সৃজা ঘোষ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপণে স্নাতোকোত্তর, বর্তমানে আকাশবাণীতে কর্মরত।

৮ই মার্চ কেবল একটি সেলের দিন নয়

(অনুগ্রহ করে সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ার আগে বুঝে নিন এ লেখা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে, যার মধ্যে যেকোনো লিঙ্গের মানুষ পড়তে পারেন। তাই ছাগলের মতো অশিক্ষিত আর পাগলের মতো রিজিড লোকজন এসব পড়বেন না। তাদের বোঝানো আর হাতিকে জাঙিয়া পড়ানো সেম কেস। ও দায়িত্ব আমার না)

আর দিদিভাই, দাদাভাই, ৮ই মার্চের হিস্ট্রিটা! ধুর ব্যাং, কি হবে এসব জেনে? আসল জিনিষ তো আপনি জানেনই- আজ সর্বত্র ভালেঅ সেল চলছে। সোনার গয়নার মজুরিতে ১০% ছাড় দিচ্চে কিন্তু, ঐ মাল্টিপ্লেক্স সংস্থা আজ সিনেমা দেখলেই মেয়েদের জন্যে পপকর্ণ ফ্রি বলেছে, ম্যাক্স, প্যান্টালুনস, ট্রেন্ডস এ আজ কুর্তির দাম কম। কি? আপনার তিনি আজ কেক কাটিয়েছেন! ব্যাস, ৮ই মার্চ সেলিব্রেশন ডান। বুঝতে পারলেন? সমস্যাটা কোথায়?

সেদিন ষ্টেশনে বসে আছি। একজন মহিলা কাকে যেন বলছেন ‘মেয়ে তো খুব ভালো। ঘরোয়া, মুখে রা নেই, একদম ঠান্ডা। আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিলো- কত ডিগ্রি সেলসিয়াম হবে কাকিমা? করি নি। আমি বাড়িতে হাফ প্যান্ট পরি, একদিন খুব লজেন্স খেতে ইচ্ছে করেছিলো বলে পাশের দোকানে দুটো এক্লেয়ার্স কিনতে গেছিলাম। পাড়ার কোনো শ্রদ্ধেয় জেম্মা পরে বলেছিলো ‘এই ঘোষবাড়ির বড় মেয়েটা না আজ একটা হাফপ্যান্ট পড়ে দোকানে এসেছিলো’। এত সহজ স্টেটমেন্টও লোকে করতে পারে, ভেবে মনে মনে পেন্নাম জানিয়েছিলাম জেম্মাকে। আহা! কি দোষ! বাচ্চারা যেমন ফুল দেখে বলে ‘ওটা ফুল’ অমন উনিও আমায় হাফপ্যান্ট পরে দেখে বলেছেন ‘ঘোষবাড়ির বড় মেয়ে হাফপ্যান্ট পড়েছে’ সারাদিন কুসুমদোলা দেখেও যে উনি যা দেখেছেন, সেটা হুবহু বলতে পেরেছেন, সে জন্যে আমার লজেন্স টা ওনাকে দেওয়ার আফসোস আমার এজম্মে যাবে না।

সেদিন গুলোর মতন আজও একটা দিন। আজ নারী দিবস। আজও সূর্য পূর্ব দিকেই উঠবে, আজও আপনিই প্রত্যেকদিনের মতো আপনার পতিদেবের আন্ডার ওয়্যার কাচবেন, আজও আপনি অফিস থেকে ফিরে গুষ্টির মুখে চা না ধরতে পারার জন্যে গিল্ট ফিলিং নিয়ে বলবেন ‘আমার শাশুড়ি তো খুব লিবারেল, সন্ধ্যের চা টা আমাকে করতেই দেন না।’, আজও আপনিই কন্ট্রাসেপ্টিভ পিলটি খাবেন কেননা আপনার প্রেমিক কন্ডোম ইউজ করিবেন না, আজও আপনি অফ শোল্ডারটা পরে বেরোতে পারবেন না কারণ আপনার শ্বশুর এসব একদম পছন্দ করেন না, আজও আপনি আপনার ফেসবুক হানিমুনের এলবামটা আপনার ফুল পিসিমা, সোনা দাদু, পিন্টু কাকার থেকে হাইড মোডেই রাখবেন, আজও আপনি পেইনফুল ওয়াক্স করাতে যাবেন কারণ ১৫দিন পেরোলেই হাত পায়ে খোঁচা খোঁচা লোম আভাস দিয়ে বলে ‘আমি স্বাভাবিক ঠিকাছে কিন্তু তুমি আল্ট্রা মডার্ন অতএব আমি কিন্তু তোমার প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন মেরে দেবো’, আজই তুমি পুশ আপ ব্রা কিনবে দুটো কারণ পোস্ট প্রেগনেন্সি পিরিয়ডটায় স্বাভাবিক জিনিষ খুব হিউমিলিয়েটিং দেখতে লাগে, আজই তুমি ঐ বিদেশী ওয়েবসাইট থেকে মাত্র ৩৫০০ টাকা মূল্যের ফেয়ারনেস ক্রিমটা অর্ডার দেবে।

আরে বাবা নারী স্বাধীনতা নেই নেই বলে অনেক চিল্লাচ্ছেন, আগে নিজের দিকে তাকান। হিপোক্রেসি বন্ধ করুন। কিভাবে? বরকে বোঝান ওর আন্ডার ওয়্যারটা আপনি এতকাল দয়া করে কেচেছেন, তাই এবার থেকে বাথরুম থেকে বেরোনোর সময় সেটা কেচে নিয়ে বেরোতে কিম্বা ওয়াশিং মেশিনে সেটা ঢুকিয়ে দেবার দায়িত্বও তারই। আপনার শরীরটা আপনার প্রিয়তমর বাপের সম্পত্তি নয়। ওনাকে বুঝতে দিন আপনি রক্ত মাংসের মানুষ, সিন্থেটিক নন। আপনার ভালোবাসার জন জানুক ঐ গরম ওয়াক্সটা আপনার শরীরে লাগানোর সময় আপনার ফাটে, টেনে তোলার সময় চোখ থেকে জল বেরিয়ে যায়। উনি বুঝুক, দিনের পর দিন মেল ইগো আর কন্ট্রাসেপটিভটার জন্যে আপনার শরীরটার ভেতরে ভেতর সর্বনাশ বাসা বাঁধছে। রাগে ফেটে পড়ুন একবার, চিৎকার করে একটাবার বলুন- ওনার ঢপের ফিলিংসের ওপর একটা ঢাকনা লাগালে সেটা হয়তো বাঁচতে পারে। আপনার শরীর ও তার কিছু বিশেষ অঙ্গকে ঠেলে বেঁধে রাখা বন্ধ করুন, বিলিভ মি- বুক পেটের মাপের কোনো 36-24-36 স্কেল হয় না। যে রাঁধে সে চুল বাঁধে না বশ, চুলের মুটি ধরে পুরুষতন্ত্র তাদের চুল বাঁধায়।

আপনার শরীরটা বিজ্ঞাপনের ডিসপ্লে নয়। একটু মেচেদা, দু’একটা ব্রণ, চোখের নীচে সামান্য ডার্ক সার্কেলকে ভালোবাসার পুরুষ এ দুনিয়ায় কম নেই। মেক আপ ছাড়া কনফিডেন্স ল্যাক করলে ওই কনফিডেন্সকে সার্ফ এক্সেলে চুবিয়ে শুকোতে দিন, দয়া করে, কিছু বোকা বোকা কৃত্রিমতাকে আমার মূর্খ্য সমাজের অভ্যেস বানিয়ে তুলবেন না। রকের ছেলেটাকে ছোটবেলা থেকেই বুঝতে দিন আমাদের স্তন তোমার পুরুষাঙ্গটির মতোই অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং এই দুটির মধ্যে দিয়ে ক্ষমতার আস্ফালন দেখানো যায় না, সে জানুক নারী শরীরকে ‘দীপিকা পাডুকোন’ বলে না, তাহলে সেও হয়তো সলমন খানের চেহারাটাকে হিরো ভাবা বন্ধ করবে, সে শিখুক মেয়েদের অফ শোল্ডার থেকে জাপানী তেল গড়িয়ে পড়ে না। সে বুঝুক কোনো মেয়ের সালোয়ারে লাল রঙ দেখলে হিউমিলিয়েট করতে নেই, হাত বাড়িয়ে দিতে হয়। দেখবেন এটুকুতেই অনেক অসুস্থতা বন্ধ হবে।

‘সুস্থতা’ শব্দটায় ভরসা রাখুন। আপনার প্রতিটা পরিচর্যা আপনার বিলাসিতাই হোক শুধু, টাকা দিয়ে কেনা যন্ত্রণা নয়। ভাল থাকুন, শুধু ৮ই মার্চ নয়, এভরি ডে, এভরি মিনিট, এভরি সেকেন্ড...

1479 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।