ইমতিয়াজ মাহমুদ

এডভোকেট, মানবাধিকারকর্মী

অরুণাচলম মুরুগানান্থাম : স্যানেটারি প্যাড পরা পুরুষ

(১) 
অরুনাচলম মুরুগানান্থাম নামে দক্ষিণ ভারতীয় এক ভদ্রলোক 'স্যানিটারি প্যাড পরা পুরুষ' নামে পরিচিত। লোকটা বয়সে আমার চেয়ে খানিকটা ছোটোই হবেন, ভারতের বাঙ্গালোর শহরের কাছেই কোনো এক গ্রামের এক জোলা পরিবারের সন্তান, খুব উচ্চশিক্ষিত বলে মনে হয় না, তবে ঐ দক্ষিণ ভারতীয় উচ্চারণে গুটুর গুটুর করে ইংরেজি বলতে পারেন। বছর দুই আগে খুব সম্ভবত মুস্তাফিজ ইউটিউবে আমাকে একটা ভিডিও দেখিয়েছিলো, সেখান থেকে আমি ওর কথা জানতে পারি।

এই লোকের গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং। বিয়ের পর তিনি লক্ষ্য করলেন মাসের ঋতুকালীন কয়েকটা দিন তার স্ত্রী নোংরা কিছু ন্যাকড়া ব্যবহার করছেন, সেই নোংরা ন্যাকড়াগুলিই আবার ধুয়ে আড়ালে কোনাকানায় ছায়ার মধ্যে শুকাচ্ছেন, তারপর সেগুলিই আবার ব্যবহার করছেন। ব্যপারটা যে মোটেই স্বাস্থ্যকর না এটা তো না বুঝার কথা না। আমাদের মুরুগানান্থমের তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন যে তার স্ত্রী বাজার থেকে কেনা স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন না কারণ প্রথমত সেগুলির দাম বেশী, আর তার উপর ঋতুস্রাব ব্যাপারটা কিনা একটা গোপন এবং লজ্জার বিষয়, উপরন্তু বাজার থেকে প্রকাশ্যে প্যাড কিনে আনা সে নাকি একটা লজ্জার কাজ।

মুরুগানান্থম বাজারে যেসব স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায় তার দুই একটা ভালো করে দেখলেন। এই জিনিসের দাম এত হবে কেনো? এই জিনিস কি সস্তায় বানানো যায় না? তিনি মেডিক্যাল কলেজের পাশের ডাস্টবিন থেকে ব্যবহৃত ফেলে দেওয়া প্যাড এনেও পরীক্ষা করলেন, ঠিক কি ধরনের জিনিস তাকে বানাতে হবে সেটা বুঝার জন্যে। তারপর পরীক্ষামূলকভাবে প্যাড বানানোও শুরু করলেন।

মুরুগানান্থম যেসব প্যাড বানাচ্ছেন সেগুলি টেস্ট করা হবে কিভাবে? ওর স্ত্রী আর বোনদেরকে দিলেন পরীক্ষা করতে। স্ত্রী আর বোনরা প্রথমে দুই একবার পরীক্ষা করার জন্যে সেগুলি ব্যবহার করলো ঠিকই, কিন্তু এরপর বলে দিলো, না, তোমার এই পরীক্ষা নিরীক্ষায় আমরা নাই। কেনো? প্যাড ব্যবহার করার পর সেগুলির ফলাফল অভিজ্ঞতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে ওদের শরম লাগছিলো।

মুরুগানান্থম তো আর প্যাড পরীক্ষার জন্য ভলান্টিয়ার পায় না। কি করবে? এবার সে নিজেই প্যাড বানিয়ে নিজেই পরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। প্যাড পরীক্ষার জন্যে একটা ব্লাডারে মুরগি ছাগল এইসবে রক্ত ভরে নিজের শরীরের সাথে বেঁধে নেয়। পরীক্ষা করতে গিয়ে তো নানারকম বিপত্তি ঘটে। ক্রমে লোকে জেনে যায় যে আমাদের মুরুগানান্থম মেয়েদের মতো স্যানিটারি প্যাড পরে ঘুরে বেড়ায়। এরপর গোটা তল্লাটের লোক ওকে নিয়ে কিরকম হাসিঠাট্টা করতে পারে সে তো আপনি অনুমানই করতে পারেন।

মুরুগানান্থম কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে। সে অতি কম মূল্যে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি প্যাড তৈরির মেশিন বানিয়েছে। এই মেশিন দিয়ে প্যাড বানানো খুবই সহজ। একবার দেখিয়ে দিলে গ্রামের মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজনীয় প্যাড বানিয়ে নিতে পারে। মুড়ুগান এখন সেই মেশিন ভারতের গ্রামে গ্রামে বিলিয়ে বেড়াচ্ছে।

(২) 
মুরুগানান্থমের কথা কেনো বলছি বলি।

আমাদের এখানে মেয়েরা হ্যাপি টু ব্লিড নামে একটা ক্যাম্পেইন মতো শুরু করেছে। ফেসবুকে আমি সেরকম কিছু পোস্ট দেখেছি। দুই একটা পোস্টে লাইকও দিয়েছি। এই ঋতু বা ঋতুস্রাব ব্যাপারটা তো নিছক একটা স্বাভাবিক জৈবিক ব্যাপার। এটাতে তো শ্লীল অশ্লীলের কিছু নাই। কিন্তু আমাদের সমাজে অন্যান্য নানারকম অনাবশ্যক ইয়ের মতো ঋতুস্রাব নিয়েও একটা ট্যাবু আছে- এটা নিয়ে কথা বলা যাবে না, আলোচনা করা যাবে না ইত্যাদি। কেননা ধর্মগুলি আবার ব্যাপারটাকে আরও মন্দ করে দিয়েছে- প্রায় প্রতিটা ধর্মেই ঋতুকালীন সময়টাকে অপবিত্র নোংরা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

এইসব ট্যাবু ভাঙ্গার জন্যে এইরকম একটা ক্যাম্পেইন হলে খারাপ কি? এটা একটা স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া, এটা নিয়ে যদি ট্যাবুটা ভাঙতে পারি আমরা আখেরে আমাদেরই উপকার। কেননা এই 'গোপন' 'অশ্লীল' 'নিষিদ্ধ' 'অপবিত্র' এইসব ধারনার কারণে মেয়েরা এইটা নিয়ে কথা বলতে চায় না আর নানারকম স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হয়। আর আসলেই তো, ঋতুকালীন সময়টাতে মেয়েরা কি আসলেই অপবিত্র বা অযোগ্য হয়ে যায়? যায় না তো। সেই কয়টা দিন তো মেয়েরা ইচ্ছে করলে প্রেম ভালোবাসা সহ সবকিছুই করতে পারে।

করুক মেয়েরা একটা ক্যাম্পেইন। করুক না, আপনার কি? আপনি হয়তো এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে অস্বস্তি বোধ করেন বা আপনি হয়তো জেনুইনলিই মনে করেন যে এইসব বিষয় প্রকাশ্যে আলোচনা করা উচিৎ না। ঠিক আছে আপনার মতামত আপনার কাছে, সেটা নিয়ে আপনি থাকুন, যেখানে মেয়েরা ঋতুস্রাব নিয়ে আলোচনা করছে সেই দিকে আপনি আপনার খুর না বাড়ালেই হয়।

ঠিক আছে, আপনি যদি এইরকম ক্যাম্পেইনের বিরোধিতা করতে চান, সেটাও ঠিক আছে। আপনি তাইলে ওদের সাথে তর্ক করেন। আজকাল তো তথ্য জ্ঞান ইত্যাদি পাওয়া খুবই সহজ। ইনবক্সে চ্যাট করতে করতেও অনেককে দেখেছি গুগল করে তথ্য জোগাড় করছে। আপনি তথ্য যুক্তি এগুলি জোগাড় করে তর্ক করেন, তর্ক তো ভাল।

(৩) 
কিন্তু কিছু বীর পুঙ্গব আছেন যারা তর্ক করবেন না, এবং এই হ্যাপি টু ব্লিড এটা নিয়ে মেয়েদের পোস্ট সহ্যও করবেন না। এই ভাইজানেরা লেগে যায় মেয়েদেরকে গালাগালি করতে। সে গালাগালি যে কি ভয়ংকর গালাগালি সে বলে ব্যাখ্যা করার মতো না। এমনিতেই তো যে কোনো গালাগালিতেই শেষ বিচারে নারীকেই অপমান করা হয়, এইখানে কিনা আবার নারীকেই লক্ষ্য করে এইসব গালাগালি হচ্ছে।

আমার ফেসবুকে ক্যামেলিয়া শারমিন চূড়া নামে একজন যুক্ত আছে, বাচ্চা একটা মেয়ে, খুব সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক ক্লাসগুলির ছাত্রী। সেও নারীর ঋতুচক্র সংক্রান্ত পোস্ট দিয়েছিলো কয়েকটা। সাহসী মেয়ে। লড়বে। সে দেখলাম ওর ফেসবুকে কিছু স্ক্রিনশট পোস্ট করে দিয়েছে- ঋতুচক্র সংক্রান্ত পোস্টগুলির কারণে আমাদের বাঙ্গালী বীরপুরুষেরা ওর দিকে যেসব গালি ছুড়ে দিয়েছে ইনবক্সে, সেইসবের স্ক্রিনশট।

আমাদের এখানে মেয়েদেরকে গালি দিলে মেয়েরা আড়াল করতে চায়। কেননা সমাজ প্রথমেই মেয়েটাকেই দুষবে। ভাবখানা যেন একটা পুরুষ তার নোংরা জিহ্বা দিয়ে একটা গালি দিলে মেয়েটাই অপবিত্র হয়ে গেলো। এই মেয়ে আড়াল করে নি- সে সকলের সামনে তুলে ধরেছে কে তাকে কি কি গালি দিয়েছে। বেশ করেছে। আপনারা যারা এই মেয়েটাকে গালাগালি করেছেন ওদেরকে বলি, আপনাদের গালিতে মেয়েটার কোনো অপমান হয় না। এইসব গালি দিয়ে আপনি কেবল আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছেন আপনার মাথায় মগজে মনে আর পেটে কেবল নোংরা পুঁজ ভর্তি।

(৪) 
শুরুতে যে অরুনাচলম মরুগানান্থমের কথা বলছিলাম (চলেন আমরা ওকে মুরুগান ভাই বলেই না হয় ডাকি), হি ইজ আ রিয়াল ম্যান। আমাদের মুরুগান ভাইয়ের মতো লোকেরাই প্রকৃত পুরুষ। আপনি যদি পৌরুষ শিখতে চান, মুরুগান ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেন। আর যারা ক্যামেলিয়া শারমিন চূড়া বা ওর মতো অন্যদেরকে গালিগালাজ করেন আর ভাবেন যে খুব বেটাগিরি দেখিয়ে দিলেন ওরা তো পুরুষই না, এরা হচ্ছে ক্লীব প্রকৃতির লোক।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ছোট করার জন্যে বলছি না- কিন্তু আপনি দেখবেন যে হিজড়ারা সবচেয়ে অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে পারে। একদম আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে চূড়ান্ত অশ্লীল গালিটা অম্লান চেহারায় ছুড়ে দেবে। হিজড়ারা কেনো ঐরকম অশ্লীল কথা বলে বা ভঙ্গি করে এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। যেসব আপাতদৃষ্টে পুরুষ নারীকে অশ্লীল গালি দিয়ে আনন্দ পায়, ওদের ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যাখ্যা সম্ভবত প্রযোজ্য।

3275 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।