সারা বিশ্বব্যাপী আজ উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস, এই দিনটি উদযাপন করা হয় নারীর সামাজিক রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত অর্জন ও অবস্থানের স্বীকৃতি হিসেবে। মানুষ হিসেবে পুরুষের সাথে নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠায় এইদিনের তাৎপর্য অপরিসীম। দিনটিকে ইংরেজিতে ‘International Women's Day’ এবং সংক্ষেপে IWD বলা হয়।
নারী দিবস পালন হয়ে আসছে ১৯০০ শতকের শুরু থেকেই। ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে প্রথম এই দিনটি উদযাপন শুরু হয়। ১৯১০সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল উইমেন কনফারেন্স থেকে আমেরিকান সোস্যালিস্ট, জার্মান সোস্যলিস্ট গ্রুপসহ লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, সুইজারল্যানডের অগণিত মানুষের জোর দাবীর প্রেক্ষিতে একটি দিনকে ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেনস ডে’ হিসেবে নির্ধারন করার কথা বলা হয়। ১৯১৪ সালে প্রথমবারের মতো মার্চের ৮ তারিখে, ইন্টারন্যাশনাল ওমেন্স ডে পালিত হয়। ধরে নেয়া হয় যে সেদিনটি রবিবার ছিলো বলেই ঐ দিনটিকে বেছে নেয়া হয়েছিলো।
১৯১৭ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার পেত্রোগ্রাদে মহিলা টেকস্টাইল কর্মীরা ‘ব্রেড এন্ড পিস’ এর জন্যে প্রতিবাদ আন্দোলন করে এবং নারীর ভোটের অধিকার আদায় করে নেয়। প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলনের ভেতর দিয়েই রুশ বিপ্লবেরও সূচনা হয়েছিলো। অধিকার আদায়ের এই সাফল্যের পরে, ‘নারীর অধিকার আদায়ের মাইলফলক’ হিসেবে ৮ই মার্চ এর সম্মানে সে দেশে জাতীয় ছুটি পালন ও উদযাপন করা শুরু হয়। নারীর ভোটের অধিকার, কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের প্রতি বৈষম্যহীন সমমজুরী, সরকারী বা পাবলিক অফিসে নারী কর্মীর অন্তর্ভুক্তি এসকল দাবির প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ সভা হতে থাকে, কেবল মাত্র অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান এম্পায়ারেই তিনশতেরও বেশী প্রতিবাদ সভা হয়েছে। ভিয়েনাতেও বিশাল প্রতিবাদ, র্যালী, ব্যানার বহন, গনসংযোগ ইত্যাদি করেছে জনগণ।
১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ এই দিনটিকে উদযাপন করতে শুরু করলেও ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় এর সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে আমন্ত্রণ জানান হয় ৮ই মার্চকে নারীর অধিকার ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেবার। সেই থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হয়ে ওঠে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আপন অধিকার নিয়ে মুক্ত ভাবে পৃথিবীর বুকে নারীর টিকে থাকার এক সনদ। আর সেকারণেই বিশেষ ভাবে এই দিনটিকে উপস্থাপন করা হয়-
1.Civil awareness day- 2. Women and girls day 3. Anti-sexism day 4. Anti-Discrimination Day হিসেবে।
সারা পৃথিবীতেই দিনটি পালিত হয় শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, উপস্থাপনা, পরিবেশনার ভিতর দিয়ে নারীর অধিকার আদায়ের দাবী, ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতন অবস্থান নেয়ার প্রত্যয়ে। র্যালি, মার্চ, কনফারেন্স, নেটওয়ার্কিং, প্রবন্ধপাঠ, বক্তৃতা এসবের ভেতর দিয়ে বিশ্বব্যাপী সকল নারীর সাথে একটি যোগসূত্র স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সাধারণত বেগুনী, গোলাপি রঙের পোশাক পরা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে লাল, সবুজ, সাদাও পরা হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কথা বলতে গিয়ে যখন তাকাই নিজের দিকে, আমার রঙ, চেহারা, শারীরিক গড়ন, খাদ্য, পোশাক আর ভাষা আমাকে নিয়ে যায় স্বদেশে। বাংলাদেশে। যেখানে আমার হাজার বছরের শেকড়ের ইতিহাস। আমার বংশের কোথাও কেউ ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান,বা পাকিস্তান থেকে আসা নয়। আমি এসেছি এই বাংলার পলিমাটি ছুঁয়ে বেড়ে ওঠা মেটে মেটে রঙের দরিদ্র, নিম্নবর্ণের কামার, কুমোর, জেলে বা নমশূদ্রের রক্তস্রোত বয়ে। আমি বাঙালী। আমার রয়েছে কোমরে কাস্তে গোঁজা তেজ, বীরত্ব ও প্রতিবাদী স্বত্বা। আমি মানুষ, আমি নারী, এই আমার অহংকার।
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো সকল বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথা উঁচু করে চলার আকাংক্ষায়। শিক্ষা, বাসস্থান, চাকরি, সামাজিক অবস্থান, চলায়, বলায়, জীবনযাপনে কি নারী, কি পুরুষ সকলের থাকবে সমান অধিকার, সেই আশায়। কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ সমাজের একটি বিশেষ অংশ সরে দাঁড়িয়েছে সেই আশা ও স্বপ্ন, সেই প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয় থেকে।
প্রতিদিন নারীর উপরে চলছে অমানবিক আচরণ। নির্মম হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষ্ণ, অপমান, সীমাহীন অসহিষ্ণুতা, মানসিক অত্যাচার। চলছে রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে, স্কুলে, কলেজে, অফিসে, আদালতে সর্বত্র যৌন হয়রানি, ইভ টিজিং। যে সকল তরুণেরা গতকাল ৭ই মার্চ মেয়েদেরকে যৌন হয়রানি করেছে তাদের কঠিন শাস্তির দাবী জানাই। এই তরুণ সমাজ আমাদের দেশের সন্তান সেকথা ভাবতেও ঘৃণা হয়। তারা যা করেছে ও করছে তা অকল্পনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। নারীর প্রতি যৌন হয়রানি, বিনা অনুমতিতে তাকে স্পর্শ করা, অপমান করা, বুলিং বা ইভ টিজিং করা শাস্তিসোগ্য অপরাধ, ক্রিমিনাল অফেন্স।
আজ এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূর্য যখন বাংলাদেশের বুকেও আলো ছড়িয়ে দিয়েছে সেই আলোতে কিছু অন্ধকার, কিছু কলঙ্কের কালী, কিছু অপমান কিছু নির্লজ্জতা দেখে নেই। লজ্জার মাথা খেয়ে জেনে নেই এমনদিনে বাংলাদেশের সাধারণ নারীদের অবস্থান কোথায়। গতকাল ৭ই মার্চের সমাবেশে যাওয়া ও আসার সময়ে নারীর উপরে চলেছে যে বর্বরতা ফেসবুকের পাতায় সেইসব অনুভুতি----
১। "আসলেই এই বিশেষ দিনগুলোতে সরকারী ছুটি ঘোষণা করা উচিত। রাস্তাঘাট গুলোতে এমন বিভৎস ঘটনা, যানজট, হয়রানি সব মিলে নাজেহাল অবস্থা তৈরি হয় । জীবন যুদ্ধের তাগিদে যাদের বের হতে হয় তারাই জানেন বিশেষ দিনগুলোর ভোগান্তি । তার চেয়ে ছুটি ঘোষনা হলে জনগণও একটা দিন বিশ্রাম পেলেঅ আপনারাও নির্বিঘ্নে কার্যক্রম শেষ করতে পারলেন।"
২। "হল থেকে বের হয়ে কোনো রিক্সা পাই নি। কেউ শাহবাগ যাবে না। হেঁটে শহীদ মিনার পর্যন্ত আসতে হয়েছে। আর পুরোটা রাস্তা জুড়ে ৭মার্চ পালন করা দেশভক্ত সোনার ছেলেরা একা মেয়ে পেয়ে ইচ্ছেমতো টিজ করছে। নোংরা কথা থেকে শুরু করে যেভাবে পারছে টিজ করছে।
বহু হয়রানির পর শহীদ মিনার থেকে রিক্সা নিয়ে শাহবাগ যাচ্ছি। এতেও রক্ষা নাই। চারুকলার সামনে একদল ছেলে পানির বোতল থেকে ইচ্ছেমতো পানি ছিটাইছে গায়ে। প্রায় আধাভেজা করে দিছে। যখন রাগ হচ্ছিলাম তখন তো আরেকজন রিক্সার পেছন থেকে চুল টেনে দৌড় দিছে। সিরিয়াসলি!
গৌরবময় ৭মার্চ সোনার ছেলেরা এত ভালভাবেই পালন করছে যে নিজের ক্যাম্পাসেই harass হতে হয়। ও হ্যাঁ কেউ যেন আবার বলতে আসবেন না, জানেনই তো আজ ঝামেলা হবে বের হতে গিয়েছেন কেনো!"
৩। "খুব মজা সমাবেশ করতে যেতে আসতে রাস্তায় গ্রুপ গ্রুপ হয়ে মেয়েদের হ্যারাস করা! এক মুরুব্বি বলেছেন, "ঠিকই আছে, বের হইসো কেনো বাসা থেকে, জানো না আজকে রাস্তায় বেশি ছেলে থাকবে? আল্লাহ কেনো মেয়েদের মাত্র দুটো হাত দিলো? দুটো হাত দিয়ে এতগুলো হাত থেকে বুক, পেট বাঁচাবো নাকি কোমর, পিঠ বাঁচাবো, ওড়না ধরে রাখবো নাকি তাদের হাতগুলো সরাবো!"
৪। "আজ যে আমি স্বাভাবিক ভাবে বাসায় ফিরতে পারবো জানতাম না। এতগুলো হায়েনার চোখ উপেক্ষা করে সাইন্সল্যাব থেকে কাকরাইলের জার্নি আমার জন্যে কম কষ্টের ছিলো না, তাও পুরো পথ হেটে। তবে কিছু কিছু হায়েনার চোখের ভাষা দেখে কেঁদে দিবোই ভাবছিলাম (কারণটা বুঝে নিবেন) তবে একদম যে বেঁচে গেসি তা না কিন্তু, কেউ একজন বোতলের জল পান করার চেয়ে আমার গায়ের উপর ফেলে দেয়াটা হয়তো বেশি উপযোগী ভাবসেন। বুঝতেছিলাম না যে পানি ঢেলে দিসে এটার জন্যে আপসেট হবো নাকি খালি পানিই তো ঢালছে এর বেশী ক্ষতি করে নাই, এটা ভেবে খুশি হবো। কি ভেবে সান্ত্বনা দিবো নিজেকে। জানি না এটা আসলে কেমন ৭ই মার্চ। ৭১ এর ৭ই মার্চেও কি এমনই হতো জানার খুব ইচ্ছা। প্রতিদিন একটা না একটা ঘটনার সম্মুখীন হওয়া আমার জন্য, ইনফ্যাক্ট সব মেয়েদের জন্য এখন অভ্যাসের বিষয়। ইনফ্যাক্ট যেদিন কিছুই না ঘটে সেদিন নিজেকে অনেক ভাগ্যবতীই মনে হয়।"
৫। শান্তিনগর মোড়ে একঘণ্টা দাঁড়ায়ে থেকেও কোন বাস পাইলাম না। হেটে গেলাম বাংলা মটর। বাংলা মোটর যাইতেই মিছিলের হাতে পড়লাম। প্রায় ১৫-২০ জন আমাকে ঘিরে দাঁড়াইলো। ব্যাস। যা হওয়ার থাকে তাই। কলেজ ড্রেস পরা একটা মেয়েকে হ্যারাস করতেছে। এটা কেউ কেউ ভিডিও করার চেষ্টা করতেসে। কেউ ছবি তোলার চেষ্টা করতেসে। আমার কলেজ ড্রেসের বোতাম ছিড়ে গেছে। ওড়নার জায়গাটা খুলে ঝুলতেসে। ওরা আমাকে থাপড়াইছে। আমার শরীরে হাত দিসে। আমার দুইটা হাত এতগুলা হাত থেকে নিজের শরীরটারে বাঁচাইতে পারি নাই। একটা পুলিশ অফিসার এই মলেস্টিং চক্রে ঢুকে আমাকে বের করে একটা বাস থামায়ে বাসে তুলে দেয়। ----"
আমার ছোট্ট সোনার বাংলাদেশে এমন অসংখ্য ঘটনা নিত্যদিন ঘটে চলেছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় পাহাড়ের নিরপরাধ সুন্দর মেয়েগুলিকে, বিচার হয় না। ওদের কাছে নারী দিবস নেই। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয় কিশোরী তনুকে, বিচার হয় না। ওর কাছে নারী দিবস অর্থহীন। হুজুরের হাতে মসজিদে আরবী পড়তে আসা অপরিণত শিশুকন্যাকে রেপ করতে না পেরে হত্যা করা হয়, বিচার হয় না। এই শিশুর কাছে নারী দিবসের বারতা পৌছায় না। এমনি করে পীরের হাতে, পেয়াদার হাতে, মাদ্রাসাতে, গৃহকর্মে কোথাও নারী ও কন্যা সন্তান নিরাপদ নেই।
যে দেশের প্রধান মন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, অসংখ্য মন্ত্রী ও সাংসদ নারী, সেই দেশে নারীর এই হেন অবমাননা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। ভিডিও ফুটেজ দেখে দেখে ওদের প্রত্যেককে ধরে দৃষ্টান্ত মূলক কঠিন শাস্তি বিধান করা উচিৎ। বাংলাদেশের আইন প্রণেতাদের কাছে আজ একটি বড় দাবি জানাই, নারীকে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে একটি কঠোর আইন প্রণয়ন করুন, যার মাধ্যমে অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূল্ক কঠিন শাস্তির বিধান করা যায়।
সারাবিশ্বের অনুন্নত দেশ সমূহের সকল নারীর জীবনে আসুক মুক্তি। আসুক স্বাধীনতা। নারী একজন গর্বিত নারী, ও একজন মানুষ। এই হোক তার পরিচয়। বাংলাদেশ তাঁর সকল সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসুক নারী মুক্তির পথিকৃৎ হয়ে।