আঞ্জুমান রোজী

লেখক

অশ্রাব্য ভাষায় জব্দ নারীর জীবন

 
 
নারী অবদমনের প্রধান অস্ত্র হলো তিরস্কৃত ভাষা। এই ভাষা প্রয়োগ করে নারীর মনোবল দুর্বল করে দেয়াই হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাজ। বাংলা ভাষায় অধিকাংশ হয়রানিমূলক কথা, গালি, তিরস্কারমূলক শব্দ মূলত নারীকে অবমাননা অথবা হয়রানি করার জন্য ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া, ভাষা যেকোন সমাজের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটায়। যেহেতু ভাষা সমাজের মানুষের চিন্তা-চেতনা এবং ভাবনাকে ধারণ করে, সেহেতু সমাজে নারীর প্রতি ব্যবহার হওয়া ভাষার মাধ্যমে বোঝা যায় নারীর অবস্থান কেমন। সেই সাথে  বোঝা যায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রূঢ় মানসিকতা। আবার ভাষা সমাজে বৈষম্য টিকিয়ে রাখার অন্যতম বড় হাতিয়ার। শব্দ নির্বাচন ও ভাষার ব্যবহারের সঙ্গে মিশে থাকে ক্ষমতার রাজনীতি। তাই অশ্রাব্য ভাষাকে নিছক শব্দসম্ভার বলে উড়িয়ে দেওয়ার কিছু নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হরহামেশা ব্যবহৃত গালিগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সেগুলো সুস্পষ্টভাবে পুরুষতন্ত্র টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডের একটি গবেষণায় দেখা যায়, শহরাঞ্চলে ৮৮ শতাংশ নারী পথচারী কর্তৃক আপত্তিকর মন্তব্যের শিকার হন। গ্রামাঞ্চলে নারীকে কেন্দ্র করে গালি দেওয়া হয় আরও বেশি।
 
নারীর প্রতি ঘৃণার ভাষায়  কথা বলাটাকে পুরুষগুলো বড় কৃতিত্বের বা পৌরুষত্বের কাজ মনে করে। কারণে অকারণে এমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাষায় কথা বলে যে মনে হয় কানে গরম সীসা ঢেলে দিচ্ছে। পুরুষের গালিগালাজ যেন একমাত্র নারীর প্রাপ্য। এমন অশ্রাব্য ভাষা শুধু নিম্নশ্রেণির মানুষের ভাষাই নয়, এই ভাষা উচ্চশ্রেণির শিক্ষিত সুধী সমাজও ব্যবহার করে। যার শিকার কমবেশি প্রত্যেকটি নারীই হয়ে থাকে; সেখানে শিক্ষিত অশিক্ষিত নারী বলে কোনো কথা নেই। সেই সঙ্গে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি নারীকে যে নানা ধরণের মানসিক নিগ্রহের শিকার হতে হয়, তার একটি বড় অংশ হয় নেতিবাচক নানা শব্দের মাধ্যমে। এমনকি যেকোন ঝগড়া বিবাদে নারী বিভিন্ন ধরনের মৌখিক সহিংসতারও শিকার হয়।
 
বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া মুনিয়া হত্যা কিম্বা আত্মহত্যা একটি উৎকৃষ্টতম উদাহরণ। মুনিয়া মরেও অশ্রাব্য গালিগালাজ থেকে মুক্তি পায়নি। এমনই গালিগালাজের বর্ষণ হচ্ছে যে, তার মৃত্যুটা অবধারিত ছিলো বলে বোঝানো হচ্ছে। মানুষ মেরে ফেলা যেখানে মহাপাপ, সেখানে মুনিয়ার হত্যা বা আত্মহত্যাকে জায়েজ করে দিচ্ছে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। পুরুষের এতই ক্ষমতা যে জীবিত অবস্থায় একটি নারীকে যেভাবে গালিগালাজ করে নাস্তানাবুদ করে রাখে সেখানে নারীটি মারা যাওয়ার পরেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একই মানসিকতা রাখে। এই মানসিকতা দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কি বোঝাতে চায়? নারীর প্রতি এসব আচরণ পশুবৃত্তিকেও হার মানায়। সেইসাথে পুরুষের পাপ ঢেকে দেয়ার কূটকৌশল চলে নারীকে অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করে। মুনিয়াও সেই চক্রান্তের শিকার। 
 
নারী অশ্রাব্য ভাষার শিকার ঘরে-বাইরে,অফিস-আদালতে সর্বত্র হচ্ছে, হচ্ছে অসংবেদনশীল শব্দের আঘাতে আক্রান্ত। এই অশ্রাব্য ভাষা শুধু  স্ত্রীলিঙ্গে ব্যবহৃত হয়। এতে নারীর যৌনতা, কর্মদক্ষতা কিম্বা যোগ্যতা উচ্চকিত হয়ে প্রশ্ন বিদ্ধ করে। কিন্তু এর বিপরীতে পুরুষের প্রতি তিরস্কারের কোনো শব্দ ব্যবহার হয় না। এতে পরিস্কার বোঝা যায় যে পুরুষই এমন ঘৃণিত শব্দের জন্মদাতা।  এ শব্দ ব্যবহারে পুরুষের সুবিধাই হয়। তাছাড়া এ শব্দগুলো শুধু পুরুষই ব্যবহার করে না, অনেক নারীও বুঝে কিম্বা না-বুঝে অন্য নারীর প্রতিও অসম্মানজনক  ভাষা  প্রয়োগ করে। এতে নিজেকেও যে সে অপমানিত করছে একথাটা তো বোঝেই না, সেইসাথে আক্রান্ত নারীটি যে কি পরিমাণ আহত হচ্ছে সেদিকেও কোনো ভ্রুক্ষেপই করে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে নারী এমনই এক উচ্ছিষ্ট কিছু,  যার রূপ চূড়ান্তভাবে দেখলাম মুনিয়ার আত্মহননের মধ্য দিয়ে।  
 
‘ডাইনি’, ‘বেশ্যা’, ‘ছিনাল’, ‘খানকি’, ‘কুটনি’র মতো শব্দগুলো সব সময় নারীকে হেয় করে  বর্ণনা করে। এমনকি সেই নারী অন্যায় না করলেও তাকে কু-ভাষার মাধ্যমে জর্জরিত করা হয়। নারীকে অশ্রাব্য ভাষায় এমনভাবে আক্রান্ত করে যে, অনেকসময় তার জন্মপরিচয়কেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। 
 
‘মুখরা’, ‘ঝগড়াটে’, ‘মাল’, ‘বন্ধ্যা’, ‘পোড়ামুখী’র মতো শব্দগুলোও স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলা ভাষায় অধিকাংশ হয়রানিমূলক ভাষাই অবমাননাকর; যেখানে অনেক তিরস্কারমূলক শব্দে পুরুষবাচক কিছুই নেই। এসব শব্দ প্রয়োগে আছে ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের অপব্যবহার। নারীকে দুর্বল করে রাখার মনো বৃত্তিতেই এমন অপপ্রয়াস চলে।
 
নারী সহিংসতার শিকার অকথ্য ভাষার মাধ্যমেই হয় বেশি। এরজন্য উঁচুশ্রেণি, নিম্নশ্রেণির মানুষ বলে কথা নেই। সবশ্রেণির পুরুষ একই অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে। অসম্মানজনক ভাষার ব্যবহার নারীর আত্মবিশ্বাসকে খর্ব করতে প্রভাবিত করে। নারী এই সমাজের অপাংক্তেয়। তাই যত দোষ নন্দ ঘোষ, ঐ নারী। অল্পবয়সী, ছোট্ট মেয়ে মুনিয়ার শোচনীয় পরিণতি তাই প্রমাণ করছে। নির্লজ্জ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তা করতে পেরে গর্বে গর্বিত হচ্ছে। একটি দেশ যখন অধঃপতনের দিকে যায়, তখন ধরে নিতে হবে সেই দেশে নারী নিরাপদ নয়। 
 
এই অশ্রাব্য ভাষা থেকে নারীর জীবন ব্যবচ্ছেদ করার উপায় নেই। যেন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমনই জীবনযাত্রা, যেখানে শুধু অন্ধকার। যে ভাষাকে মায়ের ভাষায় মর্যাদা দেয়া হয়, ঠিক সেই ভাষা দিয়ে নারীকে আক্রান্ত করে দেশের বৈকল্যতাকেই প্রমান করছে। তিরস্কারমূলক শব্দ নারীকে জব্দ করার অস্ত্রই শুধু। তাই জোর গলায় বলতে চাই,  শব্দে আর জব্দ না হোক নারীর জীবন।
 
 

2051 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।