দেবশ্রী মিত্র

টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার

এনসাফ হায়দার : এক অসামান্য নারী

বছর শুরু করা যাক একজন অসামান্য নারীর কথা দিয়ে। এনসাফ হায়দার। সৌদি ব্লগার রইফ বদওয়াইয়ের স্ত্রী। ৪১ বছর বয়স্ক এই মহিলার জন্ম সৌদিতে। ২০০১ সালে রইফের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এনসাফ। রইফ বরাবরই মুক্তচিন্তার মানুষ, এনসাফও তাই। কাজেই এনাদের জুটি এই দিক দিয়ে ধরলে রাজযোটক। কিন্তু দেশটা যেহেতু সৌদি, এনাদের বাধা পেতে হয় পদে পদে। রইফ নিজের ব্লগে যতদূর সম্ভব ঢেকেঢুকে লেখেন ধর্মের জবরদস্তি আর অত্যাচারের কথা। লেখেন ধর্মের নামে পুলিশি অত্যাচারের কথা। কিন্তু তা সত্ত্বেও চোখ এড়ায় না সৌদি রাজতন্ত্র কাম ইস্লামিক ধর্মগুরুদের।

২০০৮ এ রইফকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে। ছেড়েও দেওয়া হয় যদিও। কিন্তু মুক্তচিন্তার মানুষদের সমস্যা হলো তাঁরা মুখ বন্ধ রাখতে পারেন না, পারেন নি কোনোকালেই। কাজেই রইফের লেখালিখি চলতে থাকে একইরকম ভাবে। ২০১২ তে রইফের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেন সৌদির এক বিখ্যাত ধর্মগুরু।

১৭ই জুন রইফকে ইসলাম ত্যাগের অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। সৌদিতে এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে তার বিবাহবন্ধন আপনা আপনি ছিন্ন হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে নিজের বিয়ে বাঁচানোর তাগিদে তিন সন্তানকে নিয়ে দেশ ছাড়েন এনসাফ। প্রথমে যান লেবানন। সেখান থেকে সুদূর কানাডা। এনসাফের নিজের পরিবার সৌদি কোর্টের কাছে আবেদন করেন তাদের বিচ্ছেদের জন্যে। সেসব এড়িয়ে এনসাফ কানাডা পৌঁছান এবং সেখানকার নাগরিকত্ব নেন। নাগরিকত্বের কাগজপত্রে নিজেকে বিবাহিত বলে ঘোষণা করায় তাদের বিয়ে ভেঙে দেওয়া বাঁচানো যায়। কারণ সেক্ষেত্রে সৌদির বিবাহবিচ্ছেদ কানাডার নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য হবে না।

এবার শুরু হয় এনসাফের দ্বিতীয় লড়াই। রইফকে মুক্ত করার লড়াই। ততদিনে রইফের বিচারে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচশ চাবুক মারার সাজা হয়েছে। এনসাফ লড়াই শুরু করেন রইফের মুক্তির। এই লড়াইতে তিনি পাশে পান আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে। তাদের সাহায্যে তিনি শুরু করেন বিশ্বব্যাপী প্রচার। রইফকে নাম দেওয়া হয় "প্রিজনার অফ কন্সাইন্স"। সমস্ত পশ্চিম দেশ ঘুরে এনসাফ প্রচার চালাতে থাকেন রইফের মুক্তির জন্য। অচেনা ভাষা, অচেনা দেশ এবং মানুষ, কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারে নি। একের পর এক বই লেখেন তিনি। স্বামীর যে ক’টি লেখা উদ্ধার করতে পারেন, তাই দিয়ে প্রকাশ করেন রইফের একটি বইও। ২০১৫ র ৯ই জানুয়ারি রইফকে তার প্রথম পঞ্চাশ চাবুক মারা হয় প্রকাশ্যে। এনসাফ এবং আমনেস্টি মিলে সেদিন বিশ্ব জুড়ে সৌদি এম্ব্যাসির সামনে ধরণা এবং প্রতিবাদ কর্মসূচীর আয়োজন করেন। এই আন্তর্জাতিক কর্মসূচীর জোরে সৌদি সরকার এর পর আর কখনো রইফকে চাবুক মারার সাহস দেখায় নি। সেই প্রথম, সেই শেষ। কোনো কারণ ছাড়াই তার চাবুকপ্রহার অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করা হয়।

এনসাফ আজও লড়ছেন। তিন সন্তানকে নিয়ে তিনি অপেক্ষায় আছেন কবে রইফের মুক্তি হবে। এ বারও নতুন বছরে তিনি টুইট করেছেন "শুভ নববর্ষ নয়, আমায় উইশ করুন ফ্রি রইফ। সেটাই হবে আমার জন্যে সেরা উইশ।"

আসুন আমরাও দুনিয়ার সব মুক্তচিন্তকদের তরফ থেকে বলি, রইফের মুক্তি হোক। মুক্তচিন্তার জয় হক। এনসাফের জয় হোক।

শুভ নববর্ষ। 

3221 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।