নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর কর্তৃত্ব, নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে গেলে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ পরিবারে এখন পর্যন্ত গৃহীত নয়। এমন কি নারী যদি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিও হয়, তারপরেও দেখা যায় বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ ছেলের কাছেই মা বাবারা মতামত বা পরামর্শ আশা করেন এবং জিজ্ঞাসা করেন। অর্থনৈতিক প্রয়োজনে বাড়ির মেয়েটির সঙ্গে কথা বলছে, প্রয়োজনে চেয়ে নিচ্ছে, এমনকি মেয়েটি সকল দায়িত্ব সুচারুভাবে পরিচালনা করার পরও বাড়ির ছেলেটিই হচ্ছে সর্বেসর্বা। ছেলের সিদ্ধান্ত নিয়েই মা কিংবা বাবা কাজ করেন। অনেক সময় উপার্জনক্ষম মেয়েটিকে জানানোর প্রয়োজনই মনে করেন না।
অনেক স্বামী তার স্ত্রীর সিদ্ধান্ত বা পরামর্শের ধার ধারেন না। শিক্ষিত স্বামীদের মধ্যেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। এমনও কথা শুনেছি, নারীর বুদ্ধিতে চলা মানে পথের ফকির হওয়া। নারীকে অবজ্ঞা অবহেলার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় যখন নারীকে যে কোনো বিষয়ে পরামর্শের ব্যপারে উপেক্ষা করা হয়। কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত নারী, সব নারীদের বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক পঙ্গু সমাজ একই পাল্লায় মাপে। আসলে নারীকে তো মানুষই মনে করে না। ঘরের আসবাবপত্রের মতোই তার ব্যবহার বাড়ে আর কমে। নতুবা সেবাদাসীর ভূমিকায় তাকে রেখে দেয়। তার কাছ থেকে বুদ্ধি পরমর্শ নেয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
তার উপর আছে ধর্মীয় অনুশাসন। ধর্মে নাকি আছে, পুরুষই হবে বাড়ির কর্তা। তার বুদ্ধি, পরামর্শেই পরিবারের সবাইকে চলতে হবে। এমনকি সেই পুরুষ অথর্ব, কানা, কালা, মানসিকভাবে পঙ্গু, উপার্যনক্ষমহীন; যাই হোক না কেনো, পুরুষমাত্রই হলো মাতব্বর, অভিভাবক এবং কর্তা। কি এক আশ্চর্য মানসিকতা এই বাংলাদেশের! পুরুষ হলো গিয়ে ভগবান, দেবতা আরো কতকিছু! তার উপরে কথা বলা যাবে না। এখন সে যেই মতামত দিক না কেনো? যোগ্যতা থাকুক আর না থাকুক। পেশীর শক্তি আর গলা বাজিতেই পুরুষের এই দাম্ভিকতা। আর কিছু নয়। সমাজটাও সেভাবে যুগ যুগ ধরে পুরুষ দ্বারা পৈশাচিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে।
ধর্মে আছে, ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রু হওয়া যাবে না। তাহলে রোজ হাশরে শাস্তি পেতে হবে, মারা গেলে এক ভাই আরেক ভাইকে কবরে নামাবে; এমন আরো কি কি বিষয় যেন ধর্মে আছে।
কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, ভাইয়ের সঙ্গে বোনের সম্পর্ক কেমন থাকবে তা কি ধর্মে বিশেষভাবে উল্লেখ আছে? নাকি শুধু ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্কের কথা বলা আছে! ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক নষ্ট হলে পাপ হবে, আর বোনের সঙ্গে ভাই সম্পর্ক খারাপ রাখলে তাতে কোনো পাপ নেই। এমন কথা কোন ধর্মে আছে? অথচ, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বোনদের কারণে ভাইয়েরা মাথা উঁচু করে চলে এবং তাদের সামাজিক মর্যাদাও বেড়ে যায়, বেড়ে যায় তাদের উপার্জন ক্ষমতাও। কিন্তু দেখা যায়, ভাইয়ে ভাইয়ে সব পরামর্শ করছে, সেখানে বোনেরা থাকে উপেক্ষার পাত্র।
অনেক পরিবার আছে বোনদের অবদানে টিকে আছে। সেটা হতে পারে অর্থনৈতিক, মানসিক, শারিরীক যাই হোক না কেনো, সেই পরিবারগুলো বোনদের অবদান স্বীকার করা তো দূরে থাক, মুখেও আনতে চায় না। এক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন। ধর্মে মেয়েদের যেভাবে থাকতে বলেছে সেভাবে সে থাকতে না পারলে পাপী হয়ে যাবে। কিন্তু সেই মেয়েটিই যখন বিপদেআপদে, অসুখে-বিসুখে, এমনকি যে কোনো প্রয়োজনে একটি পরিবারে অর্থনৈতিক-মানসিক-শারিরীকভাবে সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে আছে, তখনও তাকে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে পাপী মনে করা হচ্ছে এবং এই মনে করার কাজটি করে পুরুষকুল। অথচ, সেই বোনেরাই থাকে সর্বশেষ আশ্রয়। কারণ, বোনেরা কখনো ভাইদের ফেলতে পারে না। আর যদি ছোট ভাই হয়, সে থাকে বোনেদের বুকের ধন।
নারী যতো বড়ো শিক্ষিত, জ্ঞানী এবং উপার্জনক্ষমই হোক না কেনো, বাংলাদেশের সমাজ সংসার এখনও সেই নারীকে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করে মূল্যায়ন করে। মনে করে অবলা, অথর্ব, গণ্ডমূর্খ। এমনটা ভাবলেই, মাথা খারাপ হয়ে যায়। একইসঙ্গে বড় হওয়া ভাইবোনগুলো একসময় ভাইয়েরা হয়ে যায় পুরুষ আর বোনেরা হয়ে যায় অপাক্তেয়। সেইসাথে স্বামীর কাছে স্ত্রীও একই ভঙ্গিতে ব্যবহার পায়। যেমনটা বাব-মা’ও ছেলেরা বড় হতে হতে মেয়েদের দূরে সরিয়ে দেয়। কি নির্মম এই মানসিকতা! কতটা যে অমানবিক তা যদি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একবার গভীরভাবে অনুভব করার চেষ্টা করতো!
উপসংহারে কোনোকিছুই বলার নেই। কারণ, বাংলাদেশ এখন সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার আখড়া। যেখানে নারীর কোনো মর্যাদাই নেই। সেখানে নারীর কর্তৃত্ব, ক্ষমতা, মতামত মানবে কেনো? অথচ নারীর কাছ থেকে সবকিছুই হাত পেতে নিবে, ভোগ করবে। হায়রে আমার বাংলাদেশ, হায়রে মানুষ! আমি এখানে স্বল্প পরিসরে পুরো লেখাতে একটি পরিবারে মেয়েদের মূল্যায়নের বিষয়টি তুলে আনার চেষ্টা করেছি। কারণ, পরিবার থেকেই সমাজ সংসার রাষ্ট্রের সৃষ্টি। তাই বলছি, নারীর প্রকৃত মূল্যায়ন পরিবার থেকেই শুরু হতে পারে, যদি বাবা মা'রা তাদের মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলান।