চৈতী আহমেদ

প্রধান সম্পাদক, নারী

এমনও কি ভিসি হয়! প্রসঙ্গ : রা’বি শিক্ষার্থী অপহরণ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা হলের সামনে থেকে গতকাল ১৭ নভেম্বর শুক্রবার সকাল আটটা পনেরো/ বিশ মিনিটের দিকে  বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে অপহরণ করা হয়েছে। অপহৃত শিক্ষার্থীটি বাংলা বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, সে তাপসী রাবেয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। তার ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো গতকাল, সে তার দুই বন্ধুর সাথে পরীক্ষা দেয়ার জন্য বের হয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেসা হলের সামনে আসলে সেখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থাকা, তার প্রাক্তন স্বামী রানাসহ ৫/৬ জন যুবক জোরপূর্বক তাকে মাইক্রোবাসে তুলে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

ঘটনাটি আমি জানতে পারি সকালেই, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের ফেসবুক স্টাটাস থেকে। সে জানায়। অপহৃত শিক্ষার্থীর বন্ধুরা পরীক্ষার হলে গিয়ে অপহরণের ঘটনাটি জানালে, পরীক্ষা কমিটি ঘটনাটিকে  গুরুত্ব না দিয়ে, অপহরণের বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের পরীক্ষা দিতে বাধ্য করে। অপহৃত শিক্ষার্থীর বন্ধু প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী দু’জন এবং অন্যান্যরা পরীক্ষা দেবো না বলে  প্রতিবাদ জানালে পরীক্ষা কমিটি তাদের ধমক দেয় এবং পরীক্ষা দিতে বাধ্য করে। অপহৃত শিক্ষার্থীর অন্য সব বন্ধুরা কেঁদে কেঁদে পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধ্য হয়।

পরীক্ষার শেষে বিকাল চারটায় শিক্ষার্থীরা তাদের সতীর্থ অপহরণের প্রতিবাদে ভিসি অফিসের সামনে সমবেত হলে, ভিসি সামনে না এসে প্রোক্টর ড. লুৎফর রহমানকে এবং একজন ছাত্র উপদেষ্টা আর রসায়ন বিভাগের একজন শিক্ষককে পাঠান বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের কাছে।  প্রোক্টর এসে বলেন “এটা পারিবারিক ইস্যু, স্বামীর অধিকার আছে বউকে নিয়ে যাওয়ার।”  তিনি ছাত্রদের আরো বলেন ’তোমরা চিন্তা করো না, সে  ভালো আছে, তার স্বামীর কাছে আছে।”

একজন নারীবাদী আন্দোলনকর্মী হিসেবে, আমার মাথাব্যথা শুরু এখান থেকেই। একজন  বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর  ভিসির পক্ষ থেকে বলছেন-’এটা পারিবারিক ইস্যু, স্বামীর অধিকার আছে বউকে নিয়ে যাওয়ার।” এমনও কি ভিসি হয়! যে জানেন না, শুধু স্বামী কেনো কারোরই অধিকার নেই একজন নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তুলে নিয়ে যাবার!

তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সকাল সোয়া আটটায় ঘটে যাওয়া ঘটনা। বিকাল চারটায় গিয়ে জানা গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, এবং প্রোক্টর জানেনই না যে অপহরণকারী অপহৃত শিক্ষার্থীর স্বামী নন, প্রাক্তন স্বামী। যেখানে অন্য সব শিক্ষার্থীরা জানে মেয়েটির তিন মাস আগেই তার স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে।

ওহ ভুলেই গিয়েছিলাম স্বামী হলো নারী’র চিরন্তন প্রভূ, নারীর যেখানে অনন্ত দাসত্ব! তালাকপ্রাপ্ত হলেও ঘোচে না যেই দাসত্ব,  সেই নারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই কি ঘুচবে সেই দাসত্ব? ঘুচবে না যে, প্রোক্টর তাঁর বক্তব্যে সেটাই বুঝিয়ে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক আর চাঁদে গিয়ে পড়ুক তাতে নারীর কোনো হের ফের হয় না।  সেই নারীর যেহেতু একজন স্বামী আছে সেই স্বামী ইচ্ছে হলেই তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। স্বামীটি চাইলেই তাকে পরীক্ষা না দিতে বাধ্য করতে পারে। স্বামী চাইলেই নারীটিকে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে!

কোথায় আছি আমরা? কেউ স্বামী হলেই একজন নারীকে অপহরণ করতে পারে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা প্রক্টোর বলতে পারেন এই কথা?  একজন স্বামী শুধু স্বামী হওয়ার অধিকারে একজন শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাস থেকে তার পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পথে অপহরণ করে নিয়ে যেতে পারে? এটা জানার পরেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের নিশ্চিন্তে থাকতেও বলতে পারেন!

সেটাও না হয় গেলো। এমন মন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টরতো দূরের কথা একজন উজবুকের কাছ থেকেও কি আমরা এই সময়ে এসে শুনবো আশা করি? যখন নারীবাদী আন্দোলন এর তৃতীয় তরঙ্গ একটা দেশের দুয়ারে কড়া নাড়ছে? (এই আন্দোলন নিয়ে যদিও শহুরে এলিট এবং টকশো কেন্দ্রিক বলে বিতর্ক আছে)   অবশ্য মৌলবাদ যদি ইতিমধ্যে ঐ দেশটির একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির চকির তলায় ঢুকে বসে থাকে তাহলে ভিন্ন কথা!

এই যখন একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নারীর অবস্থা তখন আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাসহ সব ধরণের সুবিধা বঞ্চিত নারীর অবস্থা অনুমান করতেই পারি! বুঝতে পারি, কেনো তনু হত্যার বিচার হয় না। কেনো চাকরিতে যোগ দিয়ে ফেরার সময় রূপাকে বাসের স্টাফরা ধর্ষণের পর হত্যা করার বলে বলিয়ান হয়। আমরা বুঝতে পারি কেনো পাঁচ বছরের শিশু পূজার যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে বড় করে ধর্ষণ করা হয়। কারণ সমাজ রাষ্ট্রের সচেতন অংশেই রয়েছে ভিসির মতো নারীকে নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যাকে সমর্থন করার পুরুষতান্ত্রিক মস্তিস্ক, যারা ভাবে যে বিবাহিত নারী ইউনিভার্সিটিতে আসলে তাকে তার স্বামী তুলে নিয়ে যেতেই পারে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।  অথচ রাজনৈতিক একটা পক্ষ প্রচার করছে দেশ ভেসে যাচ্ছে উন্নয়নের জোয়ারে, একই পক্ষ নারীর ক্ষমতায়নের ডঙ্কাও পিটিয়ে যাচ্ছে জোরে শোরেই। যা শুনে ভিমরি খাচ্ছে উন্নত বিশ্ব।

অন্যদিকে, শিক্ষার্থীটিকে যেহেতু তার স্বামী তুলে নিয়ে গেছে সম্ভবত সেই কারণেই সারাদিনব্যাপী ঘটনাটি মূলধারার গণমাধ্যমের ব্রেকিং এর মর্যাদা পেতেও ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ হয় সংবাদ হিসেবেও মর্যাদা পেতে। অনেক খোঁজাখুজির পরে বিকেলের দিকে ’বাংলার কথা’ নামে খুবই অখ্যাত একটি অনলাইন ঘটনাটিকে সংবাদ হিসেবে গ্রহণ করে। তারও অনেক পরে একজন আমার ফেসবুক স্টাটাসের মন্তব্যে জানান “হ্যাঁ ঘটনাটি সত্য, টিভি স্ক্রলে দেখতে পাচ্ছি। ” যাক স্বামী কর্তৃক অপহৃত  হলেও তাহলে সংবাদ হওয়া যায়!

যে দেশে বর্তমানে নারীকে সংবাদ হতে হলে মিনিমাম বাসে বা ট্রাকে গণধর্ষণতো হতেই হয়। তা না হলে সেই সংবাদ, সংবাদ মাধ্যমের এবং সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের যোগ্য হয় না। প্রশাসন বা ক্ষমতার দৃষ্টি আকর্ষণে গেলাম না। কারণ আমাদের  ক্ষমতার বলয়ে নারী লাঞ্ছনার বিষয় কবেই বা পশেছে? ক্ষমতা তথা প্রশাসন হয়তো মনে করে নারীর আবার লাঞ্ছনা কি? যেখানে ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান। ৯৫% মুসলমানের দেশের প্রশাসন যে তাদের প্রাণমন মৌলবাদের কাছে ইতিমধ্যেই  বর্গা দিয়ে দিয়েছেন সেটা এখন দেশের মায়ে জানে, বাবায় যদিও জানে, না জানার মতোই ভাণ ধরে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিন শেষেও যে ঘটনাকে অপহরণ বলে স্বীকার করছেন না, স্বামীর সাথে অভিসারে যাওয়া বলে চালাতে চাইছেন, চলেন সেই ঘটনার শুরুটা একটু জেনে নেই।

শিক্ষার্থীর নাম শোভা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ফাইনাল ইয়ারে ছাত্রী। তাপসী রাবেয়া হলের আবাসিক শিক্ষাথী সে। নওগাঁ জেলার মাহাদেবপুর উপজেলার মাতাজি এলাকায় তার বাড়ি।

তার স্বামী অভিযুক্ত সোহেল রানা পেশায় একজন আইনজীবী। সোহেল রানার বাড়ি নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার নজিপুরে।

সোহেল রানার সাথে গত ডিসেম্বর মাসে শোভার বিয়ে হয়। সোহেল রানার একজন নায়কের নামে নাম হলেও যৌতুক লোভী পুরুষ  ভিলেনের মতো যৌতুকের জন্য শোভাকে নিয়মিত নির্যাতন করতো। ফলশ্রুতিতে শোভার সাথে সোহেল রানার অক্টোবরের ১০ তারিখে তালাক হয়ে যায়। নিয়ম অনুযায়ী ডিসেম্বরে তাদের তালাক কার্যকর হবে। কিন্তু সোহেল রানা চায় না তাদের তালাক কার্যকর হোক। কারণ পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ তাকে এই আত্মবিশ্বাস দিয়েছে যে শোভাকে যেহেতু সে ‍বিয়ে করেছে তাই সে না চাইলে শোভা তাকে তালাক দিতে পারে না। তাই সে শোভাকে ফোনে বিরক্ত করতো।

ভিসি ঘটনাকে অপহরণ হিসেবে মানতে না চাইলেও শোভার বাবা গতকালই একটি অপহরণের মামলা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসের নড়বড়ে নিরাপত্তার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বিভিন্ন মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে চলেছেন আজ অবধি।

‘বাংলার কথা’ অনলাইনটির মাধ্যমে জানা যায়- “এই বিষয়ে মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের জানিয়েছেন, তারা স্বামী স্ত্রী। তার স্বামীই নাকি তাকে নিয়ে গেছে। প্রাথমিক ভাবে আমাদের বলা হয়েছে তাদের খুঁজাখুজি করতে। আমরা সব জায়গায় মেসেজ দিয়েছি।”

শোভা অপহরণের চব্বিশঘন্টা পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত শোভাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। একাত্তর টিভি থেকে মিথ্যা সংবাদ প্রচারের অভিযোগও করেন উক্ত শিক্ষার্থী। একাত্তর টিভি নাকি প্রচার করছে –‘শোভাকে পাওয়া গেছে’ অথচ শিক্ষার্থীর মা জানাচ্ছেন –‘শোভাকে পাওয়া যায়নি।
একজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ হয়ে গেলো ফাইনাল পরীক্ষার দিন, অথচ ভিসি থানাকে বলছেন ‘তারা স্বামী-স্ত্রী, প্রাথমিক ভাবে খোঁজ খবর করতে!

যখন এই লেখাটি লিখছি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অপহরণের প্রতিবাদে যোগ দিয়েছে পূর্বঘোষিত বিক্ষোভে। আমি জানি না ভিসি ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন কিনা যে স্বামী হলেও কোনো নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কেনো, কোনো জায়গা থেকেই অপহরণ করা যায় না। জানি না এটা জেনে তিনি থানাকে গুরুত্ব দিয়ে শোভাকে খুঁজে বের করার জন্য বলেছেন কিনা! আশা করছি তিনি ভিসি হিসেবে এটাও বুঝবেন তার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসটি কতটা অরক্ষিত। কতটা নিরাপত্তাহীন! যত দ্রুত বুঝবেন ততই ভালো। না বুঝলে অভিভাবক শিক্ষার্থী এবং দেশের সচেতন মহলেরই তাঁকে বোঝানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সমর্থন জানিয়ে শোভাকে দ্রুত খুঁজে বের করার ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার দাবি জানাচ্ছি।  

2038 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।