথা বলতে চাই না। কাজেই আসুন, সমাধানের কথা ভাবি। অন্যান্য দেশের কথা জানি না, তবে বিলেতে আত্মহত্যা-প্রবণ মানুষদের জন্য নানান রকম সহযোগিতার ব্যবস্থা রয়েছে। ২৪ ঘন্টার হেল্পলাইন আত্মহত্যা নিরোধে একটা খুব কার্যকর ব্যবস্থা। সরকারী ব্যবস্থাপনা ছাড়াও নানান চ্যারিটি সংগঠন এই সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আছে কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা। কারো এধরণের প্রবণতা আছে জানা মাত্রই তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ না কেউ আশেপাশে থাকবেই। তারপরও যে আত্মহত্যা ঘটে না তা নয়, তবু কিছু জীবনও যদি বাঁচানো যায় মন্দ কী?

আমাদের দেশে এরকম কোনো হেল্পলাইনের ব্যবস্থা আছে বলে আমার জানা নেই, তাই এদেশের স্কুলে চাকুরীরত অবস্থায় পাওয়া প্রশিক্ষণ থেকে শেখা কিছু বিষয় আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চাই।

আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষ আসলে মরতে চায় না: গবেষকদের মতে যারা আত্মহত্যার কথা ভাবে বা শেষ পর্যন্ত করেও ফেলে তারা আসলে মরতে চায় না। তারা শুধু তাদের কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চায় এবং মুক্তির আর কোনো পথ নেই ভেবে নিরুপায় হয়েই মৃত্যুকে বেছে নেয়। তারা সাধারণত নিজে থেকে যেচে কারো কাছে সাহায্য চায় না, তার মানে এই নয় যে তাদের সাহায্য প্রয়োজন নেই বা তাদেরকে সাহায্য করা যাবে না। এধরণের মানুষকে সাহায্য করার প্রথম পদক্ষেপ হলো এই প্রবণতার লক্ষণগুলো চিনতে পারা এবং সেগুলোকে গুরুত্বের সাথে নেয়া।

আত্মহত্যার প্রবণতার প্রতি সমালোচনা মুখর হবেন না: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করেন। সংখ্যাটি খুব একটা ছোট নয়।  বেশিরভাগ মানুষ, যারা নিজে কখনো বিষন্নতা রোগে বা আত্মহত্যা-প্রবণতায় ভোগেন নি, এই বিষয়টা বুঝতে পারেন না। তারা ভাবেন এরা কাপুরুষ, বোকা, স্বার্থপর তাই জীবন থেকে পালিয়ে গেছে, কিন্তু বস্তুত তা নয়। আসলে তাদের কষ্টের অনুভূতি এমন একটা পর্যায়ে চলে যায় যে তারা আর ফিরতে পারে না। যদিও নিজের কষ্টের ইতি ঘটাতে তারা এই কাজটা করেন, তাদের বেশির ভাগই এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকেন- ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ এর মধ্যে দুলতে থাকেন। এই সময়ে তারা মরীয়া হয়ে কাজটা না করার একটা কারণ খোঁজেন। যখন কিছুই পাওয়া যায় না তখন তারা এই কাজটা করেন। এই দ্বন্দ্বের সময়টায় যদি তারা সামান্য খড়-কুটা কিছু পেয়ে যান তা তাদেরকে বাঁচাতে পারে।

আত্মহত্যার হুমকীকে এড়িয়ে যাবেন না: যখন কেউ বলে সে নিজের প্রাণ নেবার কথা ভাবছে, সম্ভাবনা যতই ক্ষুদ্র হোক, তাকে গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। ছোটখাটো মন্তব্যের, যেমন ‘আমি যেদিন থাকবো না সেদিন বুঝবে’, ‘আমি আর পারছি না’, মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে আত্মহত্যার প্রবণতার সূক্ষ্ম ইংগিত।  আমাদেরকে বলা হয়েছিল এক্ষেত্রে নিজে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে এই বিষয়ে যারা পেশাদার তাদের পরামর্শ নিতে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই উপদেশ হয়তো খুব একটা কাজের নয়, তবে যদি এমন কাউকে চেনেন যিনি এসব বিষয়ে কাজ করেছেন অথবা যার প্রজ্ঞার প্রতি আপনার আস্থা আছে তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দেবেন না।  

কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা: আত্মহত্যা সংক্রান্ত কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যা এই বিষয়ে সাহায্য দেয়া বা নেয়ার পথে বাধা হিসেবে কাজ করে-

‘মানুষ এসব শুধু শুধু বলে, আসলে আত্মহত্যা করা মুখের কথা নয়’

‘যারা আত্মহত্যার কথা ভাবে তারা আসলে পাগল’।

‘কেউ নিজেকে মারতে চাইলে আমাদের কী করার আছে?’

‘এসব নিয়ে বেশি আলোচনা করলে অন্যরাও আত্মহত্যা করার ধারণা পাবে’।

যারা আত্মহত্যার কথা বলে তারা সবাই বাস্তবে তা করে না সত্যি, কিন্তু যারা আত্মহত্যা করে তাদের প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে এই বিষয়ে ইংগিত দিয়ে থাকেন যা কান পেতে শোনা হলে হয়তো তাদেরকে বাঁচানো যেতো। যারা আত্মহত্যা করেন, তারা দুঃখ কষ্ট শোকে ভারাক্রান্ত মানুষ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই  তাদের কোনো মানসিক রোগ বা ‘সাইকোসিস’ থাকে না। চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, বা শুধুমাত্র শেয়ারিং এর মাধ্যমে এই অবস্থা থেকে মানুষের ফিরে আসার এবং স্বাভাবিক জীবন বাঁচতে পারার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে।

কাজেই সমালোচনা মুখর না হয়ে এই বিষয়টি নিয়ে আরো ভাবুন, কাছের মানুষগুলোর প্রতি আরো মনোযোগী হোন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ফেসবুক ইনবক্সে অনেকের সাথে এসব নিয়ে আলাপ করেছি, আমার পরিচিত আরো দু’একজন এসব নিয়ে ব্যক্তিগত পরিসরে কাজ করেন বলে জানি। এই সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই, তারপরও অনেক সময় শুধুমাত্র কথা বলার মাধ্যমেও কারো সিদ্ধান্ত পালটানো যেতে পারে। অবশ্য এই বিষয়ে পেশাগত দক্ষতা যাদের আছে তাদের কাছে সাহায্য চাওয়াই সবচেয়ে কার্যকর। তবে তেমন কাউকে না পাওয়া গেলে বন্ধুরাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আমরা প্রত্যেকে নিজের ক্ষমতার ভেতরে থেকে একটু একটু করে অন্যকে সাহায্য করতে পারলে হাত ধরাধরি করে অনেক জটিল অবস্থা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো বলে আমি বিশ্বাস করি। 

2920 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।