আসমা খুশবু

ইংরেজি সাহিত্যে এম এ, করা আসমা খুশবু ফ্রিল্যান্স লেখালেখি করতে ভালবাসেন।

নিরাপদ গর্ভ ও মাতৃত্বের সাথে রাষ্ট্রের উন্নয়নও জড়িত

মুক্তির কথা হচ্ছে... রাষ্ট্র দায়িত্ব নেবে আমাদের কোন কোন কাজের...রাষ্ট্র তো ভবিষ্যৎ নাগরিকের দায়িত্বই নেয় না আমাদের দেশে! মা হওয়ার আগে থেকে অথবা পরে বেশীরভাগ মেয়েদেরই কাজ করা বন্ধ হয়ে যায় শুধু তার সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে! নারী মা হবে, দায়িত্ব তার নিজের। শরীরের ভেতরে যাকে তিলতিল করে বড় করছে, তার সাথে নিজের এবং পরিবারের সবার।

একজন নারী মা হবেন, সংবাদটি আনন্দের নিঃসন্দেহে। কিন্তু সাথে সাথে অনেক দায়িত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অন্তঃসত্ত্বা নারীটি যদি চাকরি করে তাহলে তো তার কষ্টের শেষ থাকে না। এই অবস্থায় তার কোন কাজটি করা উচিত নয়, কোন কাজটি করতে কতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তার প্রয়োজনীয় ট্রেনিং কর্মক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা নারীটি এবং তার সহকর্মীদের দেওয়া হয় কিনা আমার জানা নেই। একজন নারী গর্ভকালীন সময়ে কর্মক্ষেত্রে তার সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পেলে সেটা তার জন্য শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই সেটা কর্মক্ষেত্রে কার্যকর করার নিয়মই থাকা উচিত। কিন্তু দেশে এ জাতীয় কোনো নিয়ম কোনো প্রতিষ্ঠানে আছে কিনা আমার জানা নেই। উল্টো কোনো নারী প্রেগনেন্ট হলে তাকে কম প্রোডাক্টিভ বলে হেয় করা হয়।

আমার মনে আছে আমার প্রেগনেন্সির শুরুতে আমার বস দুইঘন্টার একটি মিটিং করেছিলো আমাকে এবং আমার সহকর্মীদের নিয়ে। মিটিং শেষে আমাকে সিঁড়ি দিয়ে কিভাবে ওঠা নামা করবো তা ধরে ধরে শিখিয়ে দিয়েছিলো। সব সহকর্মীকে অনুরোধ করেছিলো আমাকে সহযোগিতা করার জন্য, বলেছিলো এটা তাদের চাকরির অংশ, কেউ যেন দয়া মনে না করে। আমাকে বলা হয়েছিলো আমি যেন দরকার মনে করলেই পাঁচ, দশ মিনিটের একটা ব্রেক নেই। আরও অনেক সাবধানতাসহ কিছু কাগজ সই করতে হয়েছিলো। যেদিন ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট থাকবে সেদিন ছুটি দিতে তারা বাধ্য। এমনকি কোনো কারণে অসুস্থ লাগলে ছুটি দিতে বাধ্য। এটা খুব সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এখানকার কর্ম পরিবেশের। দেশে আমার এক বন্ধু একটি নামকরা পত্রিকায় কাজ করতো। প্রেগনেন্সির সময় তার বসসহ সহকর্মীদের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে সে বাচ্চা জন্মের তিনমাস আগে কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো। দেশে একজন নারী কী কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে তার কর্মক্ষেত্রে পৌঁছায় তা শুধুমাত্র সেই নারীটি জানে। এরপর সহকর্মীদের কাছে সহযোগিতার খুব বেশি আশা না করলেও শারীরিক অবস্থার জন্য মাঝে মাঝে সহযোগিতা চাইতে বাধ্য হন। সমস্যাটা ঠিক তখনই বাঁধে। সহকর্মীরা মনে করে তারা ওই নারীটির থেকে বেশি কষ্ট করে তার সমান বা কম বেতন পাচ্ছেন। আবার বস ভাবছেন ওই নারীটির প্রোডাক্টিভিটি আগের চেয়ে কম গেছে, তার জায়গায় অন্য কাউকে নিলে হয়তো বেশি প্রোডাকশন পাওয়া যাবে। এই চিন্তা থেকেই তারা তাকে অসহযোগিতা করেন। তখন ওই নারীটি এমন কর্মপরিবেশে আর টিকে থাকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত হয়তো চাকরিটা ছেড়েই দেন। এ তো গেল কর্ম পরিবেশ।

এরপর আছে ঘরের পরিবেশ। সকালে উঠে নিজেরসহ পরিবারের সকলের খাবারের দায়িত্ব তাকেই নিতে হয়। কোনো সহকর্মী থাকলে তার সহযোগিতায় সকাল, দুপুরের সমস্ত আয়োজন করে তবেই সে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারে। আর সহকর্মী না থাকলে একহাতে সব সামলে তারপরেই গন্তব্য। পারিবারিক এমন অসহযোগিতা একজন নারীর গর্ভকালীন সময়ে মারাত্নক ক্ষতি করতে পারে। ইংল্যান্ডে একজন নারীর গর্ভকালীন সময়ে যখন তার নিয়মিত চেকআপ হয় তখন শুরুতেই তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তার পরিবারের লোকজন তাকে ঠিকঠাক সহযোগিতা করে কিনা, পার্টনারের দ্বারা কোনো রকম সেক্সুয়াল ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছে কিনা, কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতা পাচ্ছে কিনা। একটি ক্ষেত্রেও যদি অভিযোগ করা হয় তবে হাসপাতালের মেটার্নিটি বিভাগ নিজেদের দায়িত্বে সেখানে যোগাযোগ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়।

এরপর আছে মাতৃত্বকালীন সময়। বাচ্চার জন্মের আগে, পরে মিলিয়ে নয় মাসের ছুটি নিতে পারবে, তারপর আছে ১৮ সপ্তাহের আনপেইড প্যারেন্টাল লিভ। চাইলেই নেওয়া যায়। বাচ্চা জন্মের সকল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বাচ্চার সকল চিকিৎসা ১৬ বছর পর্যন্ত রাষ্ট্র বহন করে। ঔষধ থেকে শুরু করে কোনো কোনো বাচ্চার গায়ে মাখা লোশন, গোসলের সাবান, খাবার দুধটা পর্যন্ত রাষ্ট্র বহন করে। এমনকি নতুন মায়ের একবছর পর্যন্ত বিভিন্ন চিকিৎসা সেবা ফ্রি, ঔষধ ফ্রি। এটা তার অধিকার, কোনভাবেই এটাকে দয়া বলা যায় না।

আমাদের দেশে একজন নারী গর্ভবতী হওয়া মানেই হবু বাবা মায়ের মনে খরচের নতুন হিসাবের টেনশন শুরু হয়। গর্ভবতী অবস্থা থেকেই শুরু হয় চিকিৎসা সেবার নামে প্রতিমাসে অতিরিক্ত অর্থ গোনা। বাচ্চা জন্মদানের সময় একটা বিরাট অংকের টাকা দরকার হবে, আজকাল খুব সহজ, সাধারণ হিসাব হয়ে গেছে। ডাক্তাররা সিজার ছাড়া খুব কম বাচ্চাই জন্ম দেওয়ান, তাই বাবা মায়েরা নিজেরাই নির্দিষ্ট দিন ধার্য করে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নিয়ে ওটিতে ঢোকেন। আমার প্রথম বাচ্চাটার জন্য আমরা স্বাভাবিক জন্মের অপেক্ষা করছিলাম। নির্দিষ্ট সময়ের থেকে এগারো দিন বেশি অপেক্ষার পর ডাক্তার বিপদের আশঙ্কায় ইমার্জেন্সি সিজার করেছিলো।

এখনকার সময়ে দেশে এটা হয়তো ভাবাই যায় না। বাচ্চা জন্মের পর নিয়মিত বিরতিতে একজন হেলথ ভিজিটর বাড়িতে এসে বাচ্চা এবং মায়ের শারীরিক সুস্থতাসহ পারিবারিক সমস্যারও সমাধানের পরামর্শ দেন। বাংলাদেশে এসব বিষয় যদিও এখনও ভাবনা থেকে অনেক দূরে। একজন শিশু মায়ের গর্ভে থাকায় অবস্থায় যখন শরীরে গুলিবিদ্ধ হয়, তখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা নিয়ে ভয় হওয়াটা স্বাভাবিক। হতে পারে ওটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু দায়টা তো রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

কিছুদিন আগে এক নারী টাকার অভাবে সরকারি প্রসূতি ভবনের সামনের রাস্তায় বাচ্চা জন্ম দিতে বাধ্য হলো, জন্মের পরপরই বাচ্চাটির মৃত্যু হলো, এ দায়ও রাষ্ট্রের। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু একটি রাষ্ট্রের প্রসূতিকালীন, মাতৃত্বকালীন সহযোগিতাই সে রাষ্ট্রের পরবর্তী প্রজন্মকে নিরাপদে, নিশ্চিন্তে সামনে এগিয়ে যাবার পথ দেখায়। বিভিন্নভাবে দেশ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, এখন বোধহয় সময় এসেছে দেশের প্রতিটি নারীর প্রসূতি এবং মাতৃত্বকালীন সকল দায়িত্ব রাষ্ট্রের নেবার। কর্মস্থলে সহকর্মীদের সহযোগী মনোভাবের জন্য শক্ত আইনও বোধহয় সময়োপযোগী। সর্বোপরি একটি রাষ্ট্র তার কার্য পরিচালনায় নারী বান্ধব না হলে সে রাষ্ট্রের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবেই।

3364 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।