আঞ্জুমান রোজী

লেখক

নারীবাদী

এক তুখোড় নারীবাদীর সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তার সঙ্গে প্রায়ই কথা হয়, দেখা হয়। বেশিরভাগ সময় আমরা কফিশপে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। নারীবাদ নিয়ে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার অগাধ। কথা শুরু হলে বিভিন্ন আঙ্গিকে যুক্তিতর্ক দিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, তুলে ধরেন বাস্তবতার বিভিন্ন করাল দিক। আমিও খুব মন দিয়ে শুনি। আবার কখনো কখনো তার যুক্তিখণ্ডনের চেষ্টা করি। নারীবাদ নিয়ে তার পাণ্ডিত্য শুধু কথার ফুলঝুরিতেই নয়। এই বিষয়ে লেখালেখিতেও সিদ্ধহস্ত। মূলত এই লেখার মধ্য দিয়েই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। ভদ্র, মর্জিত কেতাদুরস্ত এই নারীর চলনে-বলনে, পোষাকে নান্দনিকতার ছাপ বেশ প্রশংসনীয় এবং নিজেকে নারীবাদী পরিচয় দিতেও বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

তাছাড়া, এই নারী বিভিন্ন সভা সমিতি সেমিনার নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকেন। নারীবাদ নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। একে ওকে ফুটফরমাশ দেন এটা করো ওটা করো বলে। নারীবাদ বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দেশের কনফারেন্সেও যান। আপাতদৃষ্টিতে তার সমস্ত গতিবিধি লক্ষ্য করলে বুঝা যায় উনি দেশ, সমাজ এবং মানুষের জন্য অনেককিছু করে যাচ্ছেন। তার সামগ্রিকতা নিয়ে ভাবলে এক ধরণের ভক্তি শ্রদ্ধা এসেও ভর করে।

এই নারীবাদী একজন বয়ো জ্যেষ্ঠা নারী। তাই আমার সম্মান প্রদর্শনটাও ছিলো খুব স্বাভাবিক। হঠাৎ একদিন তার বাসায় বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ করেন। আমিও খুব আয়োজন করে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে মধ্যদুপুরে উত্তরায় তার বাসার দিকে রওনা হই। বিলাসবহুল এলাকায় বাসা। গেটে দারোয়ানের কাছে পরিচয় দিয়ে উঠে যাই দোতালায়। কলিং বেল টিপতেই স্বয়ং উনি এসে দরজা খুলে দেন। খুব ইতস্তত পায়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করি। বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে সোফাতে বসালেন। নিজেও পাশে বসলেন। বললেন, আমি কিন্তু সচরাচর কাউকে নিমন্ত্রণ করি না। কিন্তু তুমি আমার কাছে স্পেশাল একজন। এটা বুঝো তো!

মনে মনে ভীমড়ি খাই। কেউ আমাকে স্পেশাল বললে অস্বস্তিতে ভুগি। কারণ, আমি খুবই সাধারণ একজন। কথাবার্তা চলাফেরাও করি সাধারণের সঙ্গে। তবে জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। অনেককিছু জানার মধ্য দিয়ে নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। এই যা!

এরই মধ্যে ঘরের কাজে সাহায্যকারী নারী দু'গ্লাস ফলের জুস নিয়ে এলো। গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঘরের চারদিক চোখ বুলাই। ভেতরে ভেতরে বেশ শিহরিত হলাম। আমি কি বাংলাদেশের নাকি সুইজারল্যান্ডের কোনো বাড়িতে বসে আছি! চোখ ঝলসানো ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন। শিল্পিত ছোঁয়ার চমকপ্রদ আবেশ।

হাতের গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে উনাকে জিজ্ঞেস করি, আপা, নারীবাদী নিয়ে আপনার যে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, কর্মকাণ্ড এবং লেখালেখি এসবের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে কি কিছু করছেন?
...আরে না। ওসব আমার কাজ না। আমার কাজ হচ্ছে লেখালেখি করে যাওয়া। আর কোথাও ডাকলে, গিয়ে দুটো কথা বলি এই যা।
....কিন্তু সাধারণ মানুষের পাশে আপনার মতো এমন কারিশমেটিক লেখক এবং বলিয়ে খুব দরকার যদি সত্যি সমাজে পরিবর্তন আনতে চান। আপনার ভেতর সেই সম্মোহন শক্তিটা প্রবল। বাংলাদেশের নারীদের যে অবস্থা! আপনাদের মতো নারীরা যদি এগিয়ে না আসেন তাহলে কীভাবে হবে?

একটু স্মিত হেসে বললেন, তুমি আমাকে নিয়ে খুব পজিটিভলি ভাবো। এটা আমার কাজের একটা বড়ো শক্তি। তবে বাস্তবতাটা ভিন্ন। যাই হোক, এসব বাদ দাও। চলো তোমাকে আমার বাড়িটা ঘুরে দেখাই।

আমি তার পিছু নিলাম। এঘর ওঘর ঘুরে ঘুরে দেখছি। চমৎকার চমৎকার পেইন্টিং এ সাজানো প্রায় প্রতিটি দেয়াল। দেখতে দেখতে চোখ যেনো আটকে থাকে সেখানে । বিমূর্ত রহস্যের এক আলো আঁধারীর ছায়া পুরো বাড়িটায়। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি বাড়ির একপাশের ব্যালকনিতে। যেখানে ঝুলে আছে মাধবীলতার ঝালর। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকতেই বা'পাশে চোখ পড়লো। সাথেসাথে কেঁপে উঠি। ব্যালকনি ঘেষে একটা ঘর, সেই ঘরে এক বয়স্ক মহিলা জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন। আটপৌরে শাড়ি পরা। কৌতুহলবশত সেই ঘরের দিকে পা বাড়াতেই সাহায্যকারী নারীটি দৌড়ে এসে আমাকে হাত ইশারায় ওখান থেকে চলে যেতে বললো। আর এদিকে নারীবাদী নারীটি আমাকে নিয়ে পুরো বাড়িময় ঘুরে দেখাতে গিয়ে হঠাৎ তার ফোনকল আসে। সেই ফাঁকে আমি ব্যালকনিতে ঢুকে পড়ি। কিন্তু মনটা উসখুস করতে লাগলো। কে এই বয়স্ক নারী? কেনো এভাবে বিমর্ষ হয়ে পড়ে আছে!

একটু কাছে গিয়ে সাহায্যকারী নারীটিকে জিজ্ঞেস করি, কে উনি?
...আপার শ্বাশুড়ি।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, উনার কাছে আমাকে যেতে না করলে কেনো?
...আপা জানলে ক্ষেইপা যাইবো।
...অহ!
...গ্রামের মানুষ তো জানে না শহরে কিভাবে থাকতে হয়। এইটা সেইটা ধইরা নষ্ট করে তাই আপায় হেরে ওই ঘরে পইড়া থাকতে কইছে।

কেমন একটা অস্বস্তিবোধ ঝেকে বসলো। ভালো লাগছে না কোনোকিছু। এখান থেকে পালাতে হবে। এক'পা দু'পা করে এগিয়ে যাচ্ছি। ডাইনিং টেবিলে দুপুরের খাবারের রাজকীয় আয়োজন। সবকিছু মাথার উপর চক্রাকারে ঘুরছে। শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিবেশ। নিরবে দরজা খুলে বের হয়ে আসি।

রাস্তায় পা রাখতেই লক্ষ্য করলাম, আমি অঝোরে ঘেমে যাচ্ছি। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দেই। এখনো মানুষ চিনতে ভুল করি! আহারে নারীবাদী!

2367 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।