মানব জীবনে যদি কোনো শীর্ষ দার্শনিক সমস্যা থাকে, আলব্যের ক্যামু মনে করতেন, সেটি হচ্ছে মানুষের আত্মহননের সমস্যা।
আত্মহননের সমস্যাটিকে দার্শনিক ভাবে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব না হলেও প্রায় দুঃসাধ্য। প্রথমতঃ আমরা যে ভাষায় দর্শনচিন্তা করি, “আত্মহনন" প্রপঞ্চটিকে সেই প্রাত্যহিক জনবোধ্য ভাষায় ধারণ ও তা প্রকাশ করা বেশ কঠিন। দ্বিতীয়তঃ আত্মহনন নিয়ে জ্ঞানতাত্ত্বিক (এপিস্টেমোলজিকাল) প্রশ্নটি প্রায় একটি অনতিক্রান্ত বাধার মতো। আত্মহনন জীবনের অন্তর্বর্তীকালের কোনো ঘটনা নয়, মানুষ এটিকে অভিজ্ঞতায় আনার ক্ষমতা রাখে না, কারণ সে ইতিমধ্যেই বিগত হয়েছে। আমরা কোনো ভাবেই আত্মহননকারীর বয়ান শুনতে বা জানতে পারবো না। আমরা ব্যার্থ আত্মহননকারীর বয়ান থেকে কিছু ধারনা নিয়ে কেবল অনুমান করতে পারি মাত্র। অনুমান আর প্রমাণযোগ্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পার্থক্য মনে হয় আমাদের সবার জানা।
আত্মহননের ক্ষেত্রে প্রমাণযোগ্য জ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞানের পদ্ধতিতে অর্জন অসম্ভব। সক্রিয় সচেতন মানুষের আত্মবিনাশের আচরণের ব্যাখ্যার জন্য আমরা মনোবিজ্ঞানীর কাছে যেতে পারি। মানুষের অনুভবের ভাষাকে উপলব্দির জন্য আমরা ভাষাশিল্পী কবিদের কাছেও যেতে পারি। বাংলা কবিতায় আত্মহননের আখ্যান বর্ণনায়, সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী কবিতা সম্ভবত জীবনানন্দ দাশের “আট বছর আগের এক দিন”। এই দীর্ঘ কবিতার ভাষা, আত্মহনন সম্পর্কে আমাদের চিন্তার কাঠামো তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে, যদি আমরা, আত্মহননের স্বরূপকে ভাষাযর সূত্রে বুঝতে চাইঃ
// ‘কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর-’
এই কথা বলেছিল তারে
চাঁদ ডুবে চলে গেলে অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।//
“জানিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম অবিরাম ভার” এর কথা জীবনানন্দ দাশ আমাদের জানান। এই অসহনীয় গাঢ় বেদনার ভার তাঁকে অবিরাম অব্যাহত বয়ে চলতে হচ্ছে, এই বয়ে চলা অন্তহীন। এই “গাঢ় বেদনার ভার” থেকে মুক্তি প্রত্যাশা জীবনের প্রয়োজনে, কিন্তু জীবনের বিপক্ষে। এই বেদনার ভার থেকে “মুক্তি" পাওয়ার কথা “উটের গ্রীবার মত কোনো নিস্তদ্ধতা এসে” বলে যায়, যা আত্মহননের প্ররোচনা।
এই “নিস্তদ্ধতা" একাকী, গোপন এবং অচেনা অদ্ভুত আঁধারে আসা যাওয়া করে। এই “নিস্তব্ধতা" এক অপার শূন্যতা। এই নিস্তব্ধ শূন্যতার বার্তা গাঢ় বেদনা থেকে মুক্তির, কিন্তু বেদনা থেকে মুক্তি কি সম্ভব? জ্যানেট ভালস, মার্কিন নারী লেখক, মনে করেন, এই গাঢ় বেদনা থেকে ব্যক্তি নিজে হয়তো “মুক্তি” পায়, কিন্তু একই সাথে সে এই গাঢ় বেদনাকে রেখে যায়, তাঁর নিকটজনের হৃদয়ে। ফলে এই গাঢ় বেদনা, বেঁচে থাকে পরম্পরায়।
এই গাঢ় বেদনার, এই বেদনা থেকে মুক্তির প্ররোচনা, বাস্তবতার একদিক। মনোজাগতিক বাস্তবতার আরেক দিক সম্পর্কেও কবি আমাদের জানানঃ
//অশ্বত্থের শাখা
করে নি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে
সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করে নি কি মাখামাখি?
বলে নি কি: বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইদুর এবার!
জানায় নি পেচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?//
জীবনবিমুখ মুক্তি, যা আসলে জীবনের পরাজয়, এর “প্রতিবাদ” জানায় জীবনবাদী প্রকৃতি। নানা উপাচারে প্রকৃতি জীবনের পক্ষে তুমুল গাঢ় সমাচার জানায়, আত্মহননের বিপক্ষে। এই প্রকৃতি অদ্ভুত আঁধারের কিংবা নৈশব্দের নয়, এই প্রকৃতি জীবনদায়ী ধরিত্রী মাতা, নান্দনিক, সোনালি ফুলে, জোনাকির আলোয় এবং বেনো জলেও জীবনের বেঁচে থাকাকে “চমৎকার" ভাবেন।
তারপর কবি প্ররোচনা ও প্রতিবাদের, বাদ-প্রতিবাদের, বাইরে এসে, কেবল ভাষায় ধারণ বা ব্যাখ্যার অযোগ্য এক ভুবনে আমাদের নিয়ে আসেনঃ
// জানি-তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, র্কীতি নয়, সচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত ক্লান্ত করে:
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।//
“এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে” এবং “আমাদের ক্লান্ত করে”। এই “বিপন্ন বিস্ময়কে” আমরা আলব্যের ক্যামুর চিন্তায় দেখি শীর্ষ দার্শনিক সমস্যা হিসেবে। কেবল অসহনীয় “গাঢ় বেদনা" নয়, এই বেদনা থেকে মুক্তির প্ররোচনা ও প্রতিবাদ, এই দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসার চেনা কোনো পথ নেই, ফলে এই বিপন্ন বিস্ময় তাঁকে ক্লান্ত করে।
“বিপন্ন বিস্ময়” থেকে পথ খুঁজে না পাওয়া, ক্রমাগত ক্লান্ত হতে থাকা, এক নয়া অভিজ্ঞতা। গাঢ় বেদনার সাথে যুক্ত হচ্ছে বিপন্ন বিস্ময়ের উত্তরহীন ক্লান্তি। অতঃপর, এই গাঢ় বেদনা আর উত্তরহীন ক্লান্তি থেকে “মুক্তি" পেতে, জীবনবাস্তবতাকেই আমূল বদলে দেয়ার ইচ্ছা মুক্তি পায়, জীবনের অবসানে।