দুইটা কথা বলবো। নাহ্, জ্ঞান দিতে আসি নাই। ওই জ্ঞানটা লোকে আমাকে দিয়ে যায় সবসময় - ফ্রিতেই। আমিও ফ্রি ফ্রি কিছু জ্ঞান দিতে পারি, কিন্তু লোকে আবার সন্দেহ করে। কেননা কোনো কিছু ফ্রিতে পেলে লোকে নেয় বটে, চোখ সরু করে একটু সন্দেহর চোখেও তাকায় না কী?
তাই জ্ঞান নয়। এমনিতেই দুইটা কথা বলবো। একান্তই আমার মনের কথা। ছেচল্লিশতম বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা বিনিময়ের দায় থেকেই বলা কথাগুলো।
বাংলাদেশ এমনিতেই পড়ে পাওয়া কোনো দেশ না। কারো দয়া দাক্ষিণ্যে এই দেশটির জন্ম হয় নাই। এই দেশটির জন্মের পেছনে লাখো কোটি মানুষের রক্ত, অশ্রু, সম্ভ্রম, কষ্ট বেদনা আর বঞ্চনার ইতিহাস আছে। বুক ভেঙে দেবার মতো করুণ সেইসব কাহিনী। আপনি বাবা অথবা মা। হয়তো আপনার সন্তান আছে। হয়তো তাদের বছর পাঁচ থেকে উনিশ বছর।
আমার অনুরোধ, সেইসব কাহিনী শোনান আপনার সন্তানকে। ঘুম পাড়াবার সময়, খাইয়ে দেবার সময়, সন্তানের সাথে সময় কাটানোর সময়, আড্ডার সময় সেই গল্পগুলো বলুন।
হয়তো আপনার সন্তান বই টই তেমন পড়তে চায় না। তাতে কী! মা বাবার মুখে মুখে বলা গল্পগুলো নিশ্চয়ই শোনে! হয়তো আপনার মুখে মুখে শুনতে শুনতে একসময় পড়তে চাইবে - আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস। আমাদের জয়ের ইতিহাস। আরো বেশি বেশি জানতে চাইবে আমাদের গৌরবের কথকতা।
আমাদের পূর্বপুরুষদের, আমাদের মা-বোনদের, আমাদের দেশের লক্ষ কোটি মানুষের সেই দুঃসহ নয় মাসের প্রতিটি মুহুর্তের কথা জানুক তারা। তাদের বলবেন, কত মা স্বেচ্ছায় তার সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন -হয়তো সেই সন্তান আর ফিরেই আসেনি। বলবেন, কত সন্তানের চোখের সামনে গুলি খেয়ে রক্তপাত হতে হতে মারা গেছে বাবা অথবা মা। জানাবেন কত নারীকে অসম্মান করেছে, হত্যা করেছে, কষ্ট দিয়েছে অন্যায়ভাবে।
বলবেন সেইসব সাধারণ মানুষের কথা, কোনো স্বার্থ ছাড়াই রোদ বৃষ্টি শীত উপেক্ষা করে মাঠে প্রান্তরে ঘুরে যুদ্ধ করেছে - যারা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি হাতে রাইফেল উঠবে। অথবা সেইসব শিশুদের কথা যারা তাদের বয়সে খবর নিয়ে ছুটে গেছে রণাঙ্গনে, জীবনের ভয় নিয়ে বড়দের হাত ধরে পাড়ি দিয়েছে সীমান্ত, কখনো তারাও জড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধে এবং হারিয়ে ফেলেছে তাদের আনন্দময় শৈশব।
এইসব গল্পগুলো কেন শোনাবেন? তারা যেন জানে, এইযে তারা আনন্দে আছে, ভালো আছে, বিজয়ের উৎসব করছে এইসব সব কাদের অবদান। তারা যেন বাংলাদেশটাকে ভালোবাসে। নিজের দেশটাকে ভালোবাসে। সেই মানুষগুলোর মানুষের প্রতি স্বার্থহীন নির্ভেজাল ভালোবাসা, দেশপ্রেম আর ত্যাগকে সম্মান দিতে পারে -শুধু এজন্যই। হয়তো আপনার সন্তান এখনো আসেনি পৃথিবীতে। হয়তো আসবে কখনো। তখন বলবেন। আপনার আশেপাশের শিশুদের, প্রিয় স্বজনদের শিশুদেরই না হয় বলবেন!
আমিও মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। পেটে থাকা সন্তান নাকি মায়ের অনেককিছুই বুঝতে পারে! হয়তো মায়ের অস্তিত্বের অংশ হয়েই আমি যুদ্ধের সময়টাকে অনুভব করতে শিখেছি। এরপর যত যত বড় হতে থেকেছি আমার মা আমাকে তার দেখা যুদ্ধ বর্ণনা করে আরো অনুভবে গেঁথে দিয়েছেন একাত্তরকে। এরপর আমি পড়েছি। জেনেছি আরো। এভাবেই ভালোবাসতে শিখেছি আমি একাত্তর আর আমার বাংলাদেশকে।
তাহলে আমরা কেনো পারবো না আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে, চিনাতে এবং শিখাতে? আমাদের যে পারতেই হবে! এটি তো ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইতিহাসকে এভাবেই তো নিয়ে যেতে হবে আমাদের সকলকে!
অবশ্যই আমরা বিজয় দিবসে লালসবুজ পোশাক পরবো, কপালে বাঁধবো লালসবুজ পতাকা, ছেলেমেয়ের হাত ধরে রাস্তায় নেমে স্বাধীনতার আনন্দ উদযাপন করবো। কিন্তু আমাদের সন্তানরা যদি ইতিহাসটুকুই না জানে তাহলে সবকিছু ম্লান হয়ে যায় না কি? অসম্মান কি করা হয় না আমাদের একাত্তর কে? নয় মাসের সংগ্রাম, সেই যুদ্ধকে। অপমান করা হয় না কি অসংখ্য নারীপুরুষের সেই ত্যাগকে?
তাই বলছি, আসুন সন্তানকে, শিশুদেরকে এভাবেই শেখাই একাত্তর। আর মুক্তিযুদ্ধ।
বলি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, স্বাধীন একটা দেশ পাবার জন্য তাদের যুদ্ধের কথা। বলি বাংলাদেশের কথা।