আমি পরমা। আজ কেঁদে যাই। কষ্টের কান্না নয়, স্বাধীনতার। সমান অধিকারের কথা বলে যাই সবসময়। নারীবাদে যে সমান অধিকার -এ সাতকাহনে যাই না। শুধু বুঝি মেধায় মননে কেউ কারো চেয়ে কম নয়, সবাই সমান। কারো কাছে সমান অধিকার ভিক্ষা করি না। দিতে হবে তাও দাবি করি না। শুধু দৃঢ় থাকি। যারা আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মানে নারী হিসেবে দেখে তাদের কাছ থেকে নিঃশব্দে দূরে থাকি। নিজেকে একজন পুর্ণাঙ্গ মানুষ মনে করি বলেই কারো দারস্থ হই নি নারীসুলভ দুর্বলতা নিয়ে।দুই দশকের কাছাকাছি সময় ধরে মানুষ হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেছি পরম মমতায় এবং আত্মতুষ্টিতে, প্রতিটা দায়িত্ব পালন করেছি নিজেকে নারী না ভেবে বরং মানুষ ভেবেই। নিজের আয় দিয়ে সেই ২০ বছর বয়স থেকে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলাম নিজেকে মেয়ে নয়, মানুষ ভেবে।
সব করেছি, প্রতিটা পাই-পয়সা দিয়ে। ঘাম আর রক্ত দিয়ে করেছি সময়ের প্রয়োজনে। কিছু পাওয়ার জন্য কিছুই করি নি। প্রয়োজন ছিলো সংসারের পাশে দাঁড়ানোর তাই ছিলাম নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে। আত্মবিশ্বাস ছিলো তাই করতেও পেরেছি যা করা দরকার। কখনো কোনোদিন বিনিময় কল্পনাতেও আসে নি। জোর করে বা অনিচ্ছায়ও কিছু করি নি, মন থেকে যা এসেছে তাই করেছি। কোনকিছুর হিসেবও রাখি নি।জীবনের এই সায়াহ্নে এসে দেখি এত কিছুর পরও সমাজ সংসার আমাকে শুধু নারীর পাওনা দিতে চায়, মানুষের নয়। আমার এক ভাই সম্পত্তির যা ভাগ পাবে আমরা তিনবোন মিলিয়ে তা পাবো। এক ছেলে = তিন মেয়ে। মেয়ের দায়িত্ব নয়, মানুষের দায়িত্ব পালন করেছি। আমি তো চাই নি কিছু। সে হোক এক টাকা বা এক কোটি টাকা। যদি নেই-ই তবে ন্যায্যটাই নেবো, মানুষ হিসেবে যতটা পাওনা ততটাই নেবো। মেয়ের পাওনা নয়। এ তো মেনে নেয়ার নয়। আমি সব দাবি ছেড়ে দেই চিরতরে। সমস্ত বন্ধনও ছিঁড়ে ফেলি। সমস্ত পিছুটান এক ঝটকায় শিকড়সমেত কবর দিয়ে ফেলি। কষ্ট পাই না বরং কোথায় যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস, স্বাধীনতার পুর্নরুপ অনুভব। আমি শিকড়হীন, বন্ধনহীন থাকি।
মুখেই শুধু সমান অধিকারে বিশ্বাসী নই, বিসর্জনও দেই প্রতি পদে পদে। আমার ছেলে আর মেয়ে এর সুফল পাবে। ওরা বুঝবে না নারী আর পুরুষ আলাদা প্রজাতি, তাদের অধিকার ভিন্ন। ওরা জানবে কিছুটা ভিন্ন আদলে হলেও আমরা সবাই মানুষ। অনেক বড় বিসর্জন দিয়েছি, অনেক বড় বিসর্জন তবুও বিশ্বাস আর আদর্শের সাথে সমঝোতা করি নি। সব হাসির আড়ালে আমার ভেতরটায় কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব বয়ে যাচ্ছে। খুব পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আল্পস এর চুড়ায় উঠে একবার খুব কেঁদেছিলাম, আজ সেরকম কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আজকের কান্নাটা কষ্টের নয়, বিশ্বাস আর দৃঢ়তার কান্না।