জন্মই যদি ভবে একটি বিশেষণ নিয়ে তবে আমি সেই নারী। আমি যে মেয়ে এটা আমি মর্মে অনুভব করেছিলাম যখন ক্লাস নাইনে পড়ি। স্কুলে যাবার পথে সুন্দর মুখের ছেলেদের দেখে কত কিছু ভাবতাম এখন মনে পড়লে একাকী হাসি।
তারপর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় হাঁটছি। আজও নিজকে মানুষ বলে ভাবতে শিখিনি। তখন আমি সদ্য কিশোরী, পৃথিবীরর সব কিছু আমার কাছে রঙিণ মনে হতো। আপন পর কিংবা কে কাছের কে দূরের এমন পার্থক্য বুঝতে শিখিনি। মামাত খালাত ভাইদের নিজের মনে করে দুষ্টুমি করতাম, খেলতাম এবং কখনো গা ঘেসে বসতাম। অন্যথা মনে হয়নি কখনো।
একদিন দুপুরে নিভৃতে এক খালাত ভাই তার শক্ত হাত আমার অস্তিনে রাখে। প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছিলাম, তবে এটা কিছু একটা অন্যায় হয়েছে আমার সাথে সেটা বুঝতে কষ্ট হয়নি। বস্তুত, কি এক স্পর্শ প্রায় পনের দিন আমার বুকের উপর অনুভব করেছিলাম। মনে হয়েছিল একটা পাথর পড়ে আছে। ব্যপারটা এখানেই ইস্তফা হতে পারত কিন্তু বড় ভাই যেখানে বুকের স্বাদ নিয়েছে ছোট ভাই সেখানে একদিন ভালো করে সঙ্গমের পুলকতা বুঝানোর শিক্ষক
রূপে আভির্ভূত হল। সে কতটা জ্ঞানের জাহির করতে পেরেছে তা জানিনা তবে, পৃথিবীর তাবত সূখের লোভ দেখিয়েও আমাকে তার মতো করে ভোগ করতে পারেনি।
একদিন সন্ধ্যাবেলা কলের জলে ধূলো- ময়লা ধূতে গিয়ে কথিত এক কাকার কালিমা লেপন করে এলাম। লোকটা বয়সী, মজুর করে জীবীকা নির্বাহ করে, শরীরে সোদা গন্ধ। সন্ধ্যায় একাকী নিজর্ন কলের ধারে পেয়ে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। শলাকার মতো কালো গোঁফ আমার গালে, ওষ্ঠে বিঁধিয়ে দেয়। বুকটা মথিত করে দিয়ে ডাকাতের মতো যখন সে চলে গেল দেখলাম, অনতিদূরে আম গাছে একটি পাখি ডানা ঝাপটা দিয়ে উঁড়ে পালাচ্ছে। হয়ত মানুষ হয়ে কথিত কাকা আমার সাথে যে হিংস্রতার নমুনা দেখাল, পাখি হয়েও কোনো পুরুষ পাখি তার প্রতি এতটা হিংস্র হয়নি কখনো। এটা সে নিশ্চই বুঝতে পরেছে এবং ভয় পেয়ে পালিয়েছে।
ব্যপারটা "আপনা মাংসে হরিণা বৈরীর" মতো। হরিণ বাঘের খাবার তূল্য মাংস নিজের শরীরে বয়ে বেড়ায় বলে নিজের মাংসই হরিণের কাছে শত্রু। কিন্তু মানুষেরর হিংস্রতা তার থেকেও জঘন্য এবং ঘৃণ্য। বস্তুত, মানুষ পশুর থেকেও
কখনো ভয়াল হিংস্র রূপ নিয়ে মর্ত্তে আর্ভিভূত হয়।
যখন বিয়ে হলো আমার পড়াশোনা শিকেয় তুলতে হলো। সংসারের কাজ সেই সকাল থেকে রাত অবধি একটানা করে চলেছি। স্বামীর সুবাদে তার আত্মীয়দের দেখাশুনা আমার উপর নাকি বর্তায়। নিজকে একটু আয়নায় দেখারও সূযোগ হয়নি। সবার খাবার যোগাড় করে খেয়েছি সবার শেষে। আমি মানুষ হতে পারলাম কই?
তবুও শান্তি পেতাম। একদিন ননদের স্বামী তার পেশীবহূল দেহ দেখিয়ে রসিকতা করে বলে, -ভাবী তোমার ননদের মতো এতটা সূখী কতজন আছে। প্রতি রাতের নীরবতা ছিন্ন করে আমি তাকে যে সূখের প্লাবণে ভাসিয়ে দেই তাতে দিন কয়েক পরেও তার ঘোর কাটেনা। তবে তোমার জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে মন বলে তুমি
যদি চাইতে তবে পৃথিবীর সব সূখ দিয়ে তোমার নারীত্বকে আমি র্স্বাথক করতাম।
তার চাতুরী সেখানেই শেষ হয়নি। একদিন দুপুরে সবাই বাইরে ছিল, ঘরে আমি একা। সূযোগ বুঝে নন্দাই আমাকে বদ্ধ ঘরে জাপটে ধরে। কোন মতে নিজকে বাচিঁয়ে ফিরি কিন্তু মনের এই অব্যক্ত কষ্টের কথা কাউকে কোনোদিন বলতে পারিনি। স্বামী আমার সব চেয়ে আপনজন সেটা আমি ভাবি কিন্তু সে আমাকে ভোগের বস্তু বৈ অন্য কিছু ভাবে কিনা আমার জানা নেই কারণ আমি তার মনের লেখা পড়তে পারিনা। পাছে বিষয়টি লুকাতে হয় কেননা, সমাজে এ কথা জানার পর আমাকে কেউ সতী সাবিত্রী না ভেবে অকারণেই আমি নষ্টা ভ্রষ্টার খেতাব পাবো। আসলে আমি নারী কেন বুঝতে পারিনা মানুষ কেন নয়?
রাতে স্বামী বাসায় ফিরলে তার কত রকমের যত্ন আত্তি করি। একটু কোথাও কমতি হলে আমি নাকি ভালো বউ নই। মধ্যরাতে একটু ঘুমুতে গিয়ে স্বামী মানুষটা আদর করতে করতে বলে আমি নাকি মানুষও। কারণ তখন সে বিশেষ কিছু পাওয়ার প্রত্যয়ে কামনার ঘোরে এসব আদূরে ভঙ্গিতে বলে। আমিতো তার থেকে স্পর্শেরর আদর পেতে চাই, নিরেট ভালোবাসা চাই। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক পুরুষালী চরিত্র প্রকাশ করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই স্পর্শ আদরের পরিতর্তে আমাকে জাপটে ধরে, আমার ভিতরে তার বলিষ্ঠ মাংস বসিয়ে দেয়। ভালোবাসাহীন তরল বিষের জলে ভাসায় জঠরের কোটর। আমি যখন আমার সূখটা অনুভব করতে শুরু করি সে তার তৃপ্তিটা আয়ত্ব করে পাশ ফিরে নিঘোরে ঘুমায়। একটা সূখাভাবের যন্ত্রনায় ছটফট করি সারারাত আর ভাবি মানুষ কবে হবো আমি। জগতে নারীর ইচ্ছার কি দাম আছে যদি মানুষ হতে পারতাম!
তারপর নয় মাস ধরে জঠর ভাড়ী হয় তার সন্তানের ওজন পেটে বয়ে বেড়াই। একটা আস্ত মানুষের পেটে আরেকটা দেহ। ভাবা যায়! অত:পর প্রসবকালীন যন্ত্রণায় বেহূঁস হই। রণক্ষেত্রের জিঘাংসার মতো রক্তাক্ত হয় কোমড়ের চারপাশ। প্রসবের একেকটা ব্যাথা যেন মৃত্যু যন্ত্রণা। মনে হয়, কলিজাটা ফেটে গলে গলে বের হয়ে যাবে। একটু সান্ত্বনা পাই যখন সোনা যাদুর বদনখানি দেখি। তবুও মানুষ হতে পারিনি আমি।
সন্তানের কোনো ভালো মন্দের বিষয়ে কোন মত প্রকাশে কত বাধা। পেটে ধরা, প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করা, লালন পালন করা ইত্যদি সব করেও সন্তানটি আমার নয়। মাত্র দু'দশ মিনিটের তামাসা করে আমাকে মানসিক কষ্ট দিয়ে নিঘোরে
ঘুমিয়ে সন্তানের সব অধিকার সে এবং তার বংশকূলের সবাই নিয়ে নিল।
তাহলে আমি কি? আমি মানুষ নই মেয়ে মানুষ, প্রকৃতির চারপাশ আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে। মানুষ আমি কি হতে পারবো আদৌ কোনদিন!