ঝর্ণা আক্তার

প্রকৃতি, মানুষের সরলতা আর ভালবাসেন মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে। মানুষের, যেখানে নারী পুরুষের ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবে না কোন বৈষম্য, এমন দিনের স্বপ্ন দেখেন প্রতিনিয়ত।

আমরাও লিভ টুগেদার করছি

পড়ন্ত বিকেল, সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। মাথার উপর সারি সারি কৃষ্ণচূড়ার গাছ। গাছ ভরতি ফুল। শেষ বিকেলের রাঙা আলো আর গাছ ভরতি কৃষ্ণচূড়া, এক ঐশ্বরিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে। মামুন তবুও এটা উপভোগ করতে পারছে না। তার মন উচাটন, অস্থির, উদগ্রীব হয়ে রুপার জন্য অপেক্ষা করছে। রুপা আসবে তো! অনেক অনুরোধের পর আসতে রাজি হয়েছে। পঁচিশ বছর পর দেখা হবে, ভাবা যায়! ওদের সম্পর্কটা ঠিক প্রেমের ছিলো না, ওরা যখন ইন্টারমিডিয়েট পড়ে, তখন খুব ভালো বন্ধু ছিলো। রুপা কারণে অকারণে মামুনের বাড়িতে যেতো, কখনো নোট আনার জন্য, কখনো বই আনার জন্য কখনো মায়ের হাতের বানানো পিঠা খেতে।

তারপর দীর্ঘ পঁচিশ বছর তারা কেউ কারো খবর রাখে নি। মামুন পড়াশোনা করার জন্য অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। আর রুপা সেই বছরই বাব-মাকে হারায়। লড়াকু মেয়ে রুপা, হাল ছাড়ে নি, চাচাদের কাছ থেকে বাবার সম্পত্তি থেকে নিজের অংশ বুঝে নিয়ে, তার থেকে কিছু বিক্রি করে ঢাকায় চলে আসে, পড়াশোনা চালিয়ে যায়। 

মামুন অস্থির হয়ে ঘড়ি দেখে, দশ মিনিট পার হয়ে গেছে! কখন আসবে? মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করে, নাহ্, রুপার কোনো মেসেজ নাই। আসবে নিশ্চয়ই, না আসলে জানিয়ে দিতো। রুপার নাম্বার পাওয়া বা রুপার কথা মনে পড়ারও কথা ছিলো না। দেশে ফেরার পর একদিন আচমকাই রফিকের সাথে দেখা হয়। রফিক ও স্কুল ফ্রেন্ড, রফিকের কাছ থেকে সবার খবর জানতে যেয়েই রুপার প্রসঙ্গ আসে। রুপার নাম্বারও রফিকের কাছ থেকে যোগাড় করে নেয়। কোথায় যেন, একটা ব্যথা খোঁচা দিতে থাকে। একটা অপরাধবোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিলো। রুপার ওমন বিপদের সময়, তার পাশে না থেকে, স্বার্থপরের মতো পালানোর অপরাধ বোধ, রুপার ছলছল আখির ভাষা না বোঝার অপরাধ বোধ।

নীল শাড়ি, রেশমি লালচে চুলের অসাধারণ এক সুন্দরী এগিয়ে আসছে মামুনের দিকে। এটা রুপা! এতো চেঞ্জ! রুপা কাছে এসে সানগ্লাস খুলে ফেলে। রুপার সব বদলে গেছে, শুধু চোখ দু’টি ঠিক আগেরই মতো, মায়া ভরা, ভেজা ভেজা দীঘল কালো আখি।

-হ্যালো মামুন। কেমন আছিস?

-তুই রুপা! সানগ্লাস না খুললে চিনতেই পারতাম না। কি করে এতো বদলে গেলি!  

-তুই তো একদম বদলাস নি, এখনো আগের মতোই সুদর্শন!

-আমার কথা বাদ দে। তুই এতো বদলে গেলি কি করে। শরীরে একটুও মেদ নাই, সেই গোলগাল মুখটা লম্বাটে আর ধারালো হয়ে গেছে। তোকে তো ছাব্বিশ বলে চালিয়ে দেয়া যাবে! 

-খুব অবাক হয়েছিস? আগে জানলে কি করতি? দেশে থেকে যেতি?  

-চল কোথাও যেয়ে বসি, রাস্তাটা পার হলেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে। জানিসই তো, এতো ভিড় আমার ভালো লাগে না।

-যেতে পারি, তবে আমি খাওয়াবো, তুইতো অতিথি।

-রাজি, যাক কিছু টাকা বাঁচিয়ে দিলি।

-তুই এখনো আগের মতো ই আছিস, একটুও বদলাস নাই!  

মামুন আর রুপা পাশাপাশি হাটছে, তবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। রুপাদের অনেক ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হয়। সমাজের চোখ সবসময় মেয়েদের দোষ ধরার জন্য। এই সমাজে ছেলেদের কোনো দোষ নাই। এমনকি ধর্ষক ও মাথা উঁচু করে বুক চিতিয়ে চলাফেরা করে, আর নিরাপরাধী ধর্ষিতা হয় গলায় দড়ি দেয়, নয়তো সমাজের চোখে অস্পৃশ্যা হয়ে বেঁচে থাকে।

 

মামুন কিছুটা কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করেও পারছে না। মামুন যতটা কাছে আসে, রুপা ততটা দূরে যায়। রেস্টুরেন্টে উঠার সিঁড়িটা একেবারেই নিরিবিলি। মামুন আচমকাই রুপার হাত ধরে ফেলে, যেন এটাই নরমাল! রুপা নিঃশব্দে হাত ছাড়িয়ে নেয়, একসময় এইটুকু ছোঁয়া পাওয়ার জন্য কি উন্মুখই না ছিলো সে! মামুন বুঝে নি, নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে গিয়েছে! আজ আর সেই আকুতি নেই, সময় সবচে বড় ঔষধ। পঁচিশ বছরে অনেক পরিপক্ব হয়েছে সে, তার জীবনে আবারও প্রেম প্রেম এসেছিলো। তবে সেইদিনের কথা ও ভোলার নয়, বাবা মা হারা, অসহায় রুপাকে রেখে যেদিন মামুন দেশ ছেড়েছিলো।  

মামুন কর্নারের দিকের একটা টেবিল বেছে নেয়, রুপা আপত্তি করে না। দু’জনা মুখোমুখি বসে। 

-কি খাবি বল।

-তোর পছন্দের কোন খাবার অর্ডার দে।

-তুই আমার গেস্ট,  তুই খাবার পছন্দ কর। 

অবশেষে মামুন তার পছন্দের বার্গার আর শর্মা বেছে নেয়। সাথে সফট ড্রিংকস। ওদের বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই, কিন্তু দু’জনাই ত্রিশের মধ্যেই যেন আটকে আছে।

-কি করে এখনো এতো ফিট আছিস!  

-এসব বাদ দে, তোর কথা বল। বউ বাচ্চা নিয়ে এসেছিস?

-নাহ্, ওরা এই দেশে আসবে না, খুব ভয় পায়, নিরাপত্তা নেই। আছে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস। আমি চেয়েছিলাম আমার মেয়েটা আমার দেশ দেখুক।  কিন্তু ওর মা কিছুতেই ছাড়লো না।

-তোর মেয়ের বয়স কত? কত বৎসর হয় বিয়ে করেছিস?

-হ্যা বিয়ে করেছিলাম, তমা আমাকে ছেড়ে গিয়েছে এক বছরের মাথায়।

-ওহ্, স্যরি।

-না না, আমরা এখনই ভালো আছি। ফ্যান্সির সাথে লিভ টুগেদার করছি। আমাদের একটা মেয়ে আছে। আমরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি বাচ্চাটাকেও। শুধু কেউ কারো কাছে লিখিতভাবে আবদ্ধ নই। তবুও প্রায় আট বছর একসাথে আছি।

-বাহ্! তবে, আমরাও লিভ টুগেদার করছি, উইদাউট সেক্স।

-মানে!

-পার্থক্য এই যে, আমরা বিয়ে করেছিলাম। ভালোবেসেই করেছিলাম। আমরা কবে কি করে দূরে সরে গিয়েছি বুঝতেও পারি নি। শুধু একসময় মনে হতো, ও আমাকে ভালোবাসে না আর। অনেক হিসাব নিকাশ করে দেখেছি, আমিও আর ওর জন্য অপেক্ষা করে থাকি না, ওর জন্য খোঁপায় ফুলের মালা দেই না, ওর জন্য আয়নায় দাঁড়াই না। কাগুজে বন্ধন ছাড়া আমাদের আর কোনো বন্ধন নেই।  

-আশ্চর্য! তোরা একসাথে আছিস কেনো? তোদের তো বাচ্চাও নেই। তবে! আর উইদাউট সেক্স কি বুঝলাম না, কেনো?

-ওর কিছু সমস্যা ছিলো, বিয়ের আগে থেকেই ছিলো।  কিন্তু যখন বুঝলাম, অনেক দেরি হয়ে  গেছে। ভালোবাসা, বুঝলি ভালোবাসা ছিলো খুব, আমরা রাতের পর রাত শুধু গল্প করে কাটিয়েছি। তারপর গল্পের ঝুড়ি ফুরালো, মুগ্ধতা চলে গেলো, রয়ে গেলো শুধু আশ্রয়। একটা নিরাপদ আশ্রয়।

-তুইতো চাকরি করছিস, স্বনির্ভর। খুব লড়াই করে চাচাদের কাছ থেকে নিজের অংশ বুঝে নিয়েছিলি। একা এই শহরে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছিলি। যখন কেউ ছিলো না, তখন ও তো ঠিকঠাক এগিয়ে গেছিস। আর এখন?

-একা ছিলাম, তাই জানি, এই সমাজে একা চলা কি কষ্টের। তখন আত্মীয়, অনাত্মীয় পুরুষ গুলা খুব কাছে আসার চেষ্টা করে।  অকারণে সাহায্যের হাত বাড়ায়, আর বিনিময়ে হাত ধরতে চায়। আমি এখন ভালো আছি। ও আমার কাজে বা স্বাধীনতায় কখনো বাঁধা দেয় না। আমিও স্বাধীনতার অপব্যবহার করি না। উই আর লিভিং টুগেগার। বিনিময়ে একটা নিরাপদ আশ্রয়। শুধু আমি না, বাংলাদেশের অনেক মেয়ে শুধু নিরাপত্তার জন্য ভালোবাসাহীন সংসার করে যায়। যদিও সবাই আমার মতো লাকি না, রাতের পর রাত স্বামীর হাতে রেপড হয়, মাইর খায়, আর বাইরে কাজ করার অনুমিত ও পায় না। তারাও লিভ টুগেদার করে, শুধু একা হয়ে যাবার ভয়ে। সমাজের হিংস্র মানুষগুলার থাবা থেকে একজনেরই থাবার মধ্যেই নিজের আশ্রয় খুঁজে নেয়।  

-এতো যে  উন্নয়নের কথা শুনি, তা কি কেবলই কথার কথা?  

-তা হবে কেনো? উন্নয়নের সাথে সাথে নারী নির্যাতন ও বেড়েছে। খুব অল্প সংখ্যক মেয়ে বের হয়ে এসেছে। তাদের গাঁয়ে লাগানো হচ্ছে নষ্টা নারীর তকমা।

-আমি সত্যিই দুঃখিত রুপা। সত্যিই দুঃখিত।  

-কেনোরে, সেই দিনের কথা মনে পড়ে, যেইদিন অসহায় আমার পাশে না থেকে চলে গিয়েছিলি অস্ট্রেলিয়ায়।

-আমি আমার ভুলের শাস্তি ও পেয়েছি। বাবা-মাকে শেষ দেখা দেখতে পারি নি। বারবার ভালোবেসে কষ্ট পেয়েছি। শুধু ফ্যান্সি এই আমাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করেছে। আগামীকালই চলে যাচ্ছি, ফ্যান্সি আর আমার মেয়েটা অপেক্ষা করছে। চল উঠি এবার, তোকে এগিয়ে দেই।

-পাগল! আমি একাই যেতে পারবো। ভালো থাকিস, ভাল রাখিস ওদেরকে।

-তুইও। বাই।  

7136 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।